ভারতবর্ষে সাহিত্যবিশারদ

জয়দীপ দে | শুক্রবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

বাংলা পুঁথিসাহিত্য গবেষণার প্রাণপুরুষ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বাংলা সাহিত্যের সম্ভারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁর নিরলস পরিশ্রম দিয়ে। বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে পরিচিত সময়কালের অনন্য সব নির্দশন আবিষ্কার করে আঁধার ঘরে যেন তিনি আলোর রেণু ছড়িয়েছেন। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের, আরো স্পষ্ট করে বললে চট্টগ্রামের মুসলমান কবিদের, অবদান বিস্মৃতির অতল থেকে তিনি তুলে নিয়ে এসেছেন। ১১ টি প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশের পাশাপাশি ১০০ জন পূর্বে অজ্ঞাত মুসলমান কবিকে তিনি সুধীমহলের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন। একজন প্রকৃত গবেষকের মতো তিনি সাহিত্যের জাতপাত বিবেচনা করেননি। সংগ্রহের ক্ষেত্রে ছিলেন তিনি উদার ও অসাম্প্রদায়িক। এ প্রসঙ্গে চিন্তাবিদ আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘পুথিও সংগ্রহ করেছেন হিন্দু-মুসলিম অভেদে, তাঁর আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুথি সংগ্রহ করেননি।’
প্রাচীন পুথি সংগ্রহের কষ্টকর অভিযানকে সাহিত্যবিশারদ এভাবেই বর্ণনা করেছেন-
‘চট্টগ্রামে পল্লীতে-পল্লীতে প্রাচীন তুলট কাগজে লিখিত অসংখ্য পুথি বিরাজ করিতেছে। সে সমস্ত অযত্নে বা সযত্নে রক্ষিত হইয়া, আধুনা কাল-প্রভাবে বিনষ্ট হইয়া যাইতেছে। সত্যকথা বলিতে গেলে, বিলুপ্তপ্রায় প্রাচীন সাহিত্যের উদ্ধারকল্পে চট্টগ্রামে আদ্যাপি রীতিমত কোন চেষ্টাই হয় নাই। আধুনা লোকান্তরিত প্রতিভাশালী নবীনযুবক ভূতপূর্ব্ব ‘আলো’-সম্পাদক নলিনীকান্ত সেন মহাশয় এই কার্য্যে অগ্রসর হইতেছিলেন, কিন্তু নিষ্ঠুরকাল আমাদের সেই কার্য্য সম্পন্ন হতে দেয় নাই; তাঁহার অকালবিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সাহিত্যের উদ্ধার কার্য্য কর্ণফুলীর অতল জলে ডুবিয়া যায়। তদন্তর একমাত্র এই প্রবন্ধের ক্ষুদ্রশক্তি লেখক আপন অযোগ্যতা ও অক্ষমতা সত্ত্বেও এই কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া, সহায়-সম্বলহীনভাবে প্রাচীন সাহিত্যের বহুল রত্নরাজি সংগ্রহ করিয়াছে। এ পর্য্যন্ত স্বীয় চেষ্টায় ছয়শতের অধিক বাঙ্গালা হস্তলিখিত পুথি ও সন্দর্ভপুস্তক এবং তিন শতের অধিক কবির পদাবলী সংগ্রহ ও উদ্ধার হইয়াছে।’
চট্টগ্রামের গৌরব আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী গ্রামে ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৩ সালে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। কিছুদিন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে চাকরি নেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে তিনি স্কুল পরিদর্শক হন। ১৯৩৪ সালে এ- পদ থেকে তিনি অবসরে যান।
১৯২০-২১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁর রচিত বাংলা পুথির তালিকা ‘বাঙালা প্রাচীন পুথির বিবরণ’ শিরোনামে দুখণ্ডে প্রকাশ করে। তাঁর সংগৃহীত পুথির বেশিভাগ মুসলমান কবিদের লেখা। বর্তমানে এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। হিন্দু কবিদের লেখা অবশিষ্ট পুথিগুলি রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলির একটি সুবিন্যস্ত তালিকা ‘পুথি পরিচিতি’ শিরোনামে প্রকাশ করেছে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ শীর্ষক আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর ‘ইসলামাবাদ’ নামে তাঁর লেখা একটি বই রয়েছে। বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে যখন ভীষণ অস্বস্তি ছিল, তখন তিনি এসবের মাধ্যমে প্রমাণ করেন বাংলা মুসলমানদেরও ভাষা ছিল। এতে তাদের অবদান ও অধিকার কোন অংশে কম নয়।
নদীয়া সাহিত্য সভা তাঁকে ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে এবং চট্টল ধর্মমন্ডলী তাঁকে ‘সাহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি বরাবরই শেষোক্ত খেতাবটি তাঁর নামের সঙ্গে ব্যবহার করতেন।
ভাষা আন্দোলনের পরের বছর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর আবিষ্কার বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তাবাদী চেতনা বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর সংগৃহীত পুথি ও প্রমাণকগুলো বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলা ভাষার পক্ষে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল।
সংগ্রাহকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন গবেষক ও অনুসন্ধিৎসু মানুষ। তাঁর লেখালেখির শুরু প্রবন্ধ রচনা দিয়ে।
বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথম দিকে নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কিন্তু পত্রিকাটি প্রকাশের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম ফর্মার প্রুফ দেখা অবস্থায় তিনি প্রয়াত হন। তারপর জলধর সেন এর দায়িত্ব নেন। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩২০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে (১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস)। তখন পত্রিকাটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। যুক্তবঙ্গে প্রবাসী ও ভারতবর্ষ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মাসিক পত্রিকা ছিল। প্রথমটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পরেরটিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত লিখতেন। এদের লেখাই ছিল পত্রিকা দুটোর মূল আকর্ষণ।
একটি গবেষণার কাজে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সংখ্যাগুলো ঘেঁটে দেখতে হয়েছিল আমাকে। সেখানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ৬টি প্রবন্ধের সন্ধান পাই। এ প্রবন্ধগুলো চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। অনুসন্ধানকালে রওশন আলী চৌধুরী সম্পাদিত ‘কোহিনূর’ পত্রিকাতেও সাহিত্যবিশারদের একটি লেখার সন্ধান পাই।
প্রবন্ধগুলো ১৯১৩ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়। লেখাগুলো চট্টগ্রাম ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দলিল। প্রবন্ধগুলো হলো: গোবিন্দচন্দ্র রাজার কথা (প্রকাশিত ১৩২০ বঙ্গাব্দ), বঙ্গ-সাহিত্যে চট্টগ্রাম (প্রকাশিত ১৩২২ বঙ্গাব্দ), বৈষ্ণব-কবিগণের পদাবলী (প্রকাশিত ১৩২৩ বঙ্গাব্দ), মুসলমান কবির বিদ্যাসুন্দর (প্রকাশিত ১৩২৫ বঙ্গাব্দ), চট্টগ্রামের সাহিত্য (প্রকাশিত ১৩২৫ বঙ্গাব্দ), অপ্রকাশিত প্রাচীন বৈষ্ণব পদাবলী (প্রকাশিত ১৩২৬ বঙ্গাব্দ) এবং চট্টগ্রামের মুসলমান (প্রকাশিত ১৩২২ বঙ্গাব্দ)।
প্রথম প্রবন্ধটি ইতিহাসখ্যাত রানী ময়নামতির পুত্র গোবিন্দচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। রাজা গোবিন্দের রাজ্য ঠিক কোথায় ছিল সাহিত্যবিশারদ তা অনুসন্ধান করেছেন বিভিন্ন পুথির সুত্র ধরে। লোকবিশ্বাস অনুসারে রানী ময়নামতির ৪টি বাড়ি ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। এর মধ্যে ত্রিপুরার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে ময়নামতি নামক স্থানে তিনি সর্বদা অবস্থান করতেন বলে সাহিত্যবিশারদ নিশ্চিত করেছেন। এর অদূরেই লালমাই রেলওয়ে স্টশন অবস্থিত। সাহিত্যবিশারদের আবিষ্কৃত ‘ময়নামতীর পুথি’র সূত্র ধরেই তিনি এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। ভবানীদাস নামক জনৈক কবি এ পুথির রচয়িতা। রানী ময়মনামতি নেপালী বৌদ্ধ যোগী গোরাক্ষনাথের শিষ্যা ছিলেন। তিনি পুত্র গোবিন্দচন্দ্রকে রাজপাট ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণের জন্য চাপ দিতেন। শেষমেশ গোবিন্দচন্দ্র হাড়িকা নামের এক সিদ্ধপুরুষের শিষ্যত্ব লাভ করেন। অষ্টম শতকের ত্রিপুরা ও সমতটের জীবন ব্যবস্থা জানার জন্য এ-লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান নিয়ে লেখা। এটি মূলত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনে পাঠ করা হয়। এখানে সাহিত্যবিশারদের প্রাচীন পুথি সংগ্রহের নিরলস প্রচেষ্টা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন-
‘আমি এ পর্য্যন্ত পুথি প্রভৃতিতে ৫৯২ খানি প্রাচীন গ্রন্থ এবং তিনশতের অধিক সঙ্গীত ও পদাবলী প্রভৃতির লেখক কবির সন্ধান করিয়াছি। তুলনায় হিন্দু-কবির সংখ্যা অবশ্য অনেক বেশী কিন্তু মুসলমান-সমাজের শিক্ষা-দীক্ষার অনুপাতে মুসলমান-কবির সংখ্যাই অধিক বলিতে হইবে।’
এ প্রবন্ধে আমরা চট্টগ্রামের ৭৭ জন প্রাচীন হিন্দু ও ৯০ জন প্রাচীন মুসলমান কবির নাম ও সৃষ্টিকর্মের উল্লেখ পাই।
বৈষ্ণব পদাবলী মূলত রাধাকৃষ্ণের প্রেম বর্ণনা। এটা একান্ত হিন্দু কবিদের সৃষ্টির ক্ষেত্র মনে হলেও সাহিত্যবিশারদ ৪০ জনেরও অধিক মুসলমান বৈষ্ণব-কবিকে আবিষ্কার করেছেন। তৃতীয় প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘বৈষ্ণব-কবিগণের পদাবলী’। এখানে তিনি লিখেছেন-
‘মুসলমান কবিগণ এক সময়ে কবিতাকারে রাধাকৃষ্ণের প্রেম বর্ণনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, এখন এই ভেদবুদ্ধির দিনে এ কথা নিতান্ত বিচিত্র বলিয়াই বোধ হইবে। কিন্তু বিচিত্র বোধ হইলেও তাহা একান্ত সত্য কথা, তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। মুসলমান কবিগণ সত্য-সত্যই রাধাকৃষ্ণের প্রেমসুধা-গানে বিভোর হইয়াছিলেন’।
প্রবন্ধে তিনি মুসলমান কবিদের লেখা কিছু বৈষ্ণব পদাবলী তুলে ধরেন। এরকম একটি পদাবলী এখানে উপস্থাপনের লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
তুরি পরছ।
রূপ দেখি কেবা জাইব ঘরে।
চিত্ত কাড়া* কালার বাঁশী লাগিছে অন্তরে।। ধু।
কিবা দিনে কিবা খেনে বন্ধুর সনে দেখা।
জেবা ছিল জাতি কুল ন জাইব রাখা।
সে সে জানে কালার বাঁশী লাগি আছে জারে।
ছাড়িব জগত মায়া তরাইবে কারে।।
মোহাম্মদ হাসিম কহে রূপের নিছনি।
কিবা আছে কিবা দিমু সরে সুধা** প্রাণি।।৩।
* চিত্ত কাড়া- চিত্ত-হরণ-কারী।
** সুধা- সুধু।
পরের প্রবন্ধটি ‘মুসলমান কবির বিদ্যাসুন্দর’। এতে সাহিত্যবিশারদ নবাবিষ্কৃত জনৈক মুসলমান কবি রচিত বিদ্যাসুন্দরের কথা বর্ণনা করেছেন। পুথিটি তিনি চট্টগ্রাম সদরের নিকটবর্তী চান্দগাঁও গ্রামে ‘এক মুসলমানের বাড়ি’ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। সেই পুথির বর্ণনা থেকে কবির নাম জানা যায় সাবিরিদ খান। তাঁর বংশের উপাধি ছিল ‘খান মল্লিক’।
পরের প্রবন্ধটি মূলত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন’-এ সাহিত্যবিশারদ কর্তৃক প্রদত্ত অভিভাষণের অংশবিশেষ। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘চট্টগ্রামের সাহিত্য’। এখানে চট্টগ্রামের দুই কৃতী কবি নবীনচন্দ্র সেন ও মহাকবি আলাওল সম্পর্কে লিখেন-
‘বঙ্গের আধুনিক সাহিত্য-গগন আমাদের নবীনচন্দ্রের প্রতিভার ভাস্বর আলোকে সমুদ্ভাসিত। আর আমাদের আলাওলকে লইয়া শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বঙ্গদেশ গৌরবান্বিত। কেবল এই দুইজনকে লইয়া আমরা স্ফীত বক্ষে বঙ্গ-সাহিত্যের আসরে দণ্ডায়মান হইতে পারি।’
শুধু কবিতায় নয় সঙ্গীতেও চট্টগ্রাম একসময় অগ্রসর জনপদ ছিল। সাহিত্যবিশারদ লিখেছেন-
‘প্রাচীনকালে চট্টগ্রামে সঙ্গীত-শাস্ত্রের বিশেষ আদর ও অনুশীলন ছিল। তাহার ফলে এই দেশে তখন অনেক সঙ্গীতবিশারদ পণ্ডিতের আবির্ভাব ও বহু সঙ্গীত-গ্রন্থ বিরচিত হইয়াছিল। সেই গ্রন্থগুলি সাধারণতঃ ‘রাগমালা’ বা ‘রাগনামা’ নামে পরিচিত। তাহাতে রাগরাগিণীর পরিচয়াদি বর্ণিত আছে। প্রত্যেক রাগে গেয় এক বা ততোধিক সঙ্গীত প্রত্যেক রাগের নীচে সংগৃহীত হইয়াছে।’
প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সির অত্যাধিক ব্যবহারের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দারুণ কিছু কথা লিখেছেন-
‘বাঙ্গালার বর্ত্তমান ভাষা ব্যবহার করিয়া আমাদের সাহিত্যকে ইসলামী সাহিত্যে পরিণত করা অসম্ভব নহে। ভাবসম্পদে সম্পন্ন না হইলে শুধু শব্দসম্পদে কোন সাহিত্য জাতি-বিশেষের প্রকৃত সাহিত্য-পদবাচ্য হইতে পারে না। ভাষা চিরদিন ভাবের অনুগামিনী, ভাব ভিন্ন কেবল ভাষায় কোন জাতির প্রকৃত জাতিত্ব হৃদয়ঙ্গম করা বড়ই কঠিন।’
শেষ দুটি প্রবন্ধের একটিতে সাহিত্যবিশারদ কিছু অপ্রকাশিত প্রাচীন বৈষ্ণব পদাবলী তুলে ধরেছেন। অন্য প্রবন্ধটিতে চট্টগ্রামে কীভাবে মগদের আধিপত্য ক্ষুণ্ন করে ইসলামের বিস্তার হলো তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-
‘বঙ্গদেশে যদি কোথাও খাঁটি ইসলাম বলিয়া কিছু থাকে, তাহা এই চট্টগ্রামে ভিন্ন আর কোথাও নেই। চট্টগ্রামের সীমা পার হইয়া গেলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করিয়া লওয়া একরূপ কঠিন ব্যাপার বলিলেই হয়। ইসলাম-ধর্ম্মের জন্মস্থান-সঞ্জাত আরবগণ পৃথিবীর সকল মুসলমান হইতে বেশী খাঁটি মুসলমান হইবেন, ইহাতে কিছুই বৈচিত্র্য নাই।’
অবশ্য সাহিত্যবিশারদের ‘খাঁটি মুসলমান’-এর তথ্য এ যুগে গ্রহণযোগ্য নয়। আরবরাও একসময় অন্য ধর্মালম্বী ছিল। পরে তারা নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। ধর্ম একটি দর্শন ও জীবনব্যবস্থা। যে তা যত বেশি অনুসরণ করে সেই তত খাঁটি।
প্রবন্ধটিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আরব্য প্রভাব সম্পর্কেও ধারণা দেয়া হয়।
এই ৭ টি প্রবন্ধের মাধ্যমে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের সাহিত্যসাধনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। কী দারুণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত এক জনপদ ছিল চট্টগ্রাম! সংস্কৃতির জাতপাত থাকে না। সংস্কৃতিকে ধর্মের কাঁটাতার দিয়ে আবদ্ধ করা নির্বুদ্ধিতা। সেটা হাজার বছর আগে চট্টগ্রামের সাহিত্যসেবীরা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই কৃষ্ণ-রাধার শাশ্বত প্রেমোপখ্যানকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনায় মুসলমান হয়েও তাঁরা কুণ্ঠিত হননি। চট্টগ্রামের প্রাচীন সাহিত্য অনুসন্ধানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অবদান সম্পর্কে এখান থেকে খণ্ডিতভাবে হলেও জানা যায়।
লেখক- কথাসাহিত্যিক ও গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধলায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে বিশ্ব দৃষ্টি দিবস পালন
পরবর্তী নিবন্ধমো. নাছির