ভিন বসতের যাত্রা

বিপুল বড়ুয়া | বুধবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

ঝিমধরা রাত। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এ সময়টাতে হাড় নাড়া দেয়া শীতবাতাস। টিম টিম করে জ্বলছে কুসুমপুর স্টেশনের বারান্দার দক্ষিণ কোণে সেই কবেকার পুরোনো ল্যাম্পবাতি। বাতাসে অল্প অল্প দুলছেও। নিস্তব্ধ-নিশুতি এই রাত-প্রহরে ভৌতক-কালোছায়া। কুসুমপুরের কেউ কি জেগে আছে? এই হাড়-কাঁপানো শীতরাতে? নিশ্চয়ই না। তবে কি শুধু রঞ্জু জেগে আছে?

নিজের অস্তিত্বে ফিরে আসতে আসতে চমকে যায় রঞ্জু। ডানে-বায়ে-চারদিকে সন্তর্পণে তাকায় রঞ্জু। কোথাও কিছু দেখা যায় না ভারী কুয়াশার পর্দা যেন চেপে বসে বিরান-অন্ধকারে। ল্যাম্পবাতির ম্লান আলোয় কয়েকটা ছায়ামূর্তির অস্পষ্ট নড়াচড়া চোখে পড়ে রঞ্জুর। তাইতো মনে পড়ে রঞ্জুর কুসুমপুর স্টেশনে কয়েকজন রাজাকারের চৌকি বসিয়েছে হানাদার পাকবাহিনীর দোসর তালেব আলী চেয়ারম্যান। ভীতু’র ডিমগুলোর কথা ভেবে হাসি পায় রঞ্জুর। কুমুপুরের রাত শুধু বাড়ছে।

গতকালের ক্যাম্প ব্রিফিং এর কথা একে একে মনে পড়ে যায় রঞ্জুর। তাদের ক্যাম্প কমান্ডার হায়দার ভাইয়ের এক কথা হানাদার বাহিনীকে যেমন করে হোক কুসুমপুরের এদিকে ঠেকাতেই হবে। তাদের কোন অবস্থাতেই গগনবাড়ি, সাতখোলা পেরিয়ে মহিমগঞ্জে অবস্থান নিতে দেয়া যাবে না। কেননা এই মহিমাগঞ্জ এখন সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার। মুক্ত-স্বাধীন-জনপদ। মহিমগঞ্জের ঘরে ঘরে আজ সগর্বে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। পথে প্রান্তরে আজ জয় বাংলা ধ্বনির প্রতিধ্বনি। হায়দর ভাইয়ের নির্দেশ কুসুমপুর স্টেশনের দক্ষিণের কালভার্টকে যেমন করে হোক উড়িয়ে দিতে হবে। বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে এই রেল যোগাযোগ। ক্যাম্পে গতকাল খবর এসেছে আজ রাত আড়াইটায় থার্টি এইট আপ ট্রেন সৈন্য-রসদ-গোলাবারুদ বোঝাই করে এ পথে এগুবে মহিমগঞ্জের দখল নিতে।

অনেকেই চেয়েছিলো মাইন দিয়ে এ কালভার্টটা উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হায়দার ভাই রঞ্জুর হাতেই এ দায়িত্ব দেন। আট নম্বর সেক্টরের অনেক সফল অপারেশনের সফল নায়ক রঞ্জু আজ এক চরম পরীক্ষার মুখোমুখি। রঞ্জুকে এবারও জিতে আসতেই হবে।

তারপর সেই আঁধার নামতে না নামতেই ক্যাম্প হতে দীর্ঘ সাত মাইল পথ পেরিয়ে এই কুসুমপুর বসুহাট এসে ঘাপটি মেরে থাকা ওরা চারজন। প্রায় জনশূন্য বসুহাটে ঘণ্টা দুয়েক উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে সঙ্গী সহযোদ্ধাদের হাটের পশ্চিমে আফাজ মুন্সীর কলঘরের বারান্দায় রেখে তবে এই কুসুমপুর স্টেশনের দিকে সরে আসা রঞ্জুর।

হাতের ময়লা ঝোলাটা আলতো হাতড়ে গোল মতো মাইনগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করে আশ্বস্ত হয়ে নিজের আত্মবিশ্বাসকে আরো দৃঢ়ভাবে ফিরে পায় রঞ্জু। স্টেশনের ম্লান আলোয় আবছায়া ক’টা ছায়ার নড়াচড়া দেখে হাসি পায় রঞ্জুর। তালেব আলীর মেনিমুখো রাজাকাররা। ওরা স্টেশনে আঁকড়ে পড়ে আছে। জংধরা কটি আধপুরোনো রাইফেল আর লক্ষ্যহীন অস্থিরতা নিয়ে ওরা কিসের যুদ্ধ করবে পোড়-খাওয়া উৎসর্গীত প্রাণ মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। দুঃখ হয় রঞ্জুর। কতো সহজে প্রান্ত পথ ধরে কতগুলো মানুষ আজ পরিস্থিতির শিকার হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

এক সময় সব জড়তা-অনুকম্পা ঝেড়ে-ঝুড়ে তৈরি হয়ে নেয় রঞ্জু। রাত একটা। কুসুমপুর স্টেশনের পয়েন্ট সময় রাত একটার ঘণ্টি পেটালো। নিঃশব্দে বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় রঞ্জু। গায়ের ভারী জামা কুয়াশাভেজা সপ্‌সপ্‌ে। ঠান্ডা হিমেল বাতাসের ঝাপটা। ভিজিয়ে দিচ্ছে রঞ্জুর চোখমুখ। শব্দ বাঁচিয়ে ধান ক্ষেতের সাথে নুইয়ে এই এতটুকু পথ আসতে মনে হলো রঞ্জুর কতো দীর্ঘ সময় লেগে গেল। তারপর সেই ত্রস্ততা। ঝট্‌পট্‌ দুটো দুটো মাইন কালভার্টের দুপাশে বসিয়ে লম্বা ফিউজ তার খুলে নিয়ে বসে পড়ে রঞ্জু। এক অধীর অপেক্ষায়।

এক ভিন্নতর উত্তেজনা কাঁপন ধরিয়ে দেয় রঞ্জুর দেহের প্রতিটি কণা-কোষে। তার রেশ খুব প্রচ্ছন্ন অথচ বলিষ্ঠভাবে ছড়িয়ে পড়ে রঞ্জুর শরীরে, তন্ত্রীতে-তন্ত্রীতে। হানাদার বাহিনীর এক ভয়ংকর সর্বনাশ দেখার দুর্দমনীয় বাসনা রঞ্জুকে যেন দুঃসাহসী করে তোলে। এই জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি এক সময় অনেক কিছু মনে পড়ে রঞ্জুর।

মাকে মনে পড়ে রঞ্জুর। মনে পড়ে মিনু-রুশনীকে মনে পড়ে তাদের গাঁ-বৈরী বসতকে। উনত্রিশে সেপ্টেম্বরের সেই রাতকে মাকে সেবারের মতো দেখে আসার সুখ-কষ্ট এখনো যেনো অবিকল মনে পড়ে রঞ্জুর। তারপর এই নৌকাজীবন। আটপৌড়ে অথচ গৌরবময় মুক্তিযোদ্ধার জীবনযাপন। সেই সুদিনের পানে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকা। কবে দেশ স্বাধীন হবে ঘরে ফিরে যাবে রঞ্জু। কখন তাদের এক চিলতে উঠোনে দাঁড়িয়ে স্টেনের এক ম্যাগজিন গুলি শূন্যে ছুড়ে দিক চক্রবাল দীর্ণ-বিদীর্ণ করে স্লোগান দেবে-জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয়…।

হঠাৎ গুম গুম শব্দে চমকে যায় রঞ্জু। তাইতো সেনপাড়ার ওদিক হতে প্রকান্ড সার্চ-লাইটের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে কালো অজগরের মতো ছুটে আসছে থার্টি এইট আপ ট্রেন কুসুমপুরের দিকে। বগীর সংখ্যা কম। সব কামরার জানলা আটা। ইঞ্জিন রুমের উজ্জ্বল আলোয় ইউনিফর্ম পরা কজন সৈন্যকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। নাহ্‌ দেখতে ভুল হয়নি রঞ্জুর। কুসুমপুর স্টেশনের সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে বার বার টর্চের আলো ফেলে এডভ্যান্স সিগন্যাল দিচ্ছে রাজাকাররা। আনন্দে অতিশয্যে আত্মহারা হয়ে পড়ে রঞ্জু। পাকবাহিনীর এক ভয়ংকর সর্বনাশের একমাত্র সাক্ষী হওয়ার এক প্রচন্ড ইচ্ছা রঞ্জুকে অদ্ভুদ কর্মশ্রম করে তোলে।
ট্রেন ছুটে আসছে। রেললাইনের ঝট্‌ ঝট্‌ শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। দ্রুত হাত চালায় রঞ্জু। ত্রস্তে একবার চারদিকে দেখে লম্বা ফিউজ তারগুলোকে এক এক করে ম্যাচের কাঠি ছোঁয়াতেই লক্‌ লক্‌ করে আগুনের ছোট্ট শিখা ছুটে যায় এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে…।

এই মুহূর্তে নিরাপদে দূরে সরে যাওয়ার কথা কেন জানি ভুলে যায় রঞ্জু। এক ধরনের প্রচন্ড জেদ রঞ্জুকে পেয়ে বসে সে এর শেষ প্রাণভরে দেখবেই। কিন্তু একি! কিসের সাঁ সাঁ শব্দে চমকে যায় সে। পলকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে রঞ্জু। বড়ো হিসেব করে সতর্কতার সাথে এগুচ্ছে ওরা। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কভারেজ পাওয়ার জন্য ইঞ্জিন রুমের মেসিনগান হতে কালভার্টের দুদিকের জলাভূমিতে ব্রাশ করে যাচ্ছে বৃষ্টির মতো। নিজের বোকামির জন্য এক ভয়ংকর বিপদের গন্ধ পায় রঞ্জু। বসুপুর হাট হতে আসার সময় রায়হান নিজে আসতে চেয়েছিলো তাকে ফিরিয়ে দেয়ার মুহূর্তে আবার হাতে স্টেনগানটা তুলেও দিয়েছিলো-কিন্তু রঞ্জু গা করে আনেনি। কিন্তু এমন অবাক কাণ্ড ঘটে যাবে তা মনেও আসেনি রঞ্জুর।

দ্রুত চিন্তা করে রঞ্জু। ডানে-বাঁয়ে সরে যাওয়ার রাস্তাও নেই এবং নিরাপদও নয়। বৃষ্টির কণার মতো তীক্ষ্ণ-তপ্ত সিসা সু-ই সু-ই, সাঁ-সাঁ করে ডানদিকে বামদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। শেষ চেষ্টা করে রঞ্জু। নাহ্‌ তাকে যেমন করে হোক কালভার্টের নিচের জলা পেরিয়ে আলপথ ছাড়িয়ে ধানক্ষেত পর্যন্ত পিছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। ট্রেনও দ্রুত বাঁক নিচ্ছে কালভার্টের দিকে। হিসেব করে দেখে রঞ্জু ফিউজতারও বোধহয় এতক্ষণে মাইন কটাকে এসে গেছে। চাপা-উত্তেজনার পাশাপাশি এক ধরনের সংশয় রঞ্জুকে আরো দুঃসাহসী করে তোলে। মেসিনগানের কর্কশ শব্দ ও আরো কাছে এসে পড়ছে।

জলার ভেজা কাদামাটির সমান্তরাল অবস্থান হতে দুহাতে ভর রেখে আধশোয়া ভাবে পূর্বদিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে মাথা তুলতেই বাম পাঁজরে তপ্ত লোহার প্রচন্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে রঞ্জু। রঞ্জুর মনে হলো শরীরের বাম দিক বলতে যেন কিছু নেই। অবশ-অবসন্ন। রঞ্জুর ডান হাত সে দিকটা হাতড়ে শুধু ক্ষতবিক্ষত অনেকগুলো ছিদ্রে গিয়ে ঠেকলো। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে বুকের বাঁ দিকটায়। দাঁতে দাঁত চেপেও একচুল নড়তে পারলোনা রঞ্জু। রঞ্জুর চোখের সামনে আধো অন্ধকারের বিশাল আকাশ ছিটকে পড়ার জন্য যেন দুলছে।

এক-দুই-তিন পর্যন্ত গোনা হলো না রঞ্জুর। দুটো দুটো চারটা মাইন কাটার প্রচন্ড শব্দের পাশাপাশি এক বিকট রাত-কাঁপানো প্রলয়ংকরী শব্দ-স্বাক্ষর রেখে কুসুমপুরের কালভার্ট-সৈন্য-রসদ বোঝাই থার্টি এইট আপ ট্রেন একাবর শূন্যে উঠে পরমুহূর্তে সশব্দে কালভার্টের পশ্চিমের জলাভূমিতে দুমড়ে মুচড়ে আছড়ে পড়ে। রঞ্জু দুচোখ ভরে দেখে আগুনের লেলিহান শিখার পাশাপাশি মরণ চিৎকারের আহাজারি।

রঞ্জু সব দেখে। মৃত্যু-যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলকে হেলায় একটি মেরে এক অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা এক প্রচন্ড ধ্বংসের বিরল নির্জন সাক্ষী হয়ে থাকল। কুসুমপুরের হিম ছড়ানো রাত গাছপালা, নিথর নিস্তব্ধতা সবাই গভীর শ্রদ্ধায় যেন নুইয়ে আসে রঞ্জুর আত্মত্যাগের কাছে।

নিঃশ্বাস আটকে আসে রঞ্জুর। আর পারে না সে। দৃষ্টিছায়ায় আবছায়া রেশ ছড়িয়ে পড়ে। মারমুখের আদল আবছায়া মনে করে হাত বাড়ায় রঞ্জু। না-মা তো নয়। ভুল ভেঙে যায় রঞ্জুর। অনেক কষ্টে মুঠি তুলে আনতেই এক মুঠো অগোছালো জলামাটি উঠে আসে শুধু। মাটির সেই সোঁদা ঘ্রাণ ধান কাউনের মিষ্টি সুবাসের মতো রঞ্জুর চারদিকের বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয় শুধু।

সেই বহুআস্বাদিত রোমাঞ্চকর ঘ্রাণের সাথে পাল্লা দিয়ে কুসুমপুরের রাত ক্রমশ গভীর হতে গভীরতর হয়ে ভোরের দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক তখনি সেই রাত-ভোরের বীর গাঁথার কাব্য-কাহিনির পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জুর এক ভিন বসতের দিকে যাত্রা শুরু হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ বিজয়ের
পরবর্তী নিবন্ধইয়াং সিএন্ডএফ এজেন্টস সোসাইটির সভা