বিবেকের কণ্ঠস্বর

নিজামুল ইসলাম সরফী | মঙ্গলবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এই জনপদের একজন শুভ্র বিবেকের কন্ঠস্বর, অবিস্মৃত বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান। শুভ্র বিবেক খ্যাত, সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ, চেতনার বাতিঘর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (৬ জুলাই ১৯২২-২১ ডিসেম্বর ২০০৩) বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক। যিনি চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। আগামী বছর ২০২২ সালে জন্মশত বার্ষিকী হবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ১৯৬২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ছিলেন, পরে তার সুযোগ্য উত্তরসূরী সম্পাদক হিসেবে এখনো স্বমহিমায় আছেন রম্য লেখক, লায়ন্সের সাবেক গভর্নর এম এ মালেক। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ৭ মার্চ ১৯৭৩ থেকে ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ মেয়াদ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ৬ রাউজান আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২২ সালের ৬ জুলাই তিনি ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় পিতা আবদুল হাদী চৌধুরীর কর্মস্থলে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর দারোগা বাড়ি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তিনি একজন অন্যতম নীতি নির্ধারক ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হলেও পারিবারিক কারণে সেখানে পাঠ সমাপ্ত না করে চট্টগ্রামে এসে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাউজান-হাটহাজারী আসন থেকে জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সংবিধান প্রনয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রনয়ণে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলার গভর্নর নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম ও কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সংগঠনে ভূমিকা রাখেন।
রাউজান স্কুলে শিক্ষকতা, নাজিরহাট কলেজে অধ্যাপনা, গ্রীন্ডলেজ ব্যাংকের চাকরি প্রভৃতি জীবনের বাস্তবতায় কঠিন সংকটের মধ্যেও আদর্শ থেকে ন্যূনতম বিচ্যুত না হয়ে সৎ ও নির্মোহ জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন জাতির বিবেক। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাঁকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মহাত্মা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করেছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রতিবছর অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করেন। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রচনা করেছেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক রাশেদ রউফ। পিতার পদাংক অনুসরণ করে সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছেন সাপ্তাহিক স্লোগান সম্পাদক মোহাম্মদ জহির। ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর এই ন্যায়নিষ্ট শুভ্র বিবেকের কন্ঠস্বর, বাংলাদেশের প্রবীণতম সম্পাদকের জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া আদর্শ, কর্ম ও সততার উদাহরণগুলো নতুন প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে আরো অনেক কাল ধরে। আশা করছি জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবনের আরো অনালোচিত বিষয়গুলো সামনে এনে তাঁর স্মরণে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মানুষেরা চট্টলার এই বিরল বরেণ্য রাজনীতিক, সমাজসেবক, সাংবাদিকের স্মৃতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদনে এগিয়ে আসবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, আয়কর পেশাজীবী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোহাম্মদ খালেদ : চেতনার বাতিঘর
পরবর্তী নিবন্ধসেই শিক্ষা ভুলিনি-ভুলব না