ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

বিলাতে ইসলাম : আধুনিকতা

বিলাতে আমি প্রথম আসি ছাত্র অবস্থায় পূর্ব ইউরোপে অধ্যয়নকালে। তখন একবার ঈদের নামাজ পড়তে দুইঘণ্টা গাড়িতে করে মসজিদ খুঁজতে হয়েছিল। আজকে বৃটেনে ইসলাম সম্বন্ধে লিখার কারণ হলো এক বাঙালি দম্পতির বাসায় বেড়াতে গিয়ে বাসায় মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে গেল। উনাদের ক্লাস ফোরের ছেলে চটপট মাথায় টুপী দিয়ে ইমামতি করতে দাঁড়িয়ে গেল। মনে খটকা নিয়ে নামাজের নিয়ত করলাম। ঐ বাচ্চা প্রথম রাকাতে আয়াতুল কুরসী, ২য় রাকাতে সুরা যিলযালাহ পড়ে নামাজ শেষ করল।ওর মা-বাবা তাকে কোরান শেষ করায়েছে অনলাইন ক্লাস করায়ে। বৃটেনে মুসলমানদের ধর্মচর্চা সত্যিই প্রশংসনীয়। এত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে চলার প্রবণতা আশ্চর্যের ব্যাপার। বাংলাদেশে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। যারা ছোটকালে কোরান পড়েছে তারা অনেকে সোজা কোরান তেলাওয়াত ভুলে গেছে। একটা মজার অভিজ্ঞতা বলি। আমার ছয় বছরের নাতিকে হুজুরের কাছে দিয়েছি একবছর হল। জানতাম না যে হুজুর একজন ক্বারী সাহেব। আমার নাতির সূরার পঠন ও উচ্চারণ ক্বারীর মত হওয়ায় সবাই ওকে ঠাট্টা করে। একদিন পথে দেখি দুই তিনজন ২৫-৩০ বছরের তরুণ আমার নাতির সাথে হাই-হ্যালোও করল। নাতিকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ লোকগুলোতো বড়, ওদেরকে কেমনে চিন? নাতি বলল ওরাও হুজুরের কাছে আলিফ, বা পড়ে। এটাই বাংলাদেশে ইসলামের দুর্ভাগ্য। এই তরুণরা হয়তো লোক লজ্জা ভুলে আলিফ, বা শিখছে, কিন্তু কোটি তরুণ পড়া-লেখার ঠেলায় কবে ভুলে গেছে কোরান তেলাওয়াত। পুরা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার শিক্ষিত মুসলিমদের মাঝে ধর্মের প্রতি অনুরাগ যেন Revival of Islam- ইসলামের পুনর্জাগরণ।
যুক্তরাজ্য মেইনল্যান্ড ইউরোপ থেকে সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। তাই মেইনল্যান্ড ইউরোপে ইসলামের যে সহজ আগমন ও বিস্তার ছিল যুক্তরাজ্যে তেমন কিছু ছিল না। তবে অষ্টম শতাব্দীতে মার্সিয়ার এংলো সেকসান রাজা ওফা বিলাতে প্রথম ইসলামী মুদ্রার আদলে এক মুদ্রা চালু করেন। এই মুদ্রা খলীফা আল মনসুর এর প্রবর্তিত মুদ্রার অনুরূপ ছিল।

১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খুলে দেয়ার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে এদেশে আসতে থাকে। তারও আগে বাংলা অঞ্চল থেকে জাহাজের লস্কর/ নাবিক এরা ও লন্ডনে আসতে থাকে। ব্যাপক হারে মুসলমান আসতে থাকে ১৯৬০ থেকে পাকিস্তান, সিলেট, ভারতের কাশ্মীর, আফ্রিকার তানসানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। কিন্তু তখনও বৃটেনে কোন মসজিদ নির্মাণের হদিস পাওয়া যায় না।

১৮৮৯ সালে একজন প্রাচ্যবিদ দক্ষিণ যুক্তরাজ্যের ওকিং শহরে একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। লিটনার নামের এই প্রাচ্যবিদ হাঙ্গেরী বংশোদ্ভুত। তিনি oriental কালচার ও ভাষা শিক্ষার জন্য ভারতে যান। তিনি তৎকালীন লাহোরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। বিলাত ফিরে এসে এই লোক ইসলাম প্রচার, প্রসার ও শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালান। এর পদক্ষেপ হিসেবে ওকিং শহরে ‘শাজাহান মসজিদ’ নামে প্রাচ্য স্থপতির এক সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন। এটাই নামাজের উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম মসজিদ যুক্তরাজ্যে। অনেকে এটাকে বাদশাহ শাজাহানের নামের সাথে সম্পর্কিত করতে চান যা তথ্যবিহীন। বাস্তব তথ্য হচ্ছে এই লিটনার সাহেব ভারত অবস্থানকালে মধ্যপ্রদেশের ভূপালের নবাব পরিবারের সাথে নিকটাত্মীয় হয়ে ওঠেন। নবাব পরিবারের বেগম শাজাহান নবাব এর অর্থে এই মসজিদ নির্মিত হয়। এটা বর্তমানে বিশাল এক কমপ্লেক্স, স্টাফদের বাসা, গাড়ি পার্কিং, মুর্দা গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা, কয়েক শিফটে কোরান শিক্ষার মক্তব, অন্যান্য ইসলামিক অনুষ্ঠানের জন্য হলরুম, সুন্দর প্রাকৃতিক বাগান রয়েছে। আমার হিসাবে (নামাজের কার্পেট জায়নামাজের হিসেবে) হাজার দুয়েক মানুষ নামাজ পড়তে পারে। একই সময়ে একজন আইরিশ পাদরী কুইলিয়াম ইসলাম গ্রহণ করে লিভার পুলে একটি বড় ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কুইলিয়াম ফাউন্ডেশন নামে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। বিলাতে ইসলামের প্রাথমিক প্রচার কুইলিয়াম- পরবর্তীতে কুইলিয়াম আবদুল্লার অবদান প্রচুর।

১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যে ৭টি মসজিদ ছিল, বর্তমানে প্রায় ২০০০ এর কাছাকাছি মসজিদ রয়েছে। প্রতি ১৮০০ মুসলিম এর জন্য ১টি মসজিদ রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে মসজিদ যুক্তরাজ্যের এক বাস্তবতা।

২০০১-৯ সময়ে বিলাতে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় দশগুণ বেড়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে পাকিস্তানি, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলিমরাই প্রধান। Faith matters (ফেইথ মেটারস) নামে একটি সংগঠন এর তথ্য মতে বছরে বিলাতে পাঁচ হাজার মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

এই মসজিদগুলোর সাথে একটি কালচারাল সেন্টারও যুক্ত থাকে। তারা বৃটিশ কালচারে বসবাসের জন্য একটি সমন্বয় প্রচেষ্টা করে। তারা কোরান, হেফজ কার্যক্রম চালিয়ে যায় অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। স্কুল কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করে মা-বাবারা নাম লিখায়। আবার অনেকে অন-লাইন কোরান শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। আবার কতকগুলো আবাসিক স্কুলও রয়েছে। যেখানে সকালে কোরান ও বৃটিশ স্কুল সময়ে বৃটিশ কারিকুলামের শিক্ষা হয়।

রাজনৈতিকভাবেও মুসলিমরা বৃটেনে বেশ সম্পৃক্ত লেবার পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টির সাথে। ১৯৯৭ সালে বৃটিশ পার্লামেন্টে মাত্র ১জন এমপি ছিলেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির ১৫ জন ও কনজারভেটিভ পার্টির ৪ জনসহ ১৯ জন এমপি ছিলেন। অনেক সরকারি অফিসে নামাজের জায়গা থাকে। শুক্রবারে ‘অঘোষিত’ জুমার নামাজেও যেতে দেয়া হয় ১ ঘণ্টার জন্য। পরে এক ঘণ্টা বেশি কাজ করতে হয়। হালাল খাদ্য ও বৃটিশ সমাজের বাস্তবতা।

বিলাতের দশটি মসজিদ স্থাপত্যের নান্দনিকতায় বিশ্বস্থাপত্যে স্বীকৃত। তার মধ্যে শেফিল্ড, বার্মিংহামের মসজিদ অন্যতম। এই মসজিদগুলোর মধ্যে SOLAR POWER প্র্যাকটিস করা হয়। অধিকাংশ মসজিদে জুমার দিনে একজন ইসলামিক পণ্ডিত (scolar) খুতবা দেয়, অন্যজন নামাজ পড়ান। এদের জুমার খুতবাগুলো জীবন সম্পৃক্ত, জ্ঞানগর্ভ।

আধুনিকতার সাথে ধর্মের গঠনমূলক সম্মিলন ও অগ্রযাত্রার এক নিদর্শন বিলাতের ইসলামিক জীবন। আমরা যারা স্বদেশে থাকি তাদের জন্যও এটা শিক্ষণীয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্ষমতার রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সমাজ মানস
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে আগুনে পুড়ে গেছে পাঁচটি বসতঘর