বড় বিপর্যয়, তবুও ঘুরে দাঁড়াল অর্থনীতি

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

করোনার ভয়াল আঘাতে বিদায়ী বছরে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের হোঁচড় খেয়েছে। ভয়াবহ রকমের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ব্যবসায়ী শিল্পপতি থেকে শুরু করে সাধারণ চাকরিজীবী পর্যন্ত সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক লাখ প্রবাসী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। করোনাকালে দেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। দেশে দারিদ্র্য হার ১৯ শতাংশ থেকে এক লাফে ২৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। তবে সরকারের দূরদর্শী কিছু সিদ্ধান্ত রক্ষা করেছে অর্থনীতিকে। তবে অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি গতিশীল হতে আরো অন্তত চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে আতংক আর অনিশ্চয়তার ভিতর দিয়ে এগুতে থাকে দেশ, অর্থনীতি। ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটির নামে অঘোষিত লকডাউন শুরু হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। শিল্পকারখানার উৎপাদন তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ব্যবসা বাণিজ্যও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। চাকরিহারা মানুষের কাফেলা ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। আয় রোজগার কমে যায় লাখ লাখ মানুষের। ওই সময়টাতে দেশে গরীবের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি দ্রুত নিম্নবিত্তে পরিণত হতে থাকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিণত হতে থাকে নিম্ন মধ্যবিত্তে। ধনী শ্রেণির আয়ও কমে যায়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নিজেদের সমীক্ষা রিপোর্টে বলেছে, গত এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত চার মাসে দেশে দারিদ্র্য হার ১০ শতাংশ বেড়ে ২৯ শতাংশে ঠেকেছে। দেশে আগে থেকে ১৯ শতাংশ লোক দারিদ্র বলে ওই সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ওই সময়কালে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। এর আগে দেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী গরীব। সরকারি সংস্থা দারিদ্রের হার ২৯ শতাংশ বলে উল্লেখ করলেও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র্য হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পিপিআরসি ও বিআইজিডি যৌথভাবে গবেষণা করে গত জুন মাসে দেশের দারিদ্র্য হার দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে উল্লেখ করে জানায়, দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমা স্পর্শ করেছে। দৈনিক ১.৯ ডলার বা ১৫৫ টাকার কম আয় থাকলে দারিদ্রসীমার নিচে বলে ধরে নেয়া হয়।
সরকারি সংস্থা সরকারি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ের প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষা চালিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে যে, করোনায় মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। করোনাকালের শুরুতে গত মার্চ মাসে পরিবারপ্রতি মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। গত আগস্ট মাসে পরিবার প্রতি গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় চার হাজার টাকা কমে যাওয়ার এই অবস্থাকে ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আয় কমে যাওয়ার ফলে শত শত পরিবার শহরে বসবাস করতে পারছেন না। অসংখ্য মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। আয় কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষের কর্মহীন হয়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সময় দেশে বেকারত্বের হার আড়াই শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তবে সবকিছু মিলে বছর শেষে বাংলাদেশের অর্থনীতি খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার অত্যন্ত সফলতা দেখিয়েছে বলেও মনে করছেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনীতি যতটুকু ধসে যাওয়ার কথা ছিল ততটুকু হয়নি। করোনা মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ অসামান্য সফলতা দেখিয়েছে। ভারতের মতো রাষ্ট্রের যেখানে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকোচন হয়েছে (নেগেটিভ গ্রোথ) সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩.৮ শতাংশ। এটিকে সরকারের সাফল্য এবং দক্ষতা হিসেবে দেখছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম। যতটুকু খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা ততটুকু হয়নি। পুরো বিশ্বের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো। করোনা মোকাবেলায়ও সরকার দক্ষতা দেখিয়েছে। করোনায় মৃত্যুর হারও কম। সবকিছু মিলে করোনা মোকাবেলা করে ধসে পড়া অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সফলতাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই বলেও খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, সরকার দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছে। এটা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। দেশের ব্যবসা বাণিজ্য এবং গার্মেন্টস সেক্টরসহ সর্বক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের আশংকা তৈরি হয়েছিল। আমরা একেবারে খাদে কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘটনায় আমাদের শেষরক্ষা করেছে। তিনি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলেও মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনীতির বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি এটা ঠিক। তবে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। হাজার হাজার মানুষ বেকার। আয় রোজগার কমে গেছে। সবকিছু আবার স্বাভাবিক গতি পেতে অন্তত আরো পাঁচ বছর সময় লাগবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাঠে ২৭৭ কাউন্সিলর প্রার্থী
পরবর্তী নিবন্ধযুক্তরাজ্যে অনুমোদন পেল অক্সফোর্ডের টিকা