ভালোবাসার ছোঁয়ায় বসন্ত বরণ

বসন্ত উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ : আজাদী সম্পাদক

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বসন্ত এসেছে। মনে রং, বনে রং। সকলেই যেন রঙের মানুষ। কেউ আসছে, কেউ জেগে উঠছে। কে সে? কার এই জাগরণ? দেহেমনেপুলকেশিহরণেবোধেমননে এই আহ্বানকে স্পর্শ করার যে ইচ্ছা, বাঙালি তারই নাম রেখেছে বসন্ত।

বসন্ত উৎসবের সাথে ভালোবাসা উৎসব যুক্ত হওয়ার কারণে চট্টগ্রামবাসী অকৃত্রিম ভালোবাসায় বসন্তকে বরণ করেছে গতকাল। বসন্ত বরণে ভিড় করেছিল সিআরবি, জামালখান, সিটি কর্পোরেশন প্রাঙ্গণ, পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্ক, শিল্পকলা একাডেমি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায়। খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে, বাসন্তি শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে যে মেয়েটি একলা প্রহর গুণছিল ভালোবাসার, তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই মধুর বসন্তের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে প্রিয়তম পুরুষটি বাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বস্ততার হাত।

শীতের জীর্ণতা সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছিল ঘুমন্ত মন। উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কলকাকলির বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে নগরবাসী বসন্তকে বরণ করে নিয়েছিল আপন রঙে। বসন্ত বরণে আসা বিভিন্ন বয়সীর মধ্যে কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীই ছিল বেশি। কেউ গলায় ঢোল ঝুলিয়ে আর কেউ হাতেমুখে রং মেখে মিলিত হয়েছেন বসন্ত বরণের আনন্দে। সবার মুখে বসন্তের জয়গান।

ফাগুনের প্রথম দিনটি চট্টগ্রামের নগরজীবনে প্রতিবারের মতো এবারও এসেছে উৎসবের রঙ নিয়ে। সেই রঙ ছুঁয়ে গেছে নানা বয়সী মানুষের মধ্যে। নগরীতে বসন্ত উৎসবের প্রতিটি স্থানে ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বসেছিল মানুষের সম্মিলন। বাংলার চিরায়ত গান, নাচ, আবৃত্তি, কথামালাসহ নানা আয়োজনে শুরু থেকেই মুখর উৎসব অঙ্গন।

প্রমা আবৃত্তি সংগঠন : গতকাল সকাল ৮টায় নগরীর সিআরবির শিরীষতলায় মুক্তমঞ্চে ভায়োলিনিস্টস চট্টগ্রামের প্রিয়তোষ বড়ুয়ার বেহালা বাদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের বসন্ত উৎসব। সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসানের একক আবৃত্তি, ওড়িশী নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তীর দলের নাচের মধ্য দিয়ে মূল আয়োজনের দিকে এগিয়ে যায় শিরীষতলার মঞ্চ। সকালের অনুষ্ঠান শেষে শোভাযাত্রা নিয়ে সাত রাস্তার মোড় পর্যন্ত যান প্রমার শিল্পীসদস্যরা।

মাঝে বিরতি দিয়ে ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে বিকেল থেকে আবারও শুরু হয় বসন্ত বরণের আয়োজন। উৎসব উদ্বোধন করতে গিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বক্তব্যের শুরুতে স্মরণ করেন ভাষা শহীদদের, যাঁরা এমনই এক ফাল্গুনে ভাষার মান রাখতে তাজা খুনে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন। তিনি বলেন, একুশ আমার অহংকার, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশে পদকপ্রাপ্তি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বসন্ত উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তার উপর সিআরবির এমন এক মনোরম পরিবেশে বসন্ত বরণের আয়োজন প্রকৃতির সাথে মানুষের মিলনের ক্ষেত্র রচনা করেছে। প্রমা আবৃত্তি সংগঠন এই সুযোগটি করে দিয়েছে আমাদের। প্রতি বছরই প্রমা আমাকে ডাকে উৎসবে শরিক হতে। আমি কৃতজ্ঞ তাই প্রমার সদস্যদের কাছে।

অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মফিজুর রহমান, পেশাজীবী নেতা ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম, হিন্দু বৌদ্ধ ক্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শ্যামল পালিত, সমাজসেবী মো. সাহাবুদ্দিন প্রমুখ।

বোধন আবৃত্তি পরিষদ : গতকাল সকাল থেকে বোধন আবৃত্তি পরিষদের বসন্ত বরণের উৎসব শুরু হয় নগরীর আন্দরকিল্লায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন চত্বরে। আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরীর একক আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানমালা। এরপর রণধীরের বংশীধ্বনির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান।

বিকেল ৩টায় বসন্ত বরণ উপলক্ষে বর্ণিল শোভাযাত্রা আন্দরকিল্লা চত্বর হতে নগরীর বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। এ বছর এই উৎসব ১৮ বছরে পদার্পণ করেছে। সকালের অধিবেশনে কথামালায় অংশ নেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, বেতার ব্যক্তিত্ব ফজল হোসেন, বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি আব্দুল হালিম দোভাষ ও সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী। সন্ধ্যায় কথামালার দ্বিতীয় পর্বে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী প্রেমজিৎ মজুমদার, তনুশ্রী ধর, রুদ্রজিৎ মজুমদার, আরিকা আমান ও শুভশ্রী মেধা। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে বোধন আবৃত্তি স্কুল চট্টগ্রাম। একক সংগীত পরিবেশন করেন সংগীতশিল্পী লাকি দাশ, মহিমা দেব ত্রয়ী, প্রিয়া ভৌমিক ও দেবলীনা চৌধুরী। দলীয় সংগীত পরিবেশন করে প্রত্যয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক একাডেমি পটিয়া। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, আলোড়ন ডান্স একাডেমী, দি স্কুল অফ ক্লাসিকাল অ্যান্ড ফোক ডান্স, কৃত্তিকা নৃত্যালয়, স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল ডান্স, নৃত্যনন্দন ও পায়েল নৃত্যাঙ্গন।

বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম : বোধন আবৃত্তি পরিষদ পাহাড়তলী আমবাগান শেখ রাসেল পার্কে আয়োজন করেছে নিপ্পন পেইন্ট বোধন বসন্ত উৎসব ১৪২৯। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে একুশে পদকপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ওস্তাদ আজিজুল ইসলামের বংশীবাদনের মধ্য দিয়ে প্রভাতী অধিবেশন শুরু হয়। এরপর বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি সোহেল আনোয়ার একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন। এরপর দলীয় সংগীত করে শিল্পী কাবেরী সেনগুপ্তার পরিচালনায় সংগীতভবন। প্রভাতী অধিবেশনে একক সংগীত পরিবেশন করে শিল্পী শ্রেয়সী রায়, সমরজিৎ রায়, রিষু তালুকদার, মাহবুবুর রহমান সাগর, সুপ্রিয়া শীল, সুব্রত ধর, রিমি সিনহা ও ঈশা দে। দলীয় পরিবেশনে ছিল দ্যা স্কুল অব ক্লাসিকাল ডান্স, ওড়িসি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, নৃত্যরূপ একাডেমি, অভ্যুদয়, সুরপঞ্চম ও ধ্রুপদ সংগীত নিকেতন।

কথামালায় অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, চ্যানেল আইয়ের ব্যুরো প্রধান চৌধুরী ফরিদ, সাংবাদিক ডেইজি মওদুদ, নাট্যজন শুভ্রা বিশ্বাস প্রমুখ।

সিটি মেয়র বলেন, সংস্কৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রকৃতিকে আমরা অবহেলা করি, কিন্তু প্রকৃতি আমাদের মনে রেখেছে। বোধন আবৃত্তি পরিষদের মতো সংগঠনগুলো নাচ, গান, কবিতায়, চিত্রাঙ্কনে বসন্তকে বরণ করছে। বসন্তের বরণডালায় এনেছে নতুন সাজ।

একক কবিতা পাঠে ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী জসিম উদ্দিন ও সুনিপুণ সেনগুপ্ত। বিকাল সাড়ে ৩টায় উৎসব অঙ্গন থেকে বসন্তবরণ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বৈকালিক অধিবেশন। এরপর শিল্পী প্রিয়তোষ বড়ুয়ার পরিচালনায় ভায়োলেনিস্ট চট্টগ্রাম অর্কেস্ট্রা পরিবেশনের পর দলীয় পরিবেশনায় ছিল, ঘুঙুর নৃত্যকলা একাডেমি, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, নৃত্য নিকেতন, সংগীতালয়, অদিতি সংগীত নিকেতনের দলীয় শিল্পীরা। উৎসবে বিভিন্ন ক্ষণে একক গানে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয় শিল্পী কান্তা দে, শিমু বিশ্বাস, অর্ণব ভট্টাচার্য, প্রিয়া ভৌমিক ও শুভাগত চৌধুরী। একক আবৃত্তি করেন মাহবুবুর রহমান মাহফুজ, সংগীতা কর চৌধুরী, পলি ঘোষ, জলিল উল্লাহ ও অংকিতা ভট্টাচার্য।

বৈকালিক কথামালা পর্বে অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ডা. একিউএম সিরাজুল ইসলাম, প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন ও কবি জিন্নাহ চৌধুরী। সব শেষে গণসংগীত ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনায় ছিল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদ।

শিল্পকলা একাডেমি : বসন্ত বরণ উপলক্ষে জেলা শিল্পকলা একাডেমি চট্টগ্রাম বিকাল ৫টায় একাডেমির মুক্তমঞ্চে আয়োজন করে বসন্ত উৎসব। সঙ্গীতশিল্পী শ্রেয়সী রায়ের ‘আজি রঙে রঙে রঙ মিশাতে হবে’ গানটির মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর আবৃত্তিশিল্পী ও উপস্থাপক শ্রাবণী দাশগুপ্তার সঞ্চালনায় একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সূর্চি চাকমা, সঙ্গীতশিল্পী মো. মোস্তফা কামাল, অনুপম দেবনাথ পাভেল, আবদুল হালিম, নুসরাত জাহান রিনি ও আবদুর রহিম। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি সঙ্গীতদল, অভ্যুদয় সঙ্গীত অংগন ও সঙ্গীত ভবন। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি নৃত্যদল, চারুতা নৃত্য একাডেমি, স্কুল অব ক্ল্যাসিকেল অ্যান্ড ফোক ডান্স ও সঞ্চারি নৃত্যকলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখালি কন্টেনারের ফোর্সড শিপমেন্ট বন্ধের আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধরাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় : ইসি আলমগীর