ভিয়েন্টাইন – লাওসের রাজধানী

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

হ রূপা দত্ত | শনিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

অফিসিয়াল ভিসা ছিল বলে থাইল্যান্ড ত্যাগ করার আগে সেখানকার ভিসা ক্যান্সেল করতে হল। এবার থাইল্যন্ড ছাড়লে আর ফিরতে পারবো না। তাই পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে হল খুব হিসেব-নিকেশ করে। স্পাইসি রোডের সদস্যরা থাইল্যান্ডের পর আর দুটো দেশে যাবে লাওস এবং ভিয়েতনাম। আমি লাওস আর প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়ার ভিসা নিয়ে নিলাম। বাংলাদেশী হিসেবে সরাসরি ভিয়েতনামের ভিসা নিতে পারছিলাম না, এজেন্সির মাধ্যমে নিতে হবে। খুব বেশি জটিলতার বিষয় না। কিন্তু, সব এজেন্সি অনেক টাকা ফি চাইছিল। ব্যাংককে দুই এক দিনে বেশ কয়েকটি এজেন্সির সাথে কথা বলার পর ভিয়েতনাম না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাহলে স্পাইসি রোডের সাথে কেবল লাওস-এ ভ্রমণ করতে পারবো। তাই ঠিক করলাম মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে লাওস যাব। এতে মালয়েশিয়াতে ভ্রমণের সময় কমে যাবে যেহেতু ভিসার মেয়াদ আর বেশিদিন নেই।
লাওসের রাজধানী ভিয়েন্টাইনে এসে যখন পৌঁছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। নিনা আর এলিনা আগেই চলে এসেছে হিচহাইকিং করে স্থলপথ দিয়ে। স্পাইসি রোড প্রজেক্ট যার মাথা থেকে বের হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ে ইয়া, সেও এসেছে। মাঝে ইয়া তার দেশে গিয়েছিল পারিবারিক প্রয়োজনে। কোরিয়া থেকে ইয়া এসেছে ব্যাংকক, সেখান থেকে স্পাইসি রোডের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইয়ান্নিক সহ এসেছে ভিয়েন্টাইনে। আমাদের সবাইকে থাকার জায়গা দিয়েছে নই নামের লাওসের এক কাউচসারফার নারী। নই এর বাড়িতে গিয়ে ভালো লাগলো। বেশ খোলামেলা বাড়ি। নই তার পরিবার নিয়ে থাকে একপাশে। আর এক পাশে লিভিং রুম এবং একটা বেড রুম ছেড়ে দিয়েছে আমাদের জন্য। বেডরুমে আবার দুটো দোতালা ব্যাঙ্ক বেড মানে মোট চারটি বিছানা। আমাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা বিছানার ব্যবস্থা হয়েছে। তারপাশেই আছে রান্নাঘর। রান্নাঘরের সকল জিনিস ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। আমাদের সৌভাগ্যতে আমরা যারপর নাই আহ্লাদিত। ইয়া আর ইয়ান্নিক আগের দিন সন্ধ্যায় এসে রাতের ভিয়েন্টাইন দেখে নিয়েছে। ইয়ান্নিক দারুণ ছবি তুলেছে ভিয়েন্টাইনের বিখ্যাত গেইটের। ভিয়েনটাইনে একটা ভাস্কর্যের পার্ক আছে যেখানে পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে বুদ্ধ সহ নানা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু,গুগল করার পর আমি আর সিমেন্টের ভাস্কর্য দেখার আগ্রহ পেলাম না। নই এর বাড়ির একটা সীমাবদ্ধতা হল, কাছাকাছি কোনো দোকানঘাট নেই। ইয়ান্নিক কিছুটা দূরে একটা সুপার স্টোর আছে বলে জানালো। আমরা সেখান থেকে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনলাম। রাতে আর কেউ বের হলাম না। আমার সাথে এই প্রথম স্পাইসি রোডের এক্টিভ সদস্যদের দেখা হল। আর ওরাও অনেকদিন পর সবাই এক হয়েছে। তাই কথা আর গল্প যেন শেষই হচ্ছিল না। তবে আলোচনার মূল বিষয় ছিল লাওসের কাজ নিয়ে।
লাওসে শরণার্থী নিয়ে কাজ করে এমন কোনো সংস্থাকে পাওয়া যায়নি। লাওস হল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দেশ মার্কিন বাহিনীর বোমার আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশেষ করে ভিয়েতনামের সীমান্তের কাছের শহরে বেশি আক্রমণ হয়েছিল। লাওসের নারীরা তখন আহত মানুষদের সেবায় এগিয়ে এসেছিল। সৈন্যদের নার্সিং সেবা এবং খাদ্য সরবরাহে লাওসের নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নারী নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর বেশিরভাগের সাথে দেখা করার অনুমতি পাইনি। ইয়া চেয়েছিল সেখানকার ‘লাও উইমেন ইউনিয়নে’র সাথে কথা বলতে, কিন্তু তারা বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে। এসব গ্যাঁড়াকলে পড়ে আর ওদের সাথে দেখা করা সম্ভব হয়নি। একটা মাত্র এনজিও ‘জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন’ রাজি হয়েছে কথা বলতে। আমাদের হোস্ট ‘নই’ একটা এনজিওতে কাজ করেন। ওনার সাথে লাওসের নারীদের জীবন নিয়ে কথা হচ্ছিল। লাওসের সংবিধানে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। নারীরা পুরুষের মতই সম্পত্তিতে সমান ভাগ পায়। তবে কোনো কোনো আদিবাসী গোষ্ঠী মাতৃতান্ত্রিক, যেখানে পরিবারের ছোট মেয়ে সম্পত্তির মালিকানা পায়। আমাদের দেশের মান্দি (গারো) এবং খাশিয়া আদিবাসীদের মধ্যেও একই সম্পত্তি বণ্টনের নিয়ম দেখা যায়। ১৯৫৮ সালে লাওসের নারীরা ভোটের অধিকার পায়। যদিও ঐতিহ্য অনুসারে এখানে এক সময় নারীদের প্রাধান্য বেশি ছিল, কিন্তু পশ্চিমাদের আগমনের পরে এখানে নারী-পুরুষের বৈষম্য তৈরি হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের অনুসরণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের একজন ম্রো আদিবাসী ভাষা গবেষক ইয়াংজ্ঞান ম্রো বলেছিলেন, ম্রো আদিবাসীদের আবাস নাকি লাওসেও বিস্তৃত। কম পরিচত এই দেশে আছে নদীর নিচে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গুহা। প্রকৃতি দুই হাত দিয়ে যেন ঢেলে দিয়েছে এই দেশকে সাজাতে গিয়ে। কোন জায়গা রেখে কোন জায়গায় ভ্রমণ করব ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। তবে নদীর নিচের গুহাতে যাওয়া যাবে না বৃষ্টির জন্য। নই বলছিলেন, মেয়েরা এখানে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ পদে খুব বেশি নারীকে দেখা যায় না। আবার রাজনীতিতেও নারীদের অংশগ্রহণ খুব কম, বলা ভালো আগ্রহ কম।
ভিয়েন্টাইন শহর বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর এইসব দেশকে মনে হচ্ছে বিরান ভূমি। বেশ অনেকটা দূরে দূরে বাড়িঘর। তবে সামাজিক অবস্থা অনেকটা আমাদের মতো। কার বাড়িতে কে আসছে সবাই সেই খবর রাখে। নই আমাদের বলে দিয়েছিল ঘন ঘন বাইরে যাওয়া-আসা না করতে। প্রতিবেশীরা অভিযোগ করতে পারে।
‘জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন’ যেদিন সময় দিয়েছে সেদিন সবার ভিয়েন্টাইন থাকা সম্ভব হবে না। ভিয়েন্টাইনের পরে আবার যাওয়ার পরিকল্পনা লুয়াং প্রাবাং বলে লাওসের একটি শহরে। এদিকে নিনা আর এলিনা ভিয়েন্টাইন থেকে যাবে ইন্ডিয়া। এবার আর হিচহাইকিং করে যাবে না, সরাসরি ফ্লাইটেই যাবে। ইয়া আর ইয়ান্নিক দু’জনকে বাকি কাজ শেষ করতে হবে। ভিয়েতনামে ইয়ার আঁকা ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবে। রাতে ইয়ার সাথে অনেক গল্প হল দক্ষিণ কোরিয়ার জীবন নিয়ে। সে-গল্প বলবো পরের সপ্তাহে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুদের মাঝে লায়ন্স ক্লাব চিটাগং লিজেন্ডের খাবার বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধএকান্ত সম্পর্ক নিয়ে দু’চার কথা