ভূগোলের গোল

যার কথা না শোনাই ভালো

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৮ মার্চ, ২০২৩ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

মদ খাওয়ার অভ্যাস ভালএটা না কোন ধর্মে বলে না কোন বিজ্ঞান জ্ঞানে বলে। তবুও মদ খাওয়া বিশ্বব্যাপী বাড়ছেই। মদ খাওয়া পরবর্তী বিচিত্র সব ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে। এসব ঘটনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবনার যথেষ্ট উপাদান থাকে। কিন্তু এসব দেখারও কেউ নেই, শোনারও কেউ নেই! আজকের লেখাটার প্রেক্ষাপট ভারতের বিহারে মদ খেয়ে বর বিবাহ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে। এটা ঘটেছে বিহারের ভগলপুর জেলার অতিবাক গ্রামে। বর সন্তোষ মন্ডল। কনে নীহাএকই জেলার মির্জাপুর গ্রামের। অনুষ্ঠানের রাতে বর বন্ধুদের সাথে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে পরের দিন সকালে দৌড়ে বিয়ে বাড়িতে গেলে কনে নীহা তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়, কনে পক্ষ বরকে ধোলাই দেয় ও বিয়ের সমস্ত খরচ দাবী করে। ঘটনাটা ঘটে ২০২৩ সালের মার্চে। মামলা চলছে।

ইউরোপেও মদ খাওয়া বেড়েই চলছে। এমবিবিএস পাস করে এমডি কোর্স করার সময় বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ার নামী হাসপাতালের গ্যাস্ট্রাএন টেরোলজী বিভাগে নয়মাস কাজ করতে হয়। একদিন অচেতন অবস্থায় মদ খেয়ে এক ৪০৫০ বয়স্ক রোগী আসে। বেটার ১০১২ ঘন্টা পরও হুশ আসে না। আমার বস ছিলেন সেই দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি দিনের যে কোন সময়ে হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে রোগী দেখতেন। এই অবচেতন রোগীর বেডে আসলে মন্ত্রী স্যারকে আমি তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করে চিকিৎসা কি দিচ্ছি বল্লাম। মন্ত্রী ঠাট্টা করে আমাকে বললেনও দুনিয়া থেকে চলে যেতে যাচ্ছে তুই আবার তাকে রাখতে এত চেষ্টা করছিস কেন? দুনিয়ায় মানুষ এত বেশি! এই সব আবর্জনা দুনিয়া থেকে চলে গেলেই ভাল! মদ খাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে স্যারের কথাটা আমার মনে দাগ কাটে!

ভারতীয় ও শ্রীলংকার বেশ কিছু মানুষ বাংলাদেশে কাজ করে। বিদেশী অনেক রোগী পাই। ওদের থেকে জানতে চাই বাংলাদেশে তাদের কি ভাল লাগে। আর কি ভাল লাগে না। ভারতীয়দের ভাল লাগে সবজি, শ্রীলংকানদের ভাল লাগে মাছ, মাংস। শ্রীলংকানদের ভাল লাগে না রাস্তাঘাটে ময়লা। ভারতীয়দের ভাল লাগে নাপথে ঘাটে মদ পাওয়া যায়না।

২০০০ সালে মুম্বাইতে হাঁপানীর একটা অনুষ্ঠানে যাই। আমাদেরকে রাখা হয় ‘নিউজিল্যান্ড হোটেল’এ। এটা একটা ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন নগরী। ১৯৬০ সালে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নির্মিত। কনফারেন্স রুম, থাকার রুম, কেন্টিন সব একত্রে। ওখানে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। সব গেইট পর্যন্ত আলাদা গাড়ি নামিয়ে দেয়। যা হোক প্রতি দুই জনকে এক রুম দেয়া হয়। আমার রুমে দেয়া হয় বিহারের এক ডাক্তারকে। বেশ মিশুক। বাংলাদেশ সম্বন্ধে সব জানে। অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে নরিমান পয়েন্টে ‘রুফ টপে’ এক পার্টি দেয়া হয়। রাতে একদিকে আরব সাগর, অপরদিকে বাণিজ্য এলাকার উঁচু বিল্ডিং আর ‘গজল রাত’। এই বিহারী ডাক্তার মদ পেয়ে গ্লাসের পর গ্লাস খেতেই থাকে। এক পর্যায়ে রুমে ফেরার পালা। বেটা বেহুঁস বুদ হয়ে আছে। সবাই আমাকে বললতোমার রুমমেট, তুমি তাকে গাড়িতে তোল। তাকে আমি নড়াচাড়া করলাম। ভাবলাম তার এই নেশা কাটবার নয় কাউকে কিছু না বলে বিহারী ডাক্তার ছাড়াই সোজা গাড়িতে রুমে চলে এলাম। ভারতীয়রা পকেটের পয়সায় কেমন মদ খায় জানি না। কিন্তু বিনা পয়সায় পার্টিতে মদের সদ্ব্যবহার করে দারুণ উচ্ছ্বাসে।

২০১৬ সালে প্রীতিলতা নামের এক স্কুল শিক্ষিকা ভারতে বিয়ের মন্ত্রপাট শেষে মালা বদলের সময় বরের মুখে মদের গন্ধ পায়। কনে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেহর হামেশা পিনা মুঝে বহুত পছন্দ হ্যায়। বর বলে উঠে বহুত পিতা হ্যায়। বাস্‌। কনে তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।

বিশ্বে ৬% লোক মদ পান করে। অর্থাৎ প্রায় ৬০ কোটি লোক মদ আসক্ত। তার মধ্যে ১২ কোটি লোকের মদ নিবারক চিকিৎসা করতে হয়। ভারতে কয়েকটি রাজ্যে বিশ্বগড় ৬% এর বেশী ১০% লোক মদ পান করে। এসব রাজ্য হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, ছত্রিশগড়, আন্দামাননিকোবার, অরুনাচল ও কেরালা। বিশ্বে মদনির্ভরতা (Alcohol dependency) সবচেয়ে বেশী রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকায় মদ পান কম।

ভারতের অরুনাচল প্রদেশে ৫৩% পুরুষ ও ২৪% নারী। কেরালায় ৪২% পুরুষ ও ৩% নারী, পাঞ্জাবে ৩৫% পুরুষ ও ২% নারী মদ পান করে বলে সমীক্ষায় স্বীকার করেছে। খ্রীস্টান অধ্যুষিত কেরালায় অধিকাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ হয় মদ পানের কারণে। খ্রীস্টানদের প্রভাবে কেরালার অন্য ধর্মাবলম্বীরাও বেশ মদ পান করে। ১৯৯৬ সালে কেরালার চিফ মিনিস্টার এ.কে. এন্টনি তার এলাকা আট্টাপাডুকে মদমুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করেন। কেরালার বর্তমান কমিউনিস্ট চিফ মিনিস্টার বিজয়ানও ক্রমান্বয়ে কেরালায় মদ পান কমাতে চেষ্টা করছেন। তিনি মদের দোকান বন্ধ ও রেশনিং প্রথা চালু করেছেন। কিন্তু তাতেও হচ্ছে না। মানুষ ভোর সকালেই নির্ধারিত মদের দোকানে লাইন ধরে।

ভারতের অনেক রাজ্যে প্রকাশ্যে মদ পান নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মানুষ দেশী মদে অভ্যস্ত। দেশী মদ খেয়ে বিষক্রিয়ায় ২০১৯ সালে ভারতে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১৬ থেকে ২০২২ অবধি ভারতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ২ কোটি লিটার মদ জব্দ করে, ৩৭ লক্ষ মামলা করে, ৫২ লক্ষ মানুষ এরেস্ট করে। অবৈধ মদ খেয়ে বেশী মৃত্যুর রাজ্য বিহারে মদ নিয়েও রাজনীতি হয়। নীতিশের রাষ্ট্রীয় জনতা দল মদ নিষিদ্ধ চায় কিন্তুু ভারতীয় কংগ্রেস চায় না।

বাংলাদেশ শুধু ‘পারমিটধারীরা’ মদ বিক্রয়, স্টোর ও বহন করতে পারে। ২০২২ সালে একুশ বছরের নিচে কারো কাছে মদ বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ। সরকার অনুমোদিত কিছু প্রতিষ্ঠান কয়েক জাতের মদ উৎপাদন করে। মুসলিম প্রধান এদেশে মদের ব্যাপকতা কেমন? তার কোন সমীক্ষা আমার জানা নেই। তবে সংবাদপত্রে চোলাই মদ উদ্ধার, অভিজাত এলাকায় ঘন ঘন দামী ব্রান্ডের মদ উদ্ধার এর ঘটনা দৃশ্যে মদ ব্যবহারের ব্যাপকতা বৃদ্ধির আশংকাই প্রতীয়মান হয়।

পেশাগত কারণে রোগীদেরকে অনেক প্রশ্ন করতে হয়। সিগারেট, মাদক ও মদের ব্যবহার জিজ্ঞাসা করা আমাদের রুটীন কাজ, উত্তরে যা পাওয়া যায় তাও ভয়াবহ ব্যাপার। শহরে, গ্রামেগঞ্জে মদ ব্যবহার অকল্পনীয়। পুলিশের পক্ষে এর রোধ দুরূহ। গ্রামেগঞ্জে জনপ্রতিনিধিরাও নির্বিকার ভোট ব্যাংক বা স্থানীয় সম্পর্কের ব্যাপারে। পেশাগত জীবনের শুরুতে শহরের বিশেষ বিশেষ এলাকায় মদ পানের ব্যাপকতায় আমি বিস্মিত হই। দুর্ভাগ্যক্রমে পুরুষের মদপানের প্রধান ভিকটিম নারীরা। ছোট ছোট বাচ্চাসহ নারীদের অসহায় মুখ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার স্যার বুলগেরিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাআসলেই কি এসব দুর্বৃত্তের বাঁচার অধিকার আছে? পরিবার, সমাজ সবকিছুই বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে মদ্যপরা। ভারতের নীহা, প্রীতিলতারা তো নিজেরাই বর্জন করেছে মদ্যপ হবু স্বামীকে। নীহা বলেছিল একজন Irresponsible (দায়িত্বহীন) লোকের সাথে জীবন কাটাতে সে রাজি নয়। মদের ঘটনারও শেষ নেই। আবার সাহিত্যেও মদের কাণ্ডের শেষ নেই। সম্প্রতি ছন্দক চক্রবর্তী মদের শুরুশেষ নিয়ে লিখেছেন এক বই। নামআমি মদ বলছি! যেই বলুক মদের কথা না শোনাই ভাল।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেপিএম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় উপজেলা প্রশাসনের সংবর্ধনা বর্জন মুক্তিযোদ্ধাদের