আট হাজার টাকায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ!

প্রথম সারির কলেজে ভর্তি হতে জালিয়াতির আশ্রয় শিক্ষার্থীর

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযোদ্ধা সনদ, এর স্বপক্ষে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র; সবই আছে সফিকুলের। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট নিয়েই ২৬ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কলেজে ভর্তি হতে আসে এই শিক্ষার্থী। তবে সফিকুল যখন আসে, ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল চারটার ঘরে। বলতে গেলে দিনের শেষ বেলায়। শিক্ষকরাও কাজ শেষ করে অনেকটা গোছাতে ব্যস্ত। কিন্তু ওইদিন ছিল ভর্তির শেষ সময়। তাই ভর্তি হতে যাওয়া কোনো শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল না। তবে যাচাই করতে গিয়েই মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও এর স্বপক্ষে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে সন্দেহ হয় দায়িত্বরত শিক্ষকের। যাচাইবাছাইয়ের পর এ দুটি সনদই ভুয়া বলে অনেকটা নিশ্চিত হন শিক্ষকরা। ফটো পেপারে প্রিন্ট করে এর পিছনে আরো দুটি সাদা কাগজ যুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা সনদটি লেমিনেটিং করা হয়েছে। আর চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন পত্রটি কম্পিউটার প্রিন্ট এবং সীলস্বাক্ষর স্ক্যান করে বসানো। দেখেই জালিয়াতির বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হন ভর্তি কার্যক্রমে দায়িত্বরত কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আব্দুল মান্নান ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রসেনজিৎ পাল। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করে ওই শিক্ষার্থী। নগরীর বাকলিয়া সরকারি কলেজের ঘটনা এটি।

জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া শিক্ষার্থী সফিকুল ইসলামের বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া হরিদারঘোণায়। উপজেলার বি জি সেনেরহাট হাই স্কুলের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ২০২২ সালে এসএসসি উত্তীর্ণ হয় সে। যথারীতি কলেজ ভর্তির জন্য আবেদনও করে। প্রথম দফায় বার আউলিয়া ডিগ্রী কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয় সে। কিন্তু বেসরকারি কলেজ হওয়ায় নির্বাচিত হলেও ভর্তির প্রাথমিক নিশ্চায়ন করেনি সফিকুল। পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করে সে। এজন্য সাতকানিয়ার মৃত আহমদ হোছেন নামে একজনের মুক্তিযোদ্ধা সনদকে বানানো হয় নানার সনদ। আর নিজের মাকে মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে সাজাতে বানানো হয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র। কম্পিউটার প্রিন্ট করে বানানো এই প্রত্যয়নপত্রে চেয়ারম্যানের সীলস্বাক্ষর স্ক্যান করে বসানো। প্রত্যয়নপত্রটি ১নং বড় হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় কুমার বড়ুয়া’র হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান এই প্রতিবেদক। জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় কুমার বড়ুয়া প্রতিবেদককে বলেন, প্রত্যয়নপত্রটি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেয়া হয়নি। এটির সত্যতা নেই। কোনো জালিয়াত চক্র এই ভুয়া প্রত্যয়নপত্র বানিয়েছে।

এদিকে, জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করার পর ওই শিক্ষার্থীর কাছে একটি মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি আবারো কলেজে গিয়ে ভর্তির জন্য তদবির করে সে। এ কাজে কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকেও ব্যবহার করে সফিকুল। জালিয়াতি স্বীকারের পাশাপাশি মুচলেকার পরও একজন শিক্ষার্থীর এমন কর্মকাণ্ডে বিস্মিত বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জসিম উদ্দিন খান।

তিনি আজাদীকে বলেন, আমরা ওই ছেলেটির মূল একাডেমিক সনদ জমা রেখেছি।

অভিভাবক নিয়ে এসে মূল সনদ নিয়ে যেতে বলেছি। কিন্তু ছেলেটি বাবার মোবাইল নাম্বার দেয় নি। অভিভাবক নিয়ে আসতে বললে আর আসেনি। দায়িত্বরত শিক্ষকরা সতর্কতার সাথে যাচাই করায় এই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েছে জানিয়ে অধ্যক্ষ প্রফেসর জসিম উদ্দিন খান বলেন, শিক্ষকরা সতর্ক না হলে জালিয়াতি করেও ছেলেটি পার পেয়ে যেতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতো। এভাবে সনদ জালিয়াতির ঘটনা অনেকেই ঘটাতে পারে সন্দেহ পোষণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সতর্কতার সাথে সব কাগজপত্র যাচাইবাছাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বাকলিয়া সরকারি কলেজের এই অধ্যক্ষ।

আজাদীর এই প্রতিবেদকের কাছেও জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করে সফিকুল। তবে সফিকুলের দাবিসরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ করে দেবে বলে এক যুবক তাকে প্রলোভন দেখায়। ৮ হাজার টাকা দিলেই তাকে সব ব্যবস্থা করে দেবে বলে জানায়। কথা অনুযায়ীসফিকুল ওই যুবককে ৮ হাজার টাকা দেয়। বাকি কাগজপত্র সব ওই যুবকই বানিয়ে দেয়।

সাতকানিয়ায় ওই যুবকের সাথে দেখা হয়েছিল জানালেও তার (যুবকের) নামপরিচয় এবং মোবাইল নাম্বার কিছুই জানা নাই বলে দাবি করে সফিকুল।

ভর্তি কার্যক্রমে দায়িত্বরত কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আব্দুল মান্নান ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রসেনজিৎ পাল বলেন, ওই শিক্ষার্থী ভর্তি হতে আসে একদম শেষবেলায়। যাতে তাড়াহুড়োর মধ্যে কাগজপত্রগুলো ধরা না যায়। কিন্তু আমরা হাতে নিয়েই বুঝতে পারি এই সনদ ও প্রত্যয়নপত্রে ঝামেলা আছে। ভালো করে দেখতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদটি জালিয়াতি করে বানানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়। আমরা ওয়েবসাইটে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদটি যাচাই করি। তাতে নাম ও গেজেট নম্বর সঠিক পাওয়া যায়। তবে ওই মুক্তিযোদ্ধার ওয়ারিশ হিসেবে কেবল এক ছেলের নাম পাওয়া যায় ওয়েবসাইটে। সে হিসেবে উনার কোনো মেয়ে নাই। কিন্তু সফিকুলের মা ওই মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে মর্মে ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র দাখিল করা হয়। পরে ওই ইউপি চেয়ারম্যানের সাথেও কলেজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যানও প্রত্যয়নপত্রটি ভুয়া বলে নিশ্চিত করেন। এভাবেই সফিকুলের জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধসিগারেট এনে না দেয়ায় ইটের আঘাতে নৈশ প্রহরীকে খুন