বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশ এবং আমাদের প্রত্যাশা

| শুক্রবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

গ্যালআপ আইন ও শাসন ইনডেস্কের সর্বশেষ প্রকাশিত র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ দেশ হিসেবে জায়গা হয়েছে আফগানিস্তানের। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশের তকমা পেয়েছে সিঙ্গাপুর। ১২০টি দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চালানো জরিপের ভিত্তিতে এ র‌্যাংকিং করেছে গ্যালআপ। নিজ দেশে ‘নিরাপত্তা বোধ’ নিয়ে এসব মানুষের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ২৬ অক্টোবর প্রকাশিত রিপোর্টে ১২০টি দেশের মধ্যে ৫১ স্কোর গড়ে আফগানিস্তানের ঠাঁই হয়েছে তলানিতে। অন্যদিকে ৯৬ স্কোর গড়ে সিঙ্গাপুর সবচেয়ে নিরাপদ দেশের স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। এই জরিপে বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৯ স্কোর। বাংলাদেশের সমান একই স্কোর পেয়েছে যুক্তরাজ্য, আলজেরিয়া, মলদোভা, গ্রিস ও কিরগিজস্তান।

গ্যালআপের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ১০ দেশ- সিঙ্গাপুর, তাজিকিস্তান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, আরব আমিরাত, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও পর্তুগাল। গ্যালআপের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ ১০ দেশ- আফগানিস্তান, গ্যাবন, ভেনেজুয়েলা, কঙ্গো, সিয়েরা লিওন, জাম্বিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ক্যামেরুন, মালি ও কেনিয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রায়-পঞ্চাশ বছর ধরে আফগানিস্তানে চলছে সংঘাত, পাল্টা সংঘাত, যুদ্ধাবস্থা। প্রথমে আসে সোভিয়েত বাহিনী। তাদের হটায় মুজাহিদিন গ্রুপগুলো। এদের সরিয়ে আসে তালেবান। তালেবান সরিয়ে নর্দান অ্যালায়েন্স। তারপর আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট হামিদ কারজাই সরকার। তারপর আশরাফ গণির সরকার। এবং অবশেষে আবার তালেবান। এরাও কতদিন থাকবে, তা সুনিশ্চিত নয়। অস্থিরতার দোলাচলে এখনও আফগানিস্তান। অতীত বা বর্তমানের এইসব পালাবদলের ঘটনাগুলো শান্তিপূর্ণ ছিলনা। রক্ত, মৃত্যু ও ধ্বংসের পথে ছিন্নভিন্ন হয়েছে সারা দেশ। পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়ার শীর্ষ শরণার্থী হয়েছে আফগানিস্তানের নাগরিকগণ। কত নারী, শিশু, আপামর মানুষ মরেছে তার ইয়াত্তা নেই। মোট কথা, যুদ্ধকবলিত আফগানিস্তানে মানুষের নিরাপত্তা নেই। এমনকি শিশুরা পর্যন্ত ওখানে ঝুঁকিতে আছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০০৫ সালের পর থেকে ২৮ হাজার ৫০০-এর বেশি শিশু হতাহত হয়েছে। এক প্রতিবেদনে তথ্যটি জানিয়েছে ইউনিসেফ। একক দেশ হিসেবে আফগানিস্তানে শিশু হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। এ সময় স্কুল ও হাসপাতালে শিশুদের ওপর হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে এমন হামলা হয়েছে ২২টি।

দক্ষিণ কোরীয় লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক জুন ইয়ুথ কাওন এশিয়া টাইমসে লিখেছেন, ‘এশিয়ার চার বাঘ’ খ্যাত দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছে হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। সমপ্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র‌্যাঙ্কিংয়ে সিঙ্গাপুর অন্য দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজনেস স্কুল আইএমডির র‌্যাঙ্কিং এমনটা জানাচ্ছে। একেকটি দেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং নাগরিকদের কল্যাণ কর্মসূচি বৃদ্ধির পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পারছে, তা বিশ্লেষণ করে এ ক্রম সাজানো হয়ে থাকে।

র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের উঠে আসার পেছনে দেশটির উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অনুকূল অভিবাসন আইন এবং নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ কাজ করেছে। দেশটির এই সাফল্যের পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, তার একটি ভৌগোলিক অবস্থান। বাণিজ্য-কৌশলগত দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঠিক মাঝখানে সিঙ্গাপুরের অবস্থান হওয়ায় দেশটি আশপাশের দেশগুলোর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দলটি হলো পিপলস অ্যাকশন পার্টি। ১৯৫৪ সালে একটি ছাত্রসংগঠন থেকে স্বাধীনতাপন্থী এ দলের জন্ম হয়েছিল। দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি টানা তিন দশক সরকারপ্রধান ছিলেন। এক প্রজন্মেই সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে তুলে আনার জন্য তাঁকে জাতির স্থপতি বলা হয়। লি কঠোরভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে একদলীয় শাসন ধরে রেখেছিলেন। স্থিতিশীল একদলীয় শাসন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছিল। তৃতীয়ত, সরকারি খাতে দক্ষ জনবল। সিঙ্গাপুরের মেধাবী তরুণদের মধ্যে অনেকেই সরকারি বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যান। বৃত্তিপ্রাপ্তির শর্ত অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে তাঁদের দেশে ফিরে নির্দিষ্ট কয়েক বছর সরকারি চাকরি করতে হয়। এ ছাড়া দক্ষ সরকারি কর্মীদের উচ্চ বেতন দেওয়া হয়। সরকারের আর্থিক সাফল্যের অনুপাত অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের বোনাসও দেওয়া হয়। এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও কোনো সরকারি কর্মচারী দুর্নীতি করলে তাঁকে কঠোর সাজা দেওয়া সরকারের পক্ষে নৈতিক দিক থেকে সহজ হয়।চতুর্থত, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ। তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক গ্রহণের জন্য সিঙ্গাপুরের সুনাম দুনিয়াজোড়া। এ ছাড়া বহু খাতে তারা ট্যাক্স নেয় না। লভ্যাংশ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ এবং উপহার-উপটৌকন পাওয়া কোনো কিছুর ওপর সেখানে শুল্ক দিতে হয় না। সোনা-রুপার কেনাবেচায় পর্যন্ত ট্যাক্স আরোপ করা হয় না। এ বাধাহীন লেনদেনের কারণে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

এই যে নিরাপদ আর অনিরাপদ দেশের মধ্যে পার্থক্য, সেটা নির্ণীত হচ্ছে নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে। ৯৬ স্কোর গড়ে সিঙ্গাপুর সবচেয়ে নিরাপদ দেশের স্থানে জায়গা করে নিলেও এই জরিপে বাংলাদেশ পেয়েছে ৭৯ স্কোর। বাংলাদেশের অবস্থানও আশা জাগানিয়া। আমরা চাই, পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশও সিঙ্গাপুরের মতো অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে