ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম

| মঙ্গলবার , ৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

আল-ইনতেজারু আশাদ্দুন মিনাল মওত

সময়-অপচয়
আরবী প্রবাদ-আল ইনতেজারু আশাদ্দুন মিনাল মওত অর্থাৎ প্রতীক্ষায় থাকা মৃত্যুর চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কথাটা রম্য লেখক প্রয়াত আসহাব উদ্দিন আহমদের লেখা থেকে উদ্ধৃত। যারা তরুণ প্রজন্ম-তাদের জানার জন্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন সম্বন্ধে দু-চার কথা বলতে হয়। ভদ্রলোক পঞ্চাশের দশকে কুমিল্লা ভিকটোরিয়া কলেজের ইংরেজি লেকচারের সরকারি চাকরি ছেড়ে যান-রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে। রম্য লেখক হিসেবে দুই বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। দারিদ্র্য, সুবিধাবাদ, দুষ্ট রাজনীতিকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন ধ্রুপদী এই সাহিত্যিক। আলোচ্য সময় ও নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে এই লেখাটি আসহাব উদ্দিন সাহেবের অনুরূপ লিখার ‘রিমিক্স’ ধরে নেওয়া যায়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যত অভাব তার চেয়েও বেশি হচ্ছে অপচয়। অপচয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অপচয়-সময়ের অপচয়। জাতি হিসেবে আমাদের অনেক সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয় এই সময়ের অপচয়। আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকজন ঘড়ি, মোবাইল ব্যবহার করে। যারা হাতে ঘড়ি ব্যবহার করে না তারা শিক্ষিতদের থেকে অধিকতর সময়ানুবর্তিতার পরিচয় দেয়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমার বাড়ি ট্রেন লাইন থেকে দূরে নয়। প্রতিটি ট্রেনের হুইসেল শোনা যেত। ছোটকাল থেকে দেখতাম ফার্স্ট ট্রেনের হুইসেল শুনে কৃষকরা মাঠে কাজ শুরু করত, সেকেন্ড ট্রেনের আওয়াজে নামী-পান্তা খেত, দুপুরের ট্রেনের হুইশেলে লাঞ্চ করত আর পাঁচটার ট্‌্েরনের সময় কাজ শেষ হত। কৃষকদের সময়জ্ঞান নিয়ে কেউ কৈফিয়ত করতে পারবে?

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব চমক দেওয়ার মানুষ। সচিবালয়ে উপস্থিতি চেক করা শুরু করেন। ফল ভাল ছিল না। যতই উপরের সাহেবের দিকে যান ততই সময় মানার নির্লিপ্ত ভাব বাড়তে থাকে। জনতার চেয়ে জননেতাদের সময়নিষ্ঠার অভাব লক্ষণীয়।

প্রফেসর আসহাব উদ্দিন তার সময়ে ডাক-সাইটে রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন সভা-সমিতির বিবরণ দিয়ে লিখেছেন যে অনেক সময় সভা নির্ধারিত সময়ের ৩ ঘণ্টা পরেও শুরু হত। নেতারা বিলম্বে আসার জন্য কোন দুঃখও প্রকাশ করতেন না।

অনেক সময় আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে সচেতনভাবে সময়নিষ্ঠার নীতি অনুসরণ করি না। মনে মনে যুক্তি আঁটি যে দেরি করে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ অন্যরাও দেরি করবে। আসহাব উদ্দিন সাহেবের ভাষায় আমরা পাংচুয়েলি আন পাংচুয়েল। অর্থাৎ আমরা নিয়মিতভাবেই অনিয়মিত। জাতিগতভাবে আমাদের বিকৃতি ও অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা শংকার বিষয়। সামন্তবাদ এদেশে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সামন্তবাদী দম্ভ আমাদের মন-মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে আছে।

সম্প্রতি এক নেতা শুক্রবার কর্মীদের সাথে কথা-বার্তায় জুমার নামাযে দেরি করে ফেললেন। উনি ইমাম সাহেবকে একহাত নিলেন। কারো জন্য নামাজ দেরিতে শুরু করা ইসলামে অনুমোদন নেই। নেতা গোস্বা করে বলেই ফেললেন যে-উনি এই মসজিদে আর নামাজই পড়বেন না, কোথায় আছি আমরা।

একদিন এক অনুষ্ঠানে ডাচ, জার্মান রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ে প্রধান অতিথি ১০০ কিমি: দূরে সড়ক পথে ছিলেন। ভাবখানা এমন যে- জনতা তো ‘আমার’ জন্য অপেক্ষা করবেই। আয়োজক, অতিথি, জনতা কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। এটাই যেন রেওয়াজ, সামন্তবাদী দৃষ্টিভংগীর সামান্যতম পরিবর্তনও দৃষ্টিগোচর হয় না সমাজ বিবর্তনে।

সবচেয়ে নাজুক অবস্থা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার বার্ষিক অনুষ্ঠানে। কোমলমতি বাচ্চাগুলো প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির দেখা নাই। এক অতিথি ১৫ মিনিট দেরী করে তো অন্য অতিথি ৩০ মিনিট। আমি ছাত্র অবস্থায় লাইন ছেড়ে কোন ছায়ায় লুকিয়ে থাকতাম। নেতা আসলে দৌড়ে লাইনে দাঁড়াতাম। হায়রে দেরি করার সংস্কৃতি।

গ্রামে-গঞ্জের সভা-সমিতির অবস্থা কৃষি-কাজের রুটিনের সাথে সম্পর্ক রেখে করতে হয়। শুষ্ক মওসুমে সন্ধ্যার পর-অনুষ্ঠান জমে ওঠে। বিভিন্ন কারণে বক্তার সংখ্যাও বেশি, মঞ্চে চেয়ারও বেশি। প্রতিজন নেতাদের সম্বোধনে ৩-৪ মিনিট ব্যয় করলে ১ঘণ্টা শুধু সম্বোধনেই যায়। কাজের কথা মনেও থাকে না। আগের বক্তা সময় শেষ করে ফেলে বক্তব্য চালাতে থাকলে পরবর্তী বক্তাদের অবস্থা নাজুক। যে নেতাদের প্রতিদিন দেখেন, যারা আপনাদেরই সমাজের মানুষ ওদেরকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করতে যায় ১০-১৫ মিনিট, এসব আকামের কাম করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যও সংক্ষেপে করতে হয়। এসব আজকের বাংলাদেশের সমাজের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।

বাংলাদেশে গত কয়েকবছর যাবৎ বিভিন্ন কর্মস্থলে ঢোকার ও বের হওয়ার সময় আঙ্গুলের ছাপ বা ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে কর্মচারীদের উপস্থিতির সময় রেকর্ড করা হয়। বিদেশী কর্মচারী নির্ভর কিছু প্রতিষ্ঠানে এটা ভাল ফল দিলেও বাংলাদেশী কর্মচারী অধ্যুষিত অফিস ফ্যাক্টরীতে এটা নিছক এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। উপরের অফিসাররা তো দেরীতে আসেনই, সাধারণ কর্মচারীরাও মাসের অধিকাংশ সময় দেরী করে আসে। এদের অনেকেই অভিজ্ঞ শ্রমিক ও জরুরি কয়জনের বেতন কাটবেন? বেতন কাটলে অন্যত্র চলে যাবে। কাজেই আমাদের দেরীতে হাজিরা ঠিক করার কোন ঔষধ এখনো কাজ করছে না।

লেখালেখি আমার জন্য কোনো বিলাসিতাও নয় প্রচারমুখিতাও নয়। দুচার পাতা যা লিখি তার উদ্দেশ্য হল পাঠকমনে আনন্দ ও পরিবর্তনকামিতা সৃষ্টি করা। বুড়ো-প্রজন্মের কথা বাদ দিলাম। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ও নেতৃত্বের মধ্যে সময়জ্ঞান ও সময়ের অপচয় রোধ না হলে বিশ্ব দরবারে আমাদের মূল্য কি হতে পারে?

পেশাজীবীদেরকে অনেক অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয়। ডাক্তার হলে তো কাম সারছে। বড় নেতাদের পরে ডাক্তারের চেম্বারের সময় হয়ে যায়। ডাক্তার না পারে পালাতে, না পারে গুছায় বক্তব্য দিতে। বক্তব্য দিয়ে সট্‌কে পড়া ও ডাক্তারদের জন্য দৃষ্টিকটু। আমার এলাকায় মানুষজন বলাবলি করে ছুটির দিনে ডাক্তারের বক্তব্য একরকম, চেম্বারের আগে হলে একরকম! সময় তুমি কার? শুধু মঞ্চে আসনকারীদের! আমজনতার তো সময় জ্ঞানের দরকারই হয় না। জীবন সংগ্রামে ছয়টা যা, বারোটাও তা! তবে প্রতীক্ষা যেন বেশি সময়ের না হয়।

লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর চোখের কিছু সচরাচর অসুখ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে টানা দুইদিন করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যু শূন্য