একান্ত সম্পর্ক নিয়ে দু’চার কথা

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

সম্পর্ক যেন ছায়ার মত। অন্ধকারে পাশে থাকে, সূর্যের তীব্র আলোতে নিজেতে বিলীন হয়। যে-সকল মানুষেরা খুব যুক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করে অভ্যস্ত তারাও সম্পর্কের জালে আটকে অবিবেচকের মতো কাজ করে ফেলেন। ন্যায়-অন্যায় বোধের ঊর্ধ্বে গিয়ে হয়তো সম্পর্কের জেরে জিতে যায় অনেককিছুই। তবুও সম্পর্কের একটা রেশ থাকে, থাকে মলিন ছায়া, সাথে না বলা অনেক কথা।
সম্পর্ক কি কেবল বন্ধুর সাথে? না হয় স্বামী বা মা-বাবা? সম্পর্কের অনেক নাম থাকে সাথে সংজ্ঞা। কিন্তু প্রত্যেক সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ খুঁজে ফিরেন সততা, ভালোবাসা। তবুও অসময়ে যাদের আগমন তারা নিছক কালো দাগও রেখে যায়। সঠিক বোঝার অভাবে দম আটকে মরে যায়।
আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির হাত ধরে যদি বলি, নারীর সম্পর্ক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় স্বামী-সম্পর্ককে। এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে অভিভাবকত্বের ধারণাও। এ স্বামীশ্রেণি নির্বাচনে বেশিরভাগ সময় গুরুত্ব পায় নানান কিছু কিন্তু বেশিরভাগ নারী ভুলে যায় স্বামী যদি পরম বন্ধু বা একজন ভালো মানুষ না হন আর যাই হোক কথা বলে শান্তি নেই। এক্ষেত্রে বলছি না, বন্ধু হতেই হয় বা হবে কিন্তু বন্ধুর মত হলে বিষয়টা দারুণ হয়।
লেখার মূল সঞ্চার কিন্তু স্বামীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে নয়, একজন নারী বিবাহ নামক পরম বন্ধনে আবদ্ধ হলে যেন এক আচ্ছাদনে গুলিয়ে ওঠেন। অবশ্যই সম্পর্কের রস বাকি অনেক কিছুর চেয়ে তীব্র কিন্তু নিজের একক সত্তাকে হারিয়ে বসেন তখনই প্রশ্ন জাগে অন্তরালে। এ-নিয়ে খোলাশা বলাবলি অনেকের পছন্দের নয়।
তবুও লিখে যেতে হয়। বিয়েতে দেখা যায় স্বামী ঠিকই অফিসে যান, আদালত করেন, মনের শান্তির জন্যে আড্ডা দেন অথবা কখনো ঘুরে আসেন। কিন্তু বেশিরভাগ বাংলার রমণীরা ঘরে বসে অপেক্ষা করে, রান্না ও বাচ্চা সামলান। তবে কেন নিজের কোনো আড্ডা নেই, নেই কোনো বন্ধুমহল বা আপনজন। যেখানে হেসে খেলে মন প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়বে। জানি, এসব আলাপ বেশ পুরোনো। এখন চাকরি করে ঘর সামলে নিশ্চয় এসবে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ হয় না। কিন্তু দিনশেষে সমস্ত কাজের চাপ আর ক্লান্তি নিয়ে যখন দেখেন হাতজোড়া শুন্য তবে আফসোস করবেন না। একান্ত সম্পর্কের জালে নিজেকে হারিয়ে বসেছেন সে-কবে।
বেশিরভাগ পুরুষেরা মনে করেন, স্ত্রীর কাজ বাসায়, বাইরের কি! আড্ডা? নাকি পরকীয়া। আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বড় বড় ড্রাগনেরা কেবল মাথা উঁচিয়ে নিজেদের দেখতে পছন্দ করে। নিজের সত্তাকে বিবর্তনে বিলিন হতে দেয়নি। বরং চেপে ধরেছে প্রিয়ার হাত। ঘরের-বাইরের সকল দায়িত্ব দিয়ে নিজের আনন্দ উপভোগ করে নিচ্ছেন।
কবিতা-গল্প বা সাহিত্যের যে-কোনো জায়গায় পুরুষের হাত চমৎকার নাকি সে আসরে নারীদের আগমন সবসময় রোধ ছিলো বলেই নিজের বনের রাজা নিজেরা সেজেছে তারা। মনে পড়ে অনেক গল্পে, সাহিত্যিকদের আড্ডা নিয়ে বেশ জমজমাট কাহিনী আমরা পড়ি। কখনো কেন প্রশ্ন জাগে না নারীদের এমন আড্ডা হয় না কেন? গরম চায়ের চুমুক দিয়ে অট্ট হেসে রাস্তা কাঁপানো যায় না কেন?
যতদূর চোখ যায়, ঐ আমাদের গাঁ। হ্যাঁ, গ্রামের চুলা সারাদিন কেন জ্বলে বলে আফসোস থাকলেও সেখানেও নারীরা মনের সুখে পাড়া প্রতিবেশীর সাথে খোসগল্প করেন। মেতে উঠেন রোজ সকাল-বিকাল পুকুর পাড়ে অথবা বাড়ির উঠোনে। কিন্তু দালানের চাপে আমরা কেবল একান্ত খুঁজে মরি।
একসাথে স্বামী-স্ত্রী সকাল থেকে রাত অব্দি খেটে মরে। বন্ধের দিনে স্বামী সন্ধ্যা নামতে হারিয়ে যান বন্ধু মহলে। এ-কি খারাপ কিছু? অন্যায়? না বরং নারীরও উচিত নিজের চিত্ত সদা উচ্ছ্বসিত করে মনের শান্তির খোঁজে হারিয়ে যাওয়া। এ-হারানোতে ক্ষতি নেই, এ-হারানোতে যে ফেরত পাওয়া যায় নিজেকে।

সম্পর্কের অনেক রঙ। আজকাল প্রেমের সম্পর্কও যেন ঘর-দুয়ারের নিত্য কাজের মতো হয়ে গিয়েছে। প্রেমিকের সাথেই কেবল সময় কাটানো, প্রেমিকের ভালোমন্দকে নিজের করে নেওয়া অথবা খোদ প্রেমিকের বন্ধুমহলকে নিজের ভাবা। এসবে কি একবারও ভাবনা আসে? না। কোাথায় আমি? নিজের একটা পরিচয়, নিজের ইচ্ছা সব যেন কম্বল জড়িয়ে ওম পোহায়। ফলে সম্পর্কের কালো দিন এলে, জনে-জনে গিয়েও বন্ধু না পেলে? অথবা যাদেরকে নিজের বন্ধু ভেবেছিলেন তারা যদি কেবল প্রেমিক বা স্বামীর বন্ধু হয়ে অবতারণ করে? নন্দ ঘোষকে না দোষে, অন্তত নিজের দিকে দেখুন।
সম্পর্কে পারস্পরিক বন্ধুত্ব থাকা অবশ্যই উত্তম কিন্তু একটুখানি শূন্য স্থান যেখান কেবল আপনি, সেটি খোঁজার দায়ও নিজেরই। কেননা যে-সকল একান্ত সম্পর্ককে আপন ভেবে নিয়েছেন, নিজের শূন্যস্থানে এনে বসিয়েছেন সেটি আর ফাঁকা হচ্ছে না। বরং সম্পর্কের অধিকারবোধ থেকে সে জায়গা প্রস্থান না করতে চাওয়াই স্বাভাবিক।
বিয়ের আগে যে প্রেমিককে দারুণ লাগতো অথবা চঞ্চল প্রেমিকার প্রেমে পড়ার কারণ হারিয়ে যায়। আসলে প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিকা যেভাবে নিজেকে ভালোবাসতো বিয়ের পরে আর সেভাবে নিজেকে ভালোবাসেনি। নিজেকে যেজন ভালোবাসে না, সে কীভাবে ভালোবাসা বিলায়। ফলে মধুর সম্পর্কও হয়ে যায় সাপের বিষের মত কদাকার।
এত ভালো থাকা, নিজেকে ভালোবাসা কেবল কি টেক্কা? মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলে চোখে পড়ে, বেশিরভাগ মানুষই বৈবাহিক বা যেকোনো সম্পর্কে খুশী নেই, মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। অনেকের কাছে যেন জেলখানা। আদতে দীর্ঘদিন নিজের মনের কথা বাষ্পের মত উবে গিয়ে বিলীন হয়েছে ফলে চাপা পড়ে গেছে অনেককিছু। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যেও চাই প্রাণ খুলে হাসা, প্রাণের প্রিয় বন্ধুদের আবারও খুঁজে ফেরা।
একান্ত সম্পর্ক আপনজনের সাথে গড়ে উঠে, খুবই নিত্য বিষয়। কিন্তু সে একান্ত সম্পর্কে যখন কেবল পক্ষপাতিত্ব বা কারণ ছাড়াই হারিয়ে যান তখন নিজেকে খুঁজে নিতে হয়। না হয় যে একান্ত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমরা বিলিন করে দিই প্রিয় প্রিয়াদের, তাদের সাথে বিলিন হয় আগলে রাখা সম্পর্কও। সুস্থ সম্পর্কে , নিজের মানসিক শান্তিতে নিজেকে সময় দিন। নিজেকে ভালোবাসলে, ভালোবাসা যায় মা’কেও। তবুও রবিঠাকুরের সুরে যেন বলে উঠি,
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো,উজ্জ্বল করো
সুন্দর কর হে।
……
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।

নন্দিত করো, নন্দিত করো
নন্দিত করো হে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিয়েন্টাইন – লাওসের রাজধানী
পরবর্তী নিবন্ধআজারবাইজানের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৩৫ আর্মেনীয় সৈন্য নিহত