ভালো ছেলে

জুয়েল আশরাফ | বুধবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

আরাফাতদের পুকুরটা বেশ পুরানো। বর্ষার পানিতে থৈ থৈ অবস্থা। পুকুরে কচুরিপানা আর শাপলা-শালুকে ভরা। এবার বর্ষার পানির সঙ্গে পুকুরে এসেছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কৈ, মাগুর শোল এমনই অনেক রকমের মাছ। পুকুরে আছে অনেক ব্যাঙ। বৃষ্টি শেষে ওরা যখন একসঙ্গে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ গান জুড়ে দেয়, আরাফাত তখন জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে, বেশ লাগে শুনতে। অনেকদিন হলো সে বাইরে বেরোতে পারে না, মা বেরোতে দেয় না। বিকেল হলেই আর পাঁচটা ছেলেদের মতো সে মাঠে চলে যেতে পারে না ফুটবল পেটাতে কিংবা ডাঙ্‌গুলি খেলতে। এসবে মায়ের বারণ। এখন তার বেশিরভাগ সময় কাটে জানালার ধারে, কখনও পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে চুপটি করে। পদ্মপাতার ওপরে জলপিপিদের খেলা দেখে। পানির থেকে ঠোঁট ঠুকরে পোকা খায় ওরা। কখনও কাঠঠোকরা লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর মারে গাছের গুঁড়িতে, পায়ের কাছ দিয়ে লাফিয়ে চলে যায় কাঠবিড়ালি। ঘাসের ওপর নেচে বেড়ায় ঘাস ফড়িংরা। এরা সবাই আরাফাতের বন্ধু। আরাফাত এদের সবার কথা বুঝতে পারে, আরাফাতের কথাও বুঝতে পারে ওরা। এমন কী মজার ব্যাপার এই যে, মাটিতে পড়ে থাকা পচা পাতার মধ্যে দিয়ে সুড়সুড় করে হেঁটে যাওয়া মোটা মোটা পিঁপড়াগুলো একটাও আরাফাতকে কামড়ায় না। কেঁচোগুলো আপন মনে মাটির বুরবুরি পাকায়, ভেজা শরীর নিয়ে হেলতে-দুলতে চলে যায় এদিক থেকে ওদিক, শামুকগুলো খোলস থেকে শুঁড় বের করে বলে, ‘শুভ অপরাহ্ন’। খুব ভালো লাগে আরাফাতের। কই এরা তো কেউ বলে না আরাফাত বাইরে এসো না, ঘরেই থাকো। এরা ভারি শান্ত, ভারি মোলায়েম। শুধু একটাই দুঃখ এরা কেউ জামাকাপড় পড়ে না। জামাকাপড়ই চেনে না এরা। তাই এরা আরাফাতকেও এসে বলে না তোমার জামাটা খুব সুন্দর। খুব দুঃখ হয় আরাফাতের। আসলে আরাফাতের কোনো এমন বন্ধু নেই তার পোশাকের এবং তার প্রশংসা করবে।
আজকাল ছোটদের কেউ প্রশংসা করতে চায় না। এমনকি তার বাড়ির লোকজনও না। সবাই শুধু ধমকের সুরে শাসন করে। আর বিধি-নিষেধের রুটিন। দাদিও আরাফাতের সঙ্গে ঠিকমত কথা বলে না, মুখ ভার করে শুয়ে থাকে। এমনকি তার বাবা, চাচা, চাচি কেউ তাকে বলে না আরাফাত খুব ভালো ছেলে। বলবে কী করে! তারা ভালো ছেলে জীবনে চোখেই দেখেনি। শুধু তার মনে হয় তার জঙ্গলের বন্ধুরা যদি তাকে একবার ভালো ছেলে বলত!
সেদিন সন্ধ্যায় এরকম ভাবতে ভাবতে সে চলে গেল পুকুরের উল্টো দিকে। পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসল। হঠাৎ যেন তার কাঁধে টোকা দিয়ে পিছন থেকে কে ডাকল, কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এসো’। তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে পরীর মতো এক মেয়ে। আরাফাত চমকে ওঠে।
মেয়েটি কানের এবার খুব কাছে এসে বলল, এসো, এসো না!
আরাফাত ভূতগ্রস্থের মতো চলল মেয়েটির পিছে পিছে। মেয়েটি জঙ্গলের ভেতর একটি গাছের কাছে এসে থামল। গাছের কাছে উঁচু জায়গায় জ্বেলে দিল একটি ছোট্ট মোমবাতি। বলল, ফুঁ দাও। আরাফাত সেটা ফুঁ দিয়ে নেভাতেই মোমবাতিটা নিয়ে গাছের কোটরে রেখে দিল মেয়েটি তারপর ভালো ছেলে, বলে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। আরাফাত দেখল একটা জোনাকি উড়তে উড়তে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে, আর ওই গাছের মাথায় ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি আলোর মালা জ্বেলে বলছে, আরাফাত ভালো ছেলে। ভালো থেকো। যেন আলো হয়ে গেল আরাফাতের চারপাশ, আরাফাতের ভালো থাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাগলো যে প্রাণ
পরবর্তী নিবন্ধপৃথিবীর বিস্ময় জাগানো রংধনু পাহাড়