ভাসানচরে কেন যায় না রোহিঙ্গারা

স্থানীয়দের দাবি-এনজিওগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে না আনলে সমস্যার সমাধান হবে না

উখিয়া প্রতিনিধি | সোমবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২০ at ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় কক্সবাজারের স্থানীয়রা ক্রমান্বয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প সংলগ্ন মধুরছড়া এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান, লম্বাশিয়ার আলি হোসেন, বালুখালীর সেলিম জাহাঙ্গীর, রেদোয়ান, থাইংখালীর জামতলীর সাহাব উদ্দিনসহ অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে জানান, তিন বছর ধরে ক্যাম্পের আশপাশে কোনো ধরনের চাষাবাদ, সবজি ক্ষেত, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন-পালন করতে পারছেন না। তারা বলেন, আমরা চতুর্দিকে রোহিঙ্গা বেষ্টিত হয়ে অনেকটা অবরুদ্ধ আছি; আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত চরম নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয়। প্রায় সময় রোহিঙ্গাদের মধ্যে মারামারি, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, খুনের মতো ঘটনা ঘটায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে চরম উৎকণ্ঠিত থাকতে হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশি-বিদেশি এনজিও-র কার্যক্রমের ওপর কঠোরভাবে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ না আনা পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সহজে সমাধান হবে না বলে তারা জানান। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভাসানচরে গেলে রোহিঙ্গা সেবার নামে সুবিধাভোগীদের মোটা অংকের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন ঠিকাদারি ও সাপ্লাই কাজের কমিশন বাণিজ্য, দিনের মধ্যভাগে ক্যাম্পে এসে ঘণ্টা দুয়েক থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোটি টাকার বিলাসী গাড়িতে চড়ে বিকালে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার ও ইনানীর সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ শেষে রাতে কক্সবাজারের তারকা হোটেলগুলোতে আমোদপ্রমোদ করার মহাসুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই তারাই চায় না ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন হোক বা মিয়ানমারে ফেরত যাক।’ তিনি উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সাড়ে ৬ লাখ স্থানীয় মানুষকে রক্ষার আহ্বান জানান। ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, তারা পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে খুব কঠিন মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছিলেন। কিন্তু একশ্রেণীর রোহিঙ্গা ৩ বছরের মধ্যে সবকিছু বেমালুম ভুলে আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের ভূমিতে সবকিছুর অবাধ সুবিধা পেয়ে একেকজন বীর পালোয়ান হয়ে গেছেন। যেখানে তারা নিজ দেশে থাকাকালে ঘরে ভাল একটা দা বা খুন্তি পর্যন্ত রাখতে পারেনি, আরও এখন অনেকে বেশ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গাদের জুলুম নির্যাতন করছে। উচ্ছৃংখল এ রোহিঙ্গাদের দমনে সাধারণ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। সাধারণ রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভাসানচরে চলে যেতে আগ্রহও দেখান।
ভাসানচর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য : নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু সেখানে তাদের না পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে চাপ আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল ১৮ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ভারতের নবনিযুক্ত হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না পাঠানোর জন্য ইউএনএইচসিআর-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে চাপ রয়েছে। তবে সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা সেখানে গেলে আরো ভালো থাকবেন।
কি সুবিধা ভাসানচরে : থাকার জন্য পাকা দালানঘর, ঘর আলোকিত করতে সৌরবিদ্যুৎ। চুলা জ্বালাতে বায়োগ্যাস। আরো আছে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি মোবাইল নেটওয়ার্কও। সব মিলিয়ে জীবন-ধারণের আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচর।
মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ভাসানচরের বুক জুড়ে গাঢ় সবুজের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে লাল ও সাদা রঙের দালানগুলো। যার আঙিনা জুড়ে এখন নিরব অপেক্ষা। জানালায় নতুন সূর্যের উঁকিঝুঁকি। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে এই ঘরবাড়ি। এর জন্য প্রকল্পটিতে খরচ হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
এক রুমে চারজনের থাকার মতো দোতলা বেড। এমন ১৬টি রুম, নারী-পুরুষের জন্য আলাদা গোছলখানা, টয়লেট ও রান্নাঘর নিয়ে বানানো হয়েছে একেকটি বাড়ি। আর এমন ১২ টি বাড়ি নিয়ে একেকটি পাড়া বা ক্লাস্টার। পুরো প্রকল্পে মোট ১২০ টি ক্লাস্টার। প্রতিটি ক্লাস্টারে একটি করে চারতলা সাইক্লোন সেন্টার। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যেতে পাকা রাস্তাঘাট। রাস্তার পাশেই চোখে পড়ছে অত্যাধুনিক ড্রেনেজ সিস্টেম এবং সারি সারি সৌর বিদ্যুতের খুঁটি।
দুইটি চারতলা ভবন রাখা হয়েছে ২০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালের জন্য। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষায় রাখা হয়েছে দুইটি চার তলা স্কুল। তিনটি চারতলা মসজিদ, দুইটি এতিমখানা ও একটি ডে-কেয়ার সেন্টার। এক লক্ষ রোহিঙ্গার তিন মাসের খাদ্য মজুদ রাখা যাবে এখানে তৈরি চারটি ওয়্যার হাউজে।
একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের অফিস ও বাসস্থানের জন্য। ভিআইপি দর্শনার্থীদের জন্য বানানো হয়েছে একটি নান্দনিক ডুপ্লেক্স ভবন।
প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ১৩ হাজার একর আয়তনের এই বিশাল চরের মাত্র ৭০০ এক জমির চারপাশে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের উপর প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে। আরো ৯৩২ একর ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের জন্য রাখা হয়েছে যেখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকেও স্থানান্তর করা সম্ভব। কক্সবাজারের পাহাড়কে একটু স্বস্তি দিতে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরুর উপরই নির্ভর করছে এই প্রকল্পের সাফল্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিরোপা জিতল কামাল এ খান একাদশ
পরবর্তী নিবন্ধএকটি ফুল কুঁড়িতেই শেষ