ব্যাংক হিসাবের নমিনি নিয়ে বহু বিড়ম্বনার খবর পাওয়া যায়। যা অবসান হওয়া দরকার । ব্যাংক হিসাব গ্রাহকের ইচ্ছানুযায়ী এর নমিনি নির্ধারণ হয়। যদি নমিনি উল্লেখ না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ তাদের হিস্যানুযায়ী ত্যাজ্য অর্থের ভাগ পাবেন। উত্তরাধিকারী আইন বা ইসলামী ফরায়েজ অনুযায়ী তা নির্ধারণ হবে। নমিনি নাবালক হলে সেক্ষেত্রে তার পক্ষে বিজ্ঞ আদালত হতে অভিভাবক নিযুক্ত হবেন। নিযুক্তিয় অভিভাবক নাবালকের পক্ষে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন ও খরচ করবেন। তবে আদালতে হিসাব দেবেন।
নাবালক ১৮ বছরে সাবালক হয়। তবে আদালতে অভিভাবক নিযুক্তির ক্ষেত্রে তাকে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হবে । দুঃখজনক হলেও সত্য যে নমিনি থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনে নমিনিকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় । এটা ইচ্ছাকৃত বা অনেক ক্ষেত্রে আইন অজ্ঞতার কারণে। ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে ফর্মে ‘নমিনি’ একটা ঘর পূরণ করতে হয়। যেখানে নমিনির ছবি, স্বাক্ষর ও পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত থাকে।
আইন মোতাবেক এ্যাকাউন্ট হোল্ডার মারা গেলে রেখে যাওয়া টাকা এই নমিনি পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংক এ্যাকাউন্টের টাকা নমিনি বা তার রেখে যাওয়া নির্দিষ্ট ব্যক্তিই পেত। কিন্তু গত ০৩.০৪.২০১৬ তারিখে জনৈক সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্টধারী মারা গেলে ওই সঞ্চয়ের টাকা নমিনির (মনোনীত ব্যক্তির) পরিবর্তে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী পাবেন বলে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে হাইকোর্টের মত ছিল নমিনি হবেন একজন ট্রাস্টি। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নমিনি টাকাটা উত্তোলন করে উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করে দেবেন। এই রায় প্রকাশের পরপর দেশে এক ধরণের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। হাজার হাজার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখা হয়েছিল। কাউকে টাকা দেয়া হচ্ছিল না। মৃত ব্যক্তির টাকা উত্তরাধিকারীও দাবি করছিল, আবার নমিনিও দাবি করছিল । এতে বাংলাদেশের তফসিলি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দারুণ সংকটের সম্মুক্ষীণ হয়েছিল।
মুসলিম শরিয়া মোতাবেক মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকলে সেখান থেকে তার দাফন কাফনের যাবতীয় খরচ মেটাতে হবে। তিনি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় কোন ধার-দেনা করে থাকেন তবে তাও রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করে দিতে হবে। তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা ও পরিশোধ করে দিতে হবে। মোট কথা স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহর স্বামী মৃত অথবা জীবিত যাই থাকুক না কেন তা স্বামীর সম্পত্তি থেকে আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দিতে হবে। মৃত ব্যক্তি কোন দান কিংবা উইল করে গেলে তা প্রাপককে দিয়ে দিতে হবে। বর্ণিত সব কাজ সম্পন্ন করার পরে মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে।
শরিয়াত এ্যাপ্লিকেশান এ্যাক্ট ১৯৩৭ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়া আইন প্রযোজ্য হবে।
অপরদিকে ব্যাংকিং কোম্পনিজ আইন, ১৯৯১ এর ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে- (১) ব্যাংক-কোম্পানীর নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহা হইলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা ক্ষেত্রমত, যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করিতে পারিবেন যাহাকে বা যাহাদিগকে, একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যাইতে পারে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ যে কোন সময় উক্ত মনোনয়ন বাতিল করিয়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে অন্য কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে মনোনীত করিতে পারিবেন৷ ২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে মনোনীত কোন ব্যক্তি নাবালক হইলে, তাহার নাবালক থাকা অবস্থায় উক্ত একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে, আমানতের টাকা কে গ্রহণ করিবেন তৎসম্পর্কে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট করিতে পারিবেন। (৩) আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর অধীনে কোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হইলে বা উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইলে তিনি একক আমানতকারী বা ক্ষেত্রমত যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, উক্ত আমানতের ব্যাপারে একক আমানতকারীর বা ক্ষেত্রমত, সকল আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করিবেন, এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন৷ (৪) এই ধারার বিধান অনুযায়ী কোন ব্যাংক-কোম্পানী কর্তৃক টাকা পরিশোধিত হইলে সংশ্লিষ্ট আমানত সম্পর্কিত উহার যাবতীয় দায় পরিশোধ হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।
তবে শর্ত থাকে যে, যে ব্যক্তিকে এই ধারার অধীনে আমানতের টাকা পরিশোধ করা হইয়াছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোন ব্যক্তির কোন অধিকার বা দাবী থাকিলে তাহা এই উপ-ধারার বিধান ক্ষুন্ন করিবে না৷ নমিনি হিসেবে মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা পাওয়ার ব্যপারে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। যা ৬ এমএলআর (এডি) পৃষ্টা ১৮৮, জিয়া উদ্দিন বনাম আরব বাংলাদেশ ব্যাংক লিঃ, ৫২ ডিএলআর (এইচসি) পৃষ্টা ৩৬- এ দেওয়া আছে । এই আইনের শর্ত অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির টাকা নমিনি পাবে। দেখা যাচ্ছে শরিয়াত এ্যাপ্লিকেশান এ্যাক্ট ১৯৩৭ এবং ব্যাংকিং কোম্পনিজ আইন, ১৯৯১ এই দুইটি আইনই স্পেশাল আইন।
সংশ্লিষ্ট আইন জনারেল ক্লজেজ এ্যাক্ট ১৮৯৭ ঘেঁটে দেখা যায়, যে স্পেশাল আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে সেই আইনটি প্রয়োগ করা হবে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকিং কোম্পনিজ আইন, ১৯৯১ আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে তাই এই আইনটিই প্রয়োগ করা হবে। সুতরাং এখন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংক এ্যাকাউন্টের টাকা পাবে নমিনি। উক্ত দ্বন্দ্েবর অবসান কল্পে হাইকোটের্র এই রায় আপীল বিভাগ স্থগিত করে। ফলে পূবের্র আইন বহাল থাকে। ফলে ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো গ্রাহকের মৃত্যু হলে তার নমিনি ছাড়া অন্য কারও কাছে টাকা দেয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ আমানতকারীর মৃত্যুর পর টাকা পাবেন নমিনিই। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা হতে গত ০৬ আগস্ট, ২০১৭ ইং তারিখে অঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ ড়ভ ওহঃবৎবংঃ ড়হ উবঢ়ড়ংরঃ ধহফ খড়ধহ অপপড়ঁহঃং ড়ভ উবপবধংবফ ওহফরারফঁধষং বিষয়ে জারিকৃত বিসিডি সার্কুলার নং ১৮/১৯৮৪ এর পরিপালন প্রসঙ্গে বিআরপিডি সার্কুলার নং ১১ -এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ইং তারিখে বিআরপিডি সার্কুলার নং ০৬ এএ বিষয়ে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছিল, সমপ্রতি কিছু কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের মনোনীত নমিনির কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিয়েছে যে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাঁদের মনোনীত নমিনি মৃত ব্যক্তির হিসাবে রক্ষিত আমানত প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বা উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারেন। কিন্তু এই অঙ্গীকারনামা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারার নির্দেশনার পরিপন্থী।
এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে বা কোনো উইলে বা সম্পত্তি বিলিবণ্টনের ব্যবস্থা সংবলিত অন্য দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, মৃত্যুর পর নমিনি অধিকার পাবেন। অন্য যে কোনো ব্যক্তি ওই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। ব্যাংক কোম্পানি ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন- ১৯৯১’ এর ১০৩ ধারার বিধান মতে নমিনি মৃত ব্যক্তির আমানতের টাকা পাওয়ার এক মাত্র হকদার। বিষয়টি পরিস্কার হওয়ার পরও মৃত ব্যক্তির টাকা ধরে রাখা ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয় । আইনী জটিলতা ও মামলা মোকদ্দমার সৃষ্টি করে দীর্ঘদিন টাকা ব্যাংকে ধরে রাখার কূট বুদ্ধি অত্যন্ত দুঃখজনক। সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ কর্তৃক ভিন্ন কোন মত বা সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত আমানতকারীর মৃত্যুর পর তার নির্ধারিত নমিনিকেই আমানতের টাকা প্রদান করতে হবে। এটাই নিয়ম, এটাই আইন।
লেখক : এডভোকেট, কলামিস্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকার কর্মী ।