ভবনের তলায় সারি সারি মটকা

গুপ্তধন না অন্যকিছু, দিনভর টান টান উত্তেজনা পাথরঘাটার নজু মিয়া লেন

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৮ জুলাই, ২০২১ at ৪:২৮ পূর্বাহ্ণ

রূপকথার গল্পের মতো ঘরের ভিটির তলায় অগুনতি ‘মটকা’। সারি সারি। ভিটির পুরোটা জুড়েই মটকার সারি। শ্বাস বন্ধ করা উত্তেজনায় চলছিল খননকাজ। প্রায় দুইশ’ বছরের পুরনো পাকা ভিটি যতই খোঁড়া হচ্ছিল নিচে ততই দেখা মিলছিল ‘মাটির মটকা’। বিপুল পরিমাণ গুপ্তধন পাওয়ার আশাও কারো কারো মনে উঁকি দিচ্ছিল। সকাল থেকে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করছিল পাথরঘাটা নজু মিয়া লেনের বাড়িতে। বিপুল সংখ্যক মানুষের আনাগোনায় গতকাল দিনভর ব্যাহত হয়েছে খনন কাজ। সারাদিনে মাত্র ১৮টি মটকা বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। আরো বহু মটকা উঁকি মারছে ভেতর থেকে।
সরজমিনে পরিদর্শকালে জানা যায়, পাথরঘাটার ধণাঢ্য ব্যবসায়ী হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগর রেঙ্গুনের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। দুইটি নিজস্ব জাহাজে চলতো পণ্য পরিবহন। ব্যবসায়ী হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ প্রায় দুইশ’ বছরেরও বেশি আগে ইট সুরকির এক তলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে ১১৮ হাজী নজু মিয়া লেনের সুরম্য বাড়িটি নির্মাণে তৎকালে ব্যয় করা হয় ২৫ হাজার রুপিরও বেশি অর্থ। প্রায় ছয় গণ্ডা জায়গার উপর ৪০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল, বড় বড় পিলার দিয়ে নির্মিত বাড়িটিতে কাঠের বীমের উপর চুন সুরকির বেশ পুরো ছাদ দেয়া হয়েছিল। শরিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগর বেশির ভাগ সময় রেঙ্গুনে থাকলেও তাঁর পরিবার পরিজন বাড়িটিতে বসবাস করতেন। তার মৃত্যুর পর বসবাস করতেন শরিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগরের পুত্র বাদশা মিয়াসহ স্বজনেরা। বাদশা মিয়াও ইতোমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন। বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্মের মোহাম্মদ ফারুক, আবদুল মোতালেব, শুক্কুর মিয়া, নাসির মিয়া, মঞ্জু মিয়া, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। এদের অনেকেরই বয়স ষাটের কাছাকাছি ঠেকেছে। শরিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগর যেই বাড়িটি নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন দিনে দিনে সেটির জৌলুশ নষ্ট হয়েছে। বৃষ্টির সময় ছাদ চুপসে পানি পড়ে। নানাভাবে সংস্কার করে বাড়িটি ব্যবহার উপযোগী রাখার চেষ্টা করা হয়। কাটানো হয় বেশ কয়েক বছর। কিন্তু দিনে দিনে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় স্বজনেরা সবাই মিলে ভবনটি ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। আর এই সিদ্ধান্তের আলোকে ভবনটি ভাঙার কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে দেয়াল এবং ছাদসহ ভবনের উপরিভাগ পুরোটাই ভেঙে ফেলা হয়েছে। শুরু হয়েছে ভিটিসহ ভিত ভাঙার কাজ। ভেতর থেকে বিভিন্ন ধরনের ইট এবং সুরকি বের করে আনার পর মাটির দুই ফুটের মতো গভীরে উঁকি দেয় ‘মাটির মটকা’। প্রথমে একটি মটকা দেখা গেলেও পরবর্তীতে দেখা দেয় বেশ কয়েকটি। ভবন ভাঙার কাজে নিয়োগ দেয়া শ্রমিকদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা চিৎকার করে উঠেন। হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহর উত্তরসূরীরা ভিড় করেন। সবাই প্রায় নিশ্চিত হন যে, বিপুল সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে ভবনটির নিচে। ‘আহা, পূর্ব পুরুষেরা সম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন, আমরা শুধু শুধু এত কষ্ট করছি!’- এমন ধারণাও ‘মটকা’র মতো হয়তো উঁকি মারছিল।
বেশ যত্ন করে বের করে আনা হলো একটি ‘মটকা’। কিন্তু ভিটির একেবারে তলা থেকে বের করে আনা মাঝারী আকৃতির মটকাটি উল্টো করে স্থাপন করা। ভেতরে পুরোটাই খালি। একটি খালি মটকা কেন উপুড় করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তা বুঝে উঠার আগে ভিটির তলায় আরো একটি মটকা উঁকি মারে। সেটি বের করেও পাওয়া যায় খালি, উপুড় করা। এভাবে একে একে বের করে আনা হয় ১৮টি খালি ‘মটকা’। সবগুলো উপুড় করা। ভিটির তলায় মাটি সরিয়ে আরো অসংখ্য মটকার হদিশ মিলে। এরমধ্যে মাটির তলাতেই কয়েকটি কোদালের আঘাতে ভেঙে যায়। সেগুলোও খালি, উপুড় করা। ধারণা করা হচ্ছে, শ’ দুয়েক একই সাইজের একই আকৃতির মটকা রয়েছে ভবনটির ভিটিতে।
গতকাল সরজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ভবনটির ‘বেইজ’ ছাড়া পুরো ভিটি জুড়ে মটকা বসানো। শুধু পিলার এবং গ্রেট বীমের জায়গায় কোনো মটকা নেই। সারি সালি খালি মটকা উপুড় করে স্থাপন করে তার উপর ঘরের পাকা ভিটি তৈরি করা হয়েছে। প্রায় দুই ফুট পুরু এই ভিটিও ইট সুরকির। ভিটির তলায় এতগুলো মটকা কেন স্থাপন করা হলো, নাকি বিশেষ কোন ‘মটকা’ সেখানে রয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্বজনেরা বলেন, আমরা ১৮টি মটকা বের করে এনেছি। সবগুলোই খালি এবং উপুড় করে বসানো। বসত ঘরের ভিটির তলায় পূর্ব পুরুষেরা কেন এভাবে এতগুলো খালি মটকা লুকিয়ে রেখেছিলেন তা বোধগম্য নন বলে জানালেন হাজী শরিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগরের উত্তরসুরী মরহুম বাদশা মিয়ার পুত্র মোহাম্মদ ফারুক। তিনি বলেন, হয়তো ঘর ঠাণ্ডা রাখার জন্য বা ভূমিকম্প জাতীয় কোনো দুর্যোগ ঠেকাতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে।
গতকাল সকাল থেকে দলে দলে লোকজন আসছেন মটকাগুলো দেখতে। সারি সারি মটকা দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আশফাক আহমেদের সাথে কথা হয়। তিনিও ‘মটকা’ দেখতে এসেছেন বলে জানান। দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে আশফাক আহমেদ বলেন, বিষয়টি মাথায় ঢুকছে না। এতগুলো মটকা কেনই বা ঘরের ভিটিতে লুকিয়ে রাখা হবে। এটা কি ঘর নির্মাণের বিশেষ কোনো কারিগরি কৌশল নাকি অন্য কিছু কে জানে! তবে কোনো রকমের গুপ্তধন থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে আশফাক আহমেদ বলেন, গুপ্তধন এক বা দুইটি কলসিতে লুকানো হতো। পরিবারের একজন দুজন মানুষ জানতো। বাড়ি নির্মাণে জড়িত লোকজনদের জানিয়ে কেউ এভাবে গুপ্তধন লুকাতেন না। আর এতগুলো মটকা স্থাপন নির্মাণ শ্রমিকদের অগোচরে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই ইস্টারেস্টিং। ভিতের তলায় এতগুলো ‘মটকা’ দেয়ার নিশ্চয় কোন একটি কারণ ছিল। আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যা সমর্থন না করলেও ওই সময়ে নিশ্চয় এর চলন ছিল। এর কোন সুফলও হয়তো পাওয়া যেতো। বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে বলেও স্থপতি আশিক ইমরান উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস এই প্রসঙ্গে বলেন, আসলে তখন প্রকৌশল বিদ্যার এত উন্নতি ঘটেনি। মিস্ত্রি টাইপের লোকজনই নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে ভবনের ভিত দিতেন, নির্মাণকাজ পরিচালনা করতেন। এক্ষেত্রেও তেমনটি করা হয়েছে। বাড়ির ভিতে এতগুলো মটকা দেয়ার কারন আমাদের অজানা। প্রকৌশল বিদ্যা এই ধরনের মটকা দেয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদায় ট্র্যাজেডি কিং
পরবর্তী নিবন্ধঅ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩৫ লাখ টিকা পাচ্ছে বাংলাদেশ