আজ থেকে একশ বছর আগে উপমহাদেশের উর্দু কবি ইকবাল বলেছিলেন– মুসলমান কবরে, ইসলাম কিতাবে, আজকে জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলমানদের যে ধর্মীয় বিচ্যুতি তাকে না বলা যায় আধুনিকতা, না বলা যায় প্রগতিবাদী। বড় জোর বলা যায় উন্নাসিকতা, মুসলিম জীবনের বড় উন্নাসিকতা, মুসলিম জীবনের বড় উন্নাসিকতা হাল–আমলের বিবাহ–অনুষ্ঠান।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নেই। তাছাড়া আজকাল সমকামী বিয়ে সব দেশে চলছে। কোনদেশে আইনসিদ্ধ, কোন দেশে আইন অনুমোদিত নয়। উপমহাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে সংস্কৃতি বিরোধী এ ধরনের বিয়ে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও কনজারভেটিভ বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ এ ধরনের বিয়েকে ভাল চোখে দেখে না।
ইসলাম ধর্মে বিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যের স্মারক। নারী পুরুষের মিলনের এই এবাদত কী পদ্ধতিতে হবে তা পবিত্র কোরানে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত। আর হাদীসে বিয়ের বিভিন্ন দিকের, সীমা লঙ্ঘন না করার বিষয়ে বিশদ উল্লেখ আছে।
আজকালের বিয়ের প্রথম বিচ্যুতি গায়ে হলুদ। গ্রামে অনেকে বিয়ের দাওয়াত দেয় মোবাইলে। বলা হয় বিয়ে ৭/৮ তারিখ, ১২/১৩ তারিখ ইত্যাদি। আমি প্রথম দিকে বুঝতাম না বিয়ে কিভাবে গায়ে হলুদসহ তারিখ গণনা করা হয়। দুই–তিন যুগ আগে ও এরকম দুইদিন বিয়ের ঘটনা ছিল না।
ইসলামে বিয়ে পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ ও স্বল্প খরচের। এরকম একটা এবাদতকে হাসি–তামাশা, রং–তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। আক্দের পরে বিশদ লম্বা মোনাজাত, কিয়াম ইত্যাদি করা হয় কিন্তু রসুল (সা.) এর শেখানো নব–দম্পতির জন্য দোয়াটা খুব অল্প বিয়েতে উচ্চারণ করা হয়। এটা হচ্ছে-“আল্লাহ তোমাদের জন্য বরকত দান করুক, তোমাদের উপর বরকত নাজিল করুন, তোমাদেরকে কল্যাণের মধ্যে একত্রিত করুন।
একটা হাদীসে আছে–নিশ্চয়ই সে বিয়ে বেশী বরকত হয় যে বিয়েতে খরচ কম হয় (মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
বিয়ে সংশ্লিষ্ট আরো বহু হাদীস আছে। যেমন বিয়ে সাদামাটা হওয়া, অনাড়ম্বর হওয়া, অপচয়, অপব্যয়, অপসংস্কৃতিমুক্ত হওয়া, যৌতুকের শর্ত না থাকা, সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর ধার্য না করা।
কনেপক্ষ থেকে অলংকারের শর্ত করা নিষেধ, যৌতুক চাওয়া হারাম। অনেক ধনীলোক আজকাল সব সুন্নত আধা পালন করে শুধু ওয়ালিমার সুন্নত পালন করে জাঁকজকমভাবে হাজার মেহমান দাওয়াত দিয়ে।
কিন্তু হাদীস হচ্ছে– যে ওয়ালিমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয় দ্বীনদার ও গরিব মিসকিনদের দাওয়াত দেয়া হয় না–সেই ওয়ালিমা নিকৃষ্টতম ওয়ালিমা। (আবু দাউদ ৩৭৫৪)
মেয়ে পক্ষের উপর আপ্যায়নের যে চাপ সৃষ্টি করা হয় তা হারাম (মুসনাদে আহমদ ২০৭২২), বুখারী ২৬৯৭)। বর্তমানে কনে পক্ষকে বার্গেইনিং করে এত মেহমান খাওয়াতে হবে বলে যে আপ্যায়ন করা হয় তা জায়েজ নয় এবং তাতে অংশগ্রহণ করাও গুনাহের কাজ (কিতাবুল নিকাহ, দুররুল মুখতারী)।
এসব তো গেল ধর্মীয় দিক। বিয়ের আর্থিক ব্যাপার–স্যাপার রীতিমত ভয়াবহ বিপদ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের মানুষের জন্য। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের বিয়ের খরচ দেনমোহর বাদে ন্যূনতম ৩ লাখ থেকে ২৫–৩০ লাখ। উচ্চবিত্তের খরচ ৫০ লাখ থেকে কয়েক কোটি। গ্রামে দরিদ্ররা পাড়ার মানুষ ও আত্মীয় স্বজনের আর্থিক সহায়তায় বিয়ে নামক ভয়াবহ বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। আজকাল শহুরে বড় লোকদের খাওয়া–দাওয়া, আলোক সজ্জা, গান–বাজনা ইত্যাদি গ্রামে গরিব ধনী সবার মাঝে সংক্রমিত হয়েছে। এটা বড় সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ধনীদের মানুষ অনুকরণ করে। কাজেই এই সর্বনাশা ধর্মীয় বিকৃতির দায় সমাজের ধনীদের ওপর অধিকতরভাবে বর্তায়।
বিয়ের খরচগুলো হচ্ছে– খাবার, বাদ্য, এনগেজমেন্ট খরচ, ফটো, ডেকোরেশন, ভিডিও, ভেন্যু, বিয়ের পরের খরচ ইত্যাদি। উপমহাদেশে বিয়ের খরচ যোগাতে নিম্ন বিত্তের মানুষ ধার করে, জমি বিক্রয় করে। এই রীতি বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকে। এক পরিবারের কয়েক সন্তান থাকলে পরিস্থিতি অনুমেয়। বিয়ে সংক্রান্ত খরচের ঝামেলায় উত্তর ভারতে হাজারে ৫ ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।
পাশ্চাত্য বিয়ের মেহমান ৫০ থেকে ১০০ হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। দু–এক ক্ষেত্রে ১৫০ এর উপরে যায়। বিলাতের প্রয়াত রাজবদু প্রিন্সেস ডায়ানার বিয়েতে পরিবার বর্গ, আত্মীয়সহ মেহমান ছিল সাড়ে তিনহাজার। খাবার আপ্যায়ন করেছিল ৮০০ ব্যক্তিকে। এই বিয়েকে বলা হয় শতাব্দীর সেরা বিয়ে (Wedding of century)।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তি জনার্দন রেড্ডি। তার মেয়ে এম্মানী রেড্ডির বিয়েতে পঞ্চাশ হাজার মেহমানকে খাওয়ানো হয়েছিল। দুই হাজার ট্যাক্সি শুধু মেহমানদের খেদমতে ছিল। পনেরটি অস্থায়ী হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হয়েছিল। শাড়ির দাম ছিল ১৭ কোটি রুপী, গয়নার দাম ৯০ কোটি রুপী, অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্রাজিল থেকে আনা গ্রুপের সাম্বা নাচের বন্দোবস্ত করা হয়। এটা পৃথিবীর আজ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যয়–বহুল বিয়ে। এটাকে ভারতীয় মিডিয়া সম্পদের নগ্ন ও অশ্লীল প্রদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
আমাদের দেশে ইদানীং বিদেশী গায়ক–গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, কয়েক হাজার মেহমান খাওয়ানোর প্রবণতা শুরু হয়েছে। একজন থেকে দেখে আরেকজন এসব বিত্তের প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তার সর্বগ্রাসী ফলস্বরূপ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য এটা একটা সাক্ষাৎ ‘গজব’। বিয়েকে এবাদতের পর্যায়ে ফিরে আনার জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। বেশি প্রয়োজন সরকারি বিধি নিষেধের আরো কড়া বাস্তবায়ন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবার সাবধান ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক।