বিশ্বনবী : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য রাহ্‌বার

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

আন্তঃসম্প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতির দর্শন শিখিয়েছিলেন নবীকুল শিরোমনি, হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ আমার আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-মদিনা সনদের মাধ্যমে যিনি তাঁর এই দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ সনদের ৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অমুসলিমগণ মুসলিমদের ধর্মীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে না। ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে। ১২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনিই হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক। ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, নিজ সন্তান বা আত্মীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, আমরা মুসলমানগণ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর মদিনা সনদের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বেমালুম ভুলে গিয়েছি। আর এই ভুলে যাওয়ার পরিণতি হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের বিভিন্ন পূজা মন্ডপে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ইত্যাদি। এ অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? এটিতো আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সাঃ) এর জীবন দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব এই রাষ্ট্রের। এর কোন ব্যত্যয় ঘটলে কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার কাছে তার পূর্ণ জবাবদিহি করতে হবে। পৃথিবীর একমাত্র সত্য কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত আসমানী গ্রন্থ আল্‌-কুরআনকে অবমাননা করার কারণে দেশব্যাপী এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলিমদের হৃদয়ে যে বেদনার জোয়ার চলছে তা নিরসন করার অর্থ এই নয় যে, অন্য ধর্মানুসারীদের মন্দির-পূজা মন্ডপে হামলা করা, তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, তাদের প্রাণহানি ঘটানো। এটি কিছু সংখ্যক আল্লাহর কুরআন-হাদিস চর্চা না করা মানুষরূপী অমানুষদের এহেন হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড, যা সাম্যের ধর্ম ইসলামের মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করেছে আজ। আসমানের নিচে, জমিনের উপর যে সত্য ও নির্ভুল কিতাবটি আগামী কিয়ামতের কঠিন বিচারের দিনে পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির (সব ধর্ম) জন্যে মুক্তির সিলসিলা হয়ে দেখা দিবে-সে কিতাবটিকে যে বা যারা অপমান করেছে, অবমাননা করেছে- সে ঘৃণ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তির আওতায় আনা রাষ্ট্রের ঈমানী দায়িত্ব। এতে কোন গাফেলতি দেখা দিলে সেই কঠিন বিচারের দিনে রাষ্ট্রকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে- এটাই বিশ্বস্রষ্টা, আরশে আজিমের মালিক আল্লাহ যাল্লাহ শানুর কঠিন ঘোষণা। আল্লাহতায়ালা সূরা আল হেজর এর ৯ নং আয়াতে স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘অবশ্যই আমিই উপদেশ (সম্বলিত কোরআন) নাযিল করেছি এবং আমিই তার সংরক্ষণকারী’। অতএব এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়- আল্লাহর কোরআনকে কেউ অপমান করার দুঃসাহস দেখালে তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। ১৪০০ বছর আগেই সূরা- বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘(আল্লাহর) দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই, (কেননা) সত্য (এখানে) মিথ্যা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে, অতঃপর কোনো ব্যক্তি যদি বাতিল (মতাদর্শ)-কে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শের) ওপর ঈমান আনে, সে যেন এর মাধ্যমে এমন এক শক্তিশালী রশি ধরলো যা কোনোদিনই ছিঁড়ে যাবার নয়; আল্লাহতায়ালা (সব) শোনেন (এবং সব) জানেন’। অতএব এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোন ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কিংবা জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করার আদেশ আল্লাহতায়ালা দেননি। কিন্তু একমাত্র সত্য ধর্ম এবং গ্রহণযোগ্য দ্বীন যে ইসলাম তার অকাট্য দলিল এই আয়াতে বিধৃত হয়েছে। কারণ, আল্লাহযাল্লাহশানু কর্তৃক প্রেরিত ধর্ম ইসলাম যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য বিধান তা পবিত্র কোরআনের পাতায় পাতায় বিধিবদ্ধ রয়েছে। সূরা আল ইমরানের ৮৫ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যদি কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো জীবন বিধান অনুসন্ধান করে তবে তার কাছ থেকে সে (উদ্ভাবিত) ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না, পরকালে সে চরম ব্যর্থ হবে’। যে যাই বলুক না কেন পৃথিবীর কোন ধর্ম, কোন তন্ত্র-মন্ত্র, কোন মতাদর্শ, কোন বাদ-মতবাদ আল্লাহর কাছে গৃৃহীত হবে না একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলাম ছাড়া। ‘নিঃসন্দেহে (মানুষের) জীবন বিধান হিসেবে আল্লাহতায়ালার কাছে ইসলামই একমাত্র (গ্রহণযোগ্য) ব্যবস্থা’- সূরা- ইমরান- ১৯। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘তিনিই হচ্ছেন মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে (যথার্থ) পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনবিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে তিনি (দুনিয়ার) অন্য সব বিধানের ওপর একে বিজয়ী করে দিতে পারেন, (সত্যের পক্ষে) সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে আল্লাহতায়ালাই যথেষ্ট’- সূরা আল ফাতাহ্‌-২৮। এখানে আল্লাহর সত্য দ্বীন সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অন্য কোন ধর্মের ধর্মগুরুর দরকার নেই, অন্য কোন ত্রাতার দরকার নেই- এজন্য আমার আল্লাহতায়ালাই একমাত্র সাক্ষ্যদাতা। দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, এই নির্মম সত্য কথাটুকু মুসলমান নামধারী অনেকেই বুঝি না, বুঝার চেষ্টাও করি না। আর এভাবেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে আমরা ঈমানহারা হয়ে যাই। আর ধীরে ধীরে মুশরিকদের কাতারে সামিল হয়ে যাই।
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্‌ থেকে বর্ণিত: তিনি বলেছেন- একদা আমাদের নিকট দিয়ে একটি জানাজা যাচ্ছিল। তা দেখে রাসূলুল্লাহ (স.) উঠে দাঁড়ালেন। তখন আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। পরে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)- এ তো ইহুদির জানাযা। তিনি বললেন, তোমরা যে কোন জানাযা যেতে দেখলেই দাঁড়িয়ে যাবে এবং তিনি আরো বলেছিলেন, তা কি মানবদেহ নয়?- (সহীহ্‌ বোখারী- ১২২৫, ১২২৬)। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, অন্য ধর্মের প্রতি কোন অসম্মান করা যাবে না। তাদের ধর্মের ব্যাপারে কোন অশোভন আচরণ করা যাবে না। এটাই ছিল আমার রাসূল (সাঃ) এর অন্যতম দর্শন। ভিন্ন ধর্মের পন্ডিতরা যতই বলুক না তাদের নিজ নিজ ধর্ম শ্রেষ্ঠ কিন্তু তা মাকাল ফল হয়ে দেখা দিবে সেই কঠিন হাশরের দিন। কারণ, পৃথিবী একটা পরীক্ষাক্ষেত্র। এখানে সর্বত্র পরীক্ষা চলছে। ফলাফল হবে হাশরের দিন। তখন আর পালাবার পথ থাকবে না কারো। কারণ একমাত্র এবং একমাত্র সত্য ধর্মই হচ্ছে ইসলাম, যা আল্লাহতায়ালাই তাঁর কুরআনুল করীমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ছিলেন রাহ্‌মাতুল্িলল আ’লামিন- তিনি বিশ্বের সকল মানুষের রাসূল (স.), কোন বিশেষ গোষ্ঠীর রাসূল (স.) নয় অতএব সর্বশেষ নবী হিসাবে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে তাঁকেই মানতে হবে-এটাই সর্বজনবিদিত সত্য ও কোরআন-হাদিস দ্বারা স্বীকৃত ও প্রমাণিত। অতএব আামাদের আদর্শ ও চরিত্র হতে হবে সেই রাসূলের (স.) মতন যাঁর কথা এখনো ব্রিটিশ মিউজিয়ামের শরীরে পাথর খোদাই করে রাখা হয়েছে, ‘as a father, as a leader, as a social reformer, as a law maker, as a politician, Hazrat Mohammad (sm) is the superman of the world।’ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম, অন্য কোন জীবন বিধান, অন্য কোন মতবাদ, অন্য কোন মূলনীতি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিদায় হজ্বের ভাষণে মহানবীর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘আরব-অনারব, সাদা-কালো তে কোন ভেদাভেদ নেই, নেই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য। তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম মাটির তৈরি। অকারণে কাউকে হত্যা করাও নিষেধ করেছেন আল্লাহতায়ালা, ‘কোনো মানুষকে হত্যা করা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ (করার শাস্তি প্রদান) ছাড়া (অন্য কোনো কারণে) কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো, (আবার এমনিভাবে) যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো’- সূরা মায়েদা- ৩২। অতএব যারা আল্লাহর কোরআনকে অপমান করেছে, অপদস্ত করেছে তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা সময়ের দাবি, যুগের দাবি, ৯০% মুসলমানদের দাবি আর শুধুমাত্র এক ব্যক্তি কিংবা একটি চক্রের কারণে অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে হামলা, অগ্নি সংযোগকারীদেরকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা স্বাধীন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
লেখক : সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌,আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধএক সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের সংখ্যা ও হার বেশি চট্টগ্রামে