বিবর্ণ বিকেল

নাসের রহমান | শুক্রবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৩ at ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ

মামুনের কোনো কাজ নেই। সময় কাটে না। কাজে থাকতে সময় কোনদিকে চলে যেতো টেরও পেতো না। ঘড়ি ধরে চলতে হতো। একটার পর একটা কাজ সময়মতো শেষ করতে হতো। কোনোএকটাতে আটকে গেলে কাজের জট লেগে যেতো। জট একবার লাগলে আর সহজে ছুটতো না। মাথা ঠান্ডা রেখে জট খোলার চেষ্টা করতো। সময়মতো কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে যেতো। এখন আর এসব কিছুই নেই।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবে, কী করবে? কোনদিকে যাবে? সবাই কাজে ব্যস্ত থাকে এ সময়। কেউ সময় দিতে চায় না। দুয়েক জায়গায় গিয়েছে। কুশল বিনিময় হয়েছে। কিন্তু কেউ সময় দিতে পারেনি। আলাপের সময় নেই কারো। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। বাইরের কেউ এলে কাজ সেরে আবার চলে যাচ্ছে। বসে কথাবার্তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সবাই যেন একটা গতির মধ্যে থাকে।

অনেকেই তো অবসরে যায়। তাদের সময় কী করে কাটে? কাজের ভেতর থেকে হঠাৎ করে কাজ ছাড়া থাকা অনেকটা কঠিন। কেউ বলে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করতে, কেউ বলে ধর্মকর্ম করে সময় কাটাতে। ধর্মকর্ম খানিকটা করা যায়, কিন্তু ব্যবসার কথা ভাবা যায় না। চাকরি করা লোকদের দিয়ে ব্যবসা হয় না। ব্যবসা করতে হলে ব্যবসার অভিজ্ঞতা লাগে। তা না হলে লাভ তো দূরের কথা, একসময় আসলটাও হারাতে হয়। ধর্মকর্মেও কি সহজে মন বসে? কতক্ষণ প্রার্থনায় মগ্ন থাকা যায়। সেটাও দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ব্যাপার। হঠাৎ করে কিছুই হয় না।

অনেকে পরিবারকে সময় দেওয়ার কথা বলে। ‘চাকরির জন্য আগে পরিবারকে সময় দিতে পারেন নি, এখন দেন। পরিবারের সাথে বেশি করে সময় কাটান।’ পুরো রাতটা তো পরিবারের সাথে কাটে। সকালটাও ঘরে থাকা হয়, দুপুরটাও, এমনকি সন্ধ্যাও। সারা দিনতো আর পরিবারের সাথে বসে থাকা যায় না। পরিবারও চায় পুরুষমানুষ দিনের বেলা বাইরে থাকুক। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে গিয়েছে। তারা তাদের মতো করে চলে। পরিবার বলতে আগের সে পরিবার তো নেই, যেখানে সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে।

মামুন সকালে নাস্তা করে প্যান্টশার্ট পরে আগের মতো বের হয়ে যায়। তবে তাড়াহুড়া করে না, ধীরে ধীরে বের হয়। রাস্তায় নেমে এদিকওদিক তাকায়। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। এসময়ে অফিসগামী লোকেরা অফিসে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে যায়। সবাই ব্যস্ততার মধ্যে চলে। সে ধীরপায়ে হাঁটে। ফুটপাতের পাশের গাছগুলো এখন অনেক বড় হয়েছে। ডালপালা আর পাতায় ছেয়ে আছে। কিছুদূর পরপর গাছের ছায়া এসে পড়েছে। এসব কেউ দেখে না। সেও আগে কখনো দেখেনি। এখন দেখছে। খানিক ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লোকজন যেভাবে চলাচল করছে, এখানে দাঁড়ানো যায় না।

হাঁটতে হাঁটতে সে যেকলেজটিতে পড়েছে সেটির পাশে চলে আসে। উঁচু ওয়াল দিয়ে কলেজটি ঘেরা। আগে এরকম উঁচু ওয়াল ছিল না। এত বড়ো গেইটও ছিল না। তবে আগের গেইটটা বিশেষ ধরনের একটা গেইট ছিল। যা কলেজটির মতো একরকম ঐতিহ্য বহন করতো। সময়ে অনেক কিছু বদলে যায়। এ কলেজেরও অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। উঁচু উঁচু ইমারত গড়ে উঠেছে। বড়ো বড়ো গাছগুলোর এখনও বেশ কয়েকটা আছে। পড়ালেখার কলেবরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। তবুও কলেজটা এখনও নিজেদের মনে হয়। ভাবতে ভালো লাগে, এ কলেজে সে একসময়ে পড়েছে। কলেজটির পাশে এসে দাঁড়ালে কত কথা মনে পড়ে যায়। সেসব দিনে আর কখনো ফিরে যাওয়া যায় না।

কলেজমসজিদ থেকে যোহরের আযান কানে ভেসে আসে। এসময়ে কলেজে ঢোকা যায় মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য। ঢোকার পর তার মনটা হঠাৎ হালকা হয়ে যায়। পুরানো পথ ধরে হাঁটতে থাকে। পথগুলো আগের মতো নেই। তারপরও ভালো লাগে। মসজিদের কাছে এসে ওজু করে নেয়। মসজিদে ঢুকে দেখে, মসজিদও আগের চেয়ে বড়ো হয়েছে। জামাতে নামাজ আদায় করে। আগেকার ইমামমুয়াজ্জিন এখন আর নেই। ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী অনেকে নামাজ পড়েছে। কেউ তাকে চিনে না। কারো সাথে তার পরিচয় নেই। একসময় সবাই চিনতো। এখন তারা কেউ নেই। এটাই নিয়ম। একটা সময়ের পর কেউ কাউকে চিনে না। সময় অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। এমনকি সবকিছু।

সে এবার বাসার দিকে পা বাড়ায়। বাসায় এসে ভালো করে গোসল করে নেয়। দুপুরের খাবার খেতে বসে। লাঞ্চটা সে সবসময় অফিসে সারতো। বন্ধের দিন বাসায় দুপুরে অনেক আয়েশে খাওয়া হতো। এখন সেই আয়েশ আর পাওয়া যায় না। খাবারের মেন্যু কিন্তু আগের মতো আছে। কোনো আইটেম কমেনি। তবু ছুটির দিনের আমেজটা আর ফিরে আসে না। ছুটির দিনও আর কখনো ফিরে আসবে না। প্রতিদিনই একই নিয়মে একই রকমে চলতে হবে।

দুপুরে খাওয়ার পর অনেকে হালকা বিশ্রাম নেয়। কেউ কেউ ঘুমিয়েও নেয়। মামুনের এধরনের অভ্যাস নেই। দুপুরে অফিসে লাঞ্চের সময়ও পেতো না ঠিকমতো। তাড়াহুড়োর মধ্যে লাঞ্চ সারতে হতো। বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস এখন আর বদলাতে পারছে না। চেষ্টা করেও দিনের বেলায় ঘুমাতে পারে না। শুয়ে থাকলে অস্বস্তি বোধ করে। এখন বিকেলটা কী করে কাটবে? টিভিতেও সংবাদ ছাড়া অন্য কিছু দেখে না। চ্যানেলগুলো একই সংবাদ বারবার প্রচার করে। টিভিতে নাটক দেখা বা গান শোনা কিংবা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখা এসবেও মন বসাতে পারে না। টকশোতেও একই কথা ঘুরে ফিরে বলে মনে করে।

এখন মোবাইলের যুগ। অনেকে মোবাইলে সময় কাটায়। দেখার মতো অনেক কিছু আছে। এ স্ক্রিনের ভেতর ঢুকলে সহজে বের হওয়া যায় না। জগতের সবকিছু এখন মোবাইলে পাওয়া যায়। কিন্তু অত্যাধুনিক এডিভাইসটা মামুনকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। ফেইসবুকও সে খুব একটা ব্যবহার করে না। এসবের প্রতি তার আকর্ষণ নেই বললে চলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চায় না। সে মনে করে মোবাইলটা তৈরি হয়েছে কথা বলার জন্য। এর বাইরে মোবাইলের অন্য কোনো অপশনে যেতে চায় না।

আগে আত্মীয় স্বজনের বাসায় যাওয়ার সময় হতো না। এখন তাদের খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে। কোনোকোনো আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছে। ওরা আপ্যায়নও করেছে। তবে চাকরির সময় যে গুরুত্ব পাওয়া যেতো তা এখন আর নেই। আলাপের প্রসঙ্গও তার কাছে ভালো লাগেনি। কথায় কথায় অন্যের সমালোচনা। আরেকজনের ভালোমন্দ খুঁজে বেড়ানো। এসব মামুনের কখনো ভালো লাগে না। সে কখনো এরকম আলাপ করে না। এখনও এর থেকে দূরে থাকতে চায়। স্ত্রীর সাথেও এসব নিয়ে আলাপ করে না। প্রসঙ্গ এলে এড়িয়ে যায়। স্ত্রী তখন বলে, ‘তোমার মতো মানুষ তো আরেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারো সাথে সহজে মিশতে পারো না। সামাজিকতাও রক্ষা করতে চাও না। একা একা নিজের মধ্যে থাকতে চাও।’

মামুন মনে মনে বলে, ‘সেই তো ভালো। সবাই নিজের মধ্যে থাকে। কেউ কখনো কারো মাঝে ডুবে যায় না। ডুবলেও খুব সাময়িক। আবার যার যার জায়গায় ফিরে যায়। তাই নিজেকে নিয়ে থাকতে পারলে ভালো। আর সামাজিকতা? সে তো তুমি রক্ষা করে চলছো। সবার সাথে সামজিকতাও করে আবার সমালোচনাও করো। এরকম সামাজিকতা আমি কখনো করতে পারি না। এ জন্য আমি দূরে থাকি। কারে সাথে বেশি মাখামাখি করি না।’

বিকেলে মামুন ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ভাবে, কোনো একটা পার্কে গিয়ে বসবে। সময় কাটাবে। পার্কগুলো নাকি আগের মতো নেই, নিরিবিলি বসা যায় না। এখন অনেক ভিড় হয়। বিকেলে অনেকে এসে ভিড় জমায়। ছেলেমেয়েরা তো আছে, একসাথে বড়ররাও পার্কে ঘুরে বেড়ায়। এরাও একসময় অনেক গিয়েছে। স্ত্রীছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এখন সেসব দিন স্মৃতি হয়ে ভেসে ওঠে। হঠাৎ মাথায় আসে সিআরবিতে গিয়ে বসলে কেমন হয়। জায়গাটা অনেক বড়। এখনও সবুজে সবুজে ভরে আছে।

আর দেরি করে না। সিআরবিতে চলে আসে। এখানে এসে মনটা হালকা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ওপাশের একটা জায়গায় বসে পড়ে। তবে একেবারে নিরিবিলি জায়গা এখানেও নেই। নানা বয়সের লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। তরুণতরুণীদের সংখ্যা বেশি। তারা কয়েকজন মিলে আনন্দের হাঁটা হাঁটছে। এসময়টা তাদের আনন্দের। কয়েকজন একত্র হলে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কারণেঅকারণে হাসে। এদেরকে দেখে মামুনেরও হাসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ওদের মতো করে হাসতে পারে না।

নিচের গ্রাউন্ডে ছোটছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। খেলায় আম্পায়ার কেউ নেই। নিজেরা খেলছে, আবার নিজেরাই রানের হিসাব রাখছে। দুই এক রান করে খেলা এগিয়ে চলেছে। কখনো চার রান তুলছে। আবার কখনো ছক্কা মেরে বলকে উপরে তুলে দিচ্ছে। হঠাৎ ছক্কা মারা একটি বল মামুনের কাছে এসে পড়ে। গড়িয়ে কিছুটা দূরে চলে যায়। ছেলেরা চিৎকার করে বলে, ‘আংকেল বলটা একটু নিচের দিকে ফেলুন’। মামুন বসা থেকে উঠে বলটা হাতে তুলে নেয়। তারপর গ্রাউন্ডের দিকে নিক্ষেপ করে। একটা ছেলে লাফ দিয়ে বলটা ধরে ফেলে। অনেকটা ক্যাচের মতো করে বলটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। আশেপাশের অনেকে এতে আনন্দ পায়। কেউ কেউ হাততালি দেয়। তখন মামুনের কানে এসে বাজে, ‘আংকেল আপনি ওখানে বসেন। আমাদের বল গেলে নিচের দিকে ছুঁড়ে মারবেন।’ ছেলেদের কথাটা মামুনের মনঃপুত হয়।

তখন থেকে সে প্রতিদিন বিকেলে এখানে এসে বসে। খেলার বলটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন বলটি তার কাছে আসে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেড় হাজার কোটিতে বিক্রি হলো পিকাসোর আঁকা প্রেমিকার ছবি
পরবর্তী নিবন্ধতিন নম্বর কেবিন