ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৮ জুন, ২০২২ at ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ

পলাশীর ষড়যন্ত্র

জানা অজানা পৃথিবীর বড় বড় যুদ্ধের তুলনায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা অত্যন্ত নগণ্য। কী সৈন্য-সামন্তের দিকে, না দীর্ঘ স্থায়িত্বের দিকে। এই যুদ্ধ তৎসময়ের ইউরোপীয় যুদ্ধগুলোর সাথে ম্যাচ করে না। আসলে পলাশীতে দু-তিন ঘণ্টা যুদ্ধ হয়েছিল মাত্র। ইংরেজরা ২২ জন নিহত ও শ খানেক আহত হয়। নবাবের পক্ষে মির মদন সহ ৩২ জন নিহত ’শ তিনেক আহত হয়। এই হিসাবে এটাকে যুদ্ধও বলা যায় না। তথাপি বাংলার ইতিহাসে আর কোনো ঘটনা নিয়ে এত চর্চা হয়নি।

ইতিহাস লিখিত হয় বিজয়ীদের দ্বারা। কাজেই ইতিহাস সবসময় নির্মোহ হয় না। বস্তুনিষ্ঠ তো নয়ই। যেমন ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের ইতিহাসে পলাশীর থেকেও ভয়াবহ ঘটনা কারণ সেটা ছিল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ একটি হিন্দু-মুসলিম যৌথ প্রকাশ্য বিদ্রোহ। ব্রিটিশ মারা গিয়েছিল ২৩৯২ জন। ভারতীয় মারা গিয়েছিল আট লক্ষ। ব্রিটিশরা দিল্লিতে মাসব্যাপী এলোপাতাড়ি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রথম যে ব্রিটিশ দল জাহাজে ফেরত গিয়েছিল তাদেরকে জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করে ইংলিশ চ্যানেলের পাড়ে ডোভার শহরে জাহাজ ঘাটায় এক স্মৃতিসৌধ আছে এখনো। আমাদের জন্য যেখানে বিষাদ, বিজয়ী ব্রিটিশদের জন্য সেখানে আনন্দ ও গর্ব। এটাই বিজয়ীদের ইতিহাস লিখন।

১৭৫৭ থেকে প্রায় দেড়শ বছর সিরাজদৌলাকে নিয়ে কোনো লেখালেখি কেউ করত না। ব্রিটিশরা সিরাজকে অর্বাচীন, অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। নবাবী আমলে অরাজকতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ইত্যাদি ব্রিটিশরা লিখে গিয়েছে। অতএব তারা ভারতীয়দের জন্য ত্রাণকর্তা, আর হিন্দুরা মুসলিম নবাব থেকে রেহাই পায়। এভাবেই বৃটিশরা ইতিহাস লিখেছে।

কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দুইজন নাট্যকার অক্ষয় কুমার মৈত্র ১৮৯৮ সালে ও শচীন সেনগুপ্ত ১৯৩৮ সালে সিরাজদৌলা নাটক লিখে পলাশীর প্রকৃত ঘটনা বাঙালিদেরকে জানান দেন। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিলাতের India office record, ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভ এর নথিপত্র গবেষণা করে অনেকেই নবাবী আমলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্রের প্রমাণপত্র নিয়ে বই লিখেছেন। এসব তথ্য ব্রিটিশদের প্রচারিত তথ্যের বহুলাংশে বিপরীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী, নিখিল নাথ রায় প্রমুখ তথ্যভিত্তিক বহু বই লিখেছেন। সুশীল রায় চৌধুরী পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ না বলে ষড়যন্ত্র বলেছেন আগাগোড়া। নবাবী আমলে বাংলার অর্থনীতি ছিল পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী অর্থনীতি। অতিসমপ্রতি ভারতীয় রাজনীতিবিদ শশী তারুর অঙফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে বিশ্ব বাণিজ্যে নবাবী বাংলা মুলুকের অংশ ছিল ৩০%। বাংলায় আমদানি ও রপ্তানি হতো বেশি।

বাংলায় ব্যবসার জন্য পর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ, আর্মেনীয়সহ তাবৎ বিশ্বের ব্যবসায়ীরা আসতেন। ফরাসী ইতিহাস বিদগণ বাংলাকে ‘জিন্নত উল বিলাদ’ বা প্রদেশগুলোর স্বর্গ বলে উল্লেখ করেছেন। মোগল আমলের শেষ দিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব, অরাজকতা দেখা দিলেও বাংলার নবাবরা একটা স্থিতিশীল ও বাণিজ্য বান্ধব পরিবেশ বজায় রেখেছিল। প্রজারাও খুশি ছিল। মোগলদের দুর্দিনে কেবল বাংলা থেকেই বিপুল রাজস্ব যেত। অন্য প্রদেশগুলো ঘাটতিতেই ছিল। তাই মোগল ফরমানের সবগুলোতেই বাংলাকে ‘জাতীয় স্বর্গ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ফরাসি ভ্রমণকারী বার্নিয়ে নবাবী বাংলা দেখে বিস্মিত হয়েছিল যে একটি দেশে এত প্রাচুর্য থাকতে পারে। বলা যায় বস্ত্রশিল্পে গোটা বিশ্বের সাপ্লাই হাউজ ছিল বাংলা। বার্নিয়ে লিখেছেন, বাংলা এতই সম্পদশালী যে এতে ঢোকার দরজা অসংখ্য বের হওয়ার দরজা একটাও নেই।

নবাব চরিত্রের নেতিবাচক দিক উল্লেখ ও প্রচার করা ব্রিটিশদের জন্য জরুরি ছিল। যাতে নিজেদেরকে ত্রাণকর্তা রূপে দেখানো যায়। এজন্য তারা ভাড়াটে লোকদের এ কাজে লাগায়। এসব ইতিহাস অধিকাংশই লেখা শুরু হয় নবাবের মৃত্যুর অন্তত বিশ-পঁচিশ বছর পর যখন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীরই মৃত্যু ঘটে। যেভাবে হলওয়েল ঘটনা সাজিয়েছিল ব্রিটিশরা।

গোলাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি ‘রিয়াজউস সালাতিন’ নামে নবাব কাহিনি রচনা করেন ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় যা প্রকাশিত হয় ১৭৮৬ সালে অর্থাৎ পলাশীর ঘটনার ২৯ বছর পরে। গোলাম হোসেনকে নবাব সিরাজদৌলা পাটনাতে নির্বাসন দণ্ড দেন গুপ্তচরবৃত্তির জন্য। নবাব কাহিনি কী রকম হতে পারে তা অনুমেয়।
ব্রিটিশদের সিরাজ বিদ্বেষের প্রধান কারণ তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে সিরাজ বাধা দিয়েছিলেন। যে ফরমানের বলে ব্রিটিশরা বাংলায় বাণিজ্য করত তারা তা অহরহ লংঘন করত। আলীবর্দী মৃত্যুর সময় তাদের বেপরোয়া বাণিজ্য দমন করার জন্য ভাবি নবাব সিরাজদৌলাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার ছিল লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া বোর্ড অফ ডাইরেক্টর থেকে ফরমান লংঘন করে বাণিজ্য করার কোনো নির্দেশ কখনো ছিল না। বাংলার ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তারা নিজেদের বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করার জন্য কিছু দেশি দালাল বা ব্রোকার রাখত। এরা টাকার বিনিময়ে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করত। বিদেশি লবণ বিক্রির জন্য দেশি লবণের জাহাজ সাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ব্রিটিশ দালালরা বাংলায় ঘটিয়েছিল। পলাশীর ঘটনা ঘটনার জন্য ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রকারী। সবাইকে কত ঘুষ দিবে তা লিখিত আকারে দুই পক্ষ সই করে। কিন্তু তার কপিটা ক্লাইভ নিজের কাছেই রেখে দেয়। পরবর্তীতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী সবাইকে বঞ্চিত করা হয়। জগৎশেঠ এর আম ছালা দুই ই যায়। দরিদ্র হতে তার লেগেছিল তিন বছর। ইয়ার লতিফ, মীর কাসিম কিছুই পায় নি। ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় অংশ ছিল বর্ষাকালে বারুদ গোলা তেরপাল দিয়ে না ঢাকা। ব্রিটিশরা তাদের গোলাবারুদ তেরপাল দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। সেনাপতি মীর জাফরের পরামর্শে সমস্ত নবাবী রসদ তেরপাল ঢাকা বিহীন ছিল। সমস্ত বারুদ অকার্যকর হয়ে যায় বৃষ্টিতে ভিজে। তারপরও নবাব সৈন্যদের আক্রমণে ব্রিটিশরা পালাতে থাকে। সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যুতে নবাবের মাথা বিগড়ে যায়। মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইলেও হতবিহ্বল নবাব মীরজাফর এর উপর সব ছেড়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে পলাশীর পরাজয়। এটা যুদ্ধ ছিল না। ছিল ‘ব্রিটিশদের নীতির ষড়যন্ত্র।

মুসলিম নবাব থেকে হিন্দুরা রেহাই পেতে চেয়েছিল এ ধরনের প্রচারণাও ব্রিটিশরা করেছে। যার বাস্তব কোনো প্রমাণ মিলে না। নবাবী আমলে অর্থাৎ পলাশীর অনেক পূর্বে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে সিরাজ অবধি বাংলায় কোনো হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ বা বিভাজনের নজির পাওয়া যায় না। জগৎশেঠ নবাবের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে কখনো অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের এক নম্বর ধনী হতে পারতেন না। ঘটনা হচ্ছে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে অভিজাত ব্যবসায়ী যাদের অধিকাংশই হিন্দু তাদেরকেই ব্রিটিশরা ঘুষ এর টোপ দিয়ে দলে ভেড়ায়। মূলত এই অভিজাত ব্যবসায়ীরাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এখানে বৃহত্তর বাংলার সমাজে ধর্মীয় বিভাজন এর কোনো প্রমাণ কোনো ঐতিহাসিকই দেননি।

রাজবল্লভকে মুর্শিদাবাদের নবাবরা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে রেখেছেন বরাবর। তিনি জগৎশেঠ এর সাথে মিলে অতিরিক্ত ব্যবসা করতেন ব্রিটিশ কর্মচারীদের সাথে। এটাই নবাব পছন্দ করতেন না। রাজবল্লভের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ লৌহজং এর বেজগাঁও গ্রামে। তার পুত্র কৃষ্ণ দাস দক্ষিণ বঙ্গ থেকে রাজস্ব আদায় করে তা নবাবকে জমা না দিয়ে সে ফোর্ট উইলিয়ামে লুকিয়ে থাকে। একারণেই নবাব কলকাতায় এই দুর্গ আক্রমণ করে। তখন থেকেই ব্রিটিশদের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাতের শুরু। মীর কাসিম নবাব হলে রাজবল্লভ সহ অভিজাত ব্যবসায়ীরা আবার ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এজন্য মীর কাসিম ১৭৬৩ সালে রাজবল্লভ, পুত্র কৃষ্ণ দাস, জগতশেঠ, মাহাতাব চাঁদ, স্বরূপ চাঁদ, গনকে মুঙ্গের দুর্গ থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনাকেই ব্রিটিশরা ধর্মীয় আবরণ দিয়ে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু এটা কয়েকজন বেপরোয়া এলিটের সাথে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। আমজনতার ধর্মের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।

একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে পলাশীর গ্রামে সৈন্য বাদ দিয়ে বাসিন্দারা যদি কাঠের লাঠি নিয়েও ব্রিটিশদের আক্রমণ করত তাহলেও দেশিয়দের জয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু পলাশীতে যুদ্ধই তো হয়নি। হয়েছে ষড়যন্ত্রের যুদ্ধ। ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ব্রিটিশ ও ‘ঘুষ টোপ’। যার সহজ শিকার হয়েছিল এ দেশীয় স্বার্থপর এলিটরা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই
পরবর্তী নিবন্ধনগর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে কর্মশালা