ভাষা আন্দোলনের নানান বাঁকে চট্টগ্রাম

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | শনিবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তানের সংবিধানের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা উল্লেখ ছিলো না। বাংলা রাষ্ট্র ভাষা করার স্বীকৃতিও ছিল না। মূলত রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় মূলনীতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। চট্টগ্রামের মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের দিয়ে ‘মূলনীতি বিরোধী সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য লালদিঘি ময়দানে সমাবেশ, গণপরিষদ সদস্যদের বাড়ি ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মীরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এ রকম উদ্যোগের অন্যতম ছিল ১৯৪৯ সালে জেএমসেন হলে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সংবর্ধনা। সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভার সব বক্তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উপর জোর দেন। ১৯৪৮ সালের চট্টগ্রামের ভাষাআন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এতে বাঙালিদের সঙ্গে অনেক অবাঙালিও একযোগে কাজ করত। বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল হলে তাদের অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো।

১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম বিশ্ব শান্তি পরিষদের শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ নামক প্রগতিশীল ঘরানার সংগঠন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আবদুল হক দোভাষ এবং মাহবুবউল আলম চৌধুরী। এই পরিষদ আণবিক বোমা নিষিদ্ধকরণ দাবিতে সাত লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল। চট্টগ্রামের সমস্ত সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররা এই আন্তর্জাতিক স্বাক্ষর অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে এক সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এসব সৃজনশীল কর্মকাণ্ড তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী কর্মসূচির মাধ্যমে ভাষার দাবিকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রত্যয়ে হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মীরা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সুসংগঠিত ও সম্প্রসারিত করার জন্য ১৯৫১ সালের ১৬ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত চারদিনব্যাপী চট্টগ্রামের হরিখোলার বর্তমানে মোমিন রোডে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, প্রধান অতিথি ছিলেন সত্যযুগ সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। সম্মেলনে খ্যাতনামা শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, কবিয়াল রমেশ শীল ও ফণি বড়ুয়ার জনপ্রিয় গান অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। এরপর থেকে গণসঙ্গীত অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে, যা গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জোরদার করার ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছে। এ সম্মেলন থেকে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো ও অন্তত ব্যাপক গণভিত্তিক দাবি সোচ্চার হয়েছিল সর্বপ্রথমে। চট্টগ্রাম সম্মেলনের পথ ধরেই পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুমিল্লা সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ঢাকায় কার্জন হলে সাহিত্য সম্মেলন এবং টাঙ্গাইলের কাগমারীতে সাংস্কৃতিক সম্মেলন। কার্যত চট্টগ্রাম সম্মেলন দিয়েই বাংলাদেশের সংস্কৃতি আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং ভাষা আন্দোলনের পালেও হাওয়া লাগতে শুরু করে তখন থেকে। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণ করার নামে পাকিস্তানি শাসকেরা আরবি হরফে বাংলা লিখার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আরবি হরফে বাংলা প্রচলন করার উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। তিনি ছিলেন বাঙালি। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি চট্টগ্রাম সফরের সময় চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শন করেন। এ সময় চট্টগ্রাম কলেজের কয়েকজন ছাত্র আরবি হরফে বাংলা প্রচলন বিরোধিতা করে একটি বেনামী লিফলেটের প্রচার করলে দু’জন ছাত্রকে কলেজ কর্তৃপক্ষ শাস্তি দিয়েছিলেন।

এর মধ্যে ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। মুখ্যমন্ত্রীর এ ঘোষণায় ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দিয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। চট্টগ্রামে সকল শ্রেণির পেশাজীবী সংগঠন, কৃষক শ্রমিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও তমদ্দুন মজলিসের প্রতিনিধিদের নিয়ে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদগঠন করা হয়।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এবং আরবিহরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচেষ্টার প্রতিবাদে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুসরণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামেও হরতাল, মিছিল এবং বিকালে লালদিঘি ময়দানে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে পুরো চট্টগ্রাম কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সমস্ত দোকানপাট, যানবাহন সরকারি অফিসআদালত ও স্কুলকলেজ বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম শহরের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতালে অংশগ্রহণ করে। সরকারি অপপ্রচার ও পুলিশের হয়রানি উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের হাজার হাজার কর্মী হরতালের সমর্থনে এগিয়ে আসে। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হওয়ার খবর বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের মানুষ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। চট্টগ্রামের কিংবদন্তি আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি মিছিল, আরেকটি মিছিল অধ্যাপক আবুল ফজলের নেতৃত্বে সংস্কৃতি কর্মীরা এবং তৎকালীন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদের নেতৃত্বে একট মিছিল শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিলের পর মিছিল এসে লালদিঘির মাঠে জড়ো হয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফ্‌ফর আহমেদের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। ঐ সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেয়া পর্যন্ত আপোষহীন সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করে। ঐ সময় লালদিঘির মাঠ পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। আশপাশের এলাকাও লোকে লোকারণ্যতে পরিণত হয়েছিল। একুশের রক্তাক্ত ও বিষাদময় ঘটনার অভিঘাতে চট্টগ্রামের টকবগে যুবক মাহবুব উল আলম চৌধুরী সৃষ্টি করলেন একুশের প্রথম কবিতা। ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

অমিত সাহসের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার আন্দরকিল্লার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে কবিতাটি ছাপিয়ে দেন। তবে পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজটি সমাধা করাও এক দুরূহ ব্যাপার ছিলো। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সারারাত গোপনে প্রেসে কাজ করে ভোরে ১৭ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকায় ছাপা হয় ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’।

২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘির ময়দানে কবিতাটি প্রথম জনসম্মুখে আবৃত্তি করেন আরেক ভাষা সৈনিক চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে ময়দানে জড়ো হওয়া জনতা ফেটে পড়ল বিক্ষোভে। মুহূর্মুহূ স্লোগানে কেঁপে উঠল পাক মসনদ। শত সহস্র বুলেটের চাইতেও এই কটি লাইন কত শক্তিশালী তার প্রমাণ মিলল যখন পাক সরকার কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করে। কবিতাটি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বিএ’র বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে দ্রুত গ্রেপ্তারও করা হয়। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ মামলা চলে। দবির আহমদকে ছয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই সংঘটিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন, নতুন আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ। দেশের প্রতিটি আন্দোলনের পরতে পরতে ছিলো চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের অসামান্য অবদান। যা ঋদ্ধ করেছে এতদঅঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষকে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুনির্মল বসু : কবি ও শিশুসাহিত্যিক
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে