বৃদ্ধাশ্রম : সে এক অচিন দেশে নীরব কান্নাগাথা

আমিনা রহমান লিপি | শুক্রবার , ২৯ জুলাই, ২০২২ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষের চলমান জীবনের প্রতিটা ভোর আসে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনায় পরিবারের আপন জনের ভরসার স্পর্শে জীবন নামের রেলগাড়িটার গতিতে। সেখানে অপেক্ষা থাকে, থাকে ভালোবাসা, থাকে ভরসা, অদৃশ্য বা দৃশ্যমান। এক সময় মানুষের বয়স বাড়ে, ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে তাঁর জীবনের এই সকল স্পর্শের ছোঁয়া, জরাজীর্ণ দেহকে টেনে নিয়ে যায় সে এক অচিন দেশে, বৃদ্ধাশ্রমে।
সেখানে যে বৃদ্ধ জনেরা বাস করেন? মনে হলো তাঁদের আর কোনো অপেক্ষা নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই, নেই কোনো বিনিময় করার আপন মানুষের স্পর্শ। কেবলই অনিশ্চিত পথে ধাবমান, নিয়ম মাফিক জীবনের পৃথিবী চার দেয়ালের অদৃশ্য যন্ত্র কুঠির। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম ঢাকার আগারগাঁও বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে থাকেন যেসব প্রবীণ অগ্রজরা? তাঁরা ছিলেন একসময় সমাজের উচ্চ মর্যাদার আসনের মানুষ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক, লেখিকা, ব্যাংকের ম্যানেজার, জজ পিতার লেখিকা সন্তান একসময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পিডিবির একজন উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি থেকে অবসরের পরে তাঁর শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে, সান-মুন প্রিক্যাডেট এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ সাতাশ বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে, একজন ব্যাংকের ম্যানেজার, একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার তাঁদের জীবনের শেষ ঠিকানা হয়েছে এখন বৃদ্ধাশ্রমে। ‘এই স্বার্থপর দুনিয়াতে কাউকে আপন ভাবতে নেই, এই দুনিয়াতে সবাই স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝ রাস্তায় ফেলে রেখে যাবে, এটাই স্বাভাবিক’ – হুমায়ুন ফরিদীর এই কথাগুলো একেবারেই সত্য মনে হয় যখন দেখি বাবা-মা যখন তাঁদের সন্তানদের মাথার উপর আকাশ ছিলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সন্তানদের নিরাপদ পৃথিবীর সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন! তখন সন্তানরাও প্রচণ্ড ভালোবাসায় বাবা-মাকে ভরসা দিয়েছে তাঁদের শেষ জীবনের বাবা-মায়ের মাথার উপর আকাশ হবে তারা। বাবা-মায়েরা বয়স হয়ে গেলে নানান মানসিক রোগে, শারীরিক রোগে, নিঃসঙ্গতায়, হীনমন্যতায় ভোগেন এসব কারণে অনেক সমস্যা পোহাতে হয় তাঁর সন্তানদের এটাও সত্য। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখি না প্রতিদিন আমরা একটু-একটু করে তাঁদের গন্তব্যের পথে চলেছি? আমাদের দেখানো সেই পথেই নিয়ে যাবে আমাদের সন্তানেরা। তখন আমাদেরও কারোর ঠিকানা হতে পারে এমন কোনো বৃদ্ধাশ্রমে?
আমি এই বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধজনদের দৃষ্টিতে দেখলাম! আপন জনকে কাছে না পাবার নীরব আকুতি, সংসারের মায়ার বন্ধনে বাকিটা জীবন কাটানো, মনের কোনে প্রচণ্ড অভিমান লুকায়িত। ভয়,সংশয় ভরা আচরণ। তাই আমার মনে হয়, নিজেদের সন্তানদের, আমরা নিজেরাও মাঝে-মধ্যে বৃদ্ধাশ্রম গুলোতে গিয়ে দেখা উচিত ঘর হারা বাবুইয়েরা, চড়ুই হয়ে শেষ জীবনে কোন ঘরে বাসা বেঁধেছেন,সেখানে কেমন আছেন তাঁরা? বাবা-মা সংসারে বোঝা নয়, তাঁরাও আমাদের জীবনের একটা দায়িত্বশীল অংশ। তাঁদের প্রতি যতটা সম্ভব আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে,আন্তরিক হতে হবে,তাদের সারাদিনের ব্যাস্ততার মাঝে কিছু সময় দিতে হবে,তাদের সাথে গল্প করতে হবে। আমাদের বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা দিনে-দিনে অনেক বাড়ছে। এখানে ভর্তি হচ্ছেন বেশির ভাগ আমাদের সুশীল সমাজের বাবা-মা। যাঁদের সন্তানের কাছে বা নিজের বাড়িতে সুন্দর করে অনায়াসে রাখা যেতো তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা কে । আর কেউ পারিবারিক ভাবে সেটা যদি অক্ষম হোন? তবে তাদের দেখে, বুঝে সেখানে বাবা-মাকে রাখা উচিত যেখানে শেষ বয়সে তাদের বাবা মা যেন পরিবারের ছোঁয়া পাই। শান্তিতে থাকেন আমৃত্যু।
এখন বাংলাদেশের যে সব বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠছে সেগুলো যেন উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তিতে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠে। সে দিকটাতে সচেতন হলে সময়ের সাথে সাথে, পরিবার গুলোতে একটা সুশৃঙ্খলভাবে আগামী সময় গুলোতে নিজের বয়োবৃদ্ধ বাবা- মা, নিজের পরিবার, সকলে নিশ্চিত জীবনে সুন্দর করে থাকতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ যেন মানবতাকে পুটলিতে বেঁধে ছুঁড়ে ফেলা!
পরবর্তী নিবন্ধঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক