বিধু বাবুর দোকানদারি

তানভীর পিয়াল | শুক্রবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

প্রত্নের গা খুঁটে আমরা জেনে নিচ্ছি অতীত, আমাদেরই। আমাদেরই কেউ লিখে রেখেছিলো নিজেদের। অমরত্বের বাসনাই হবে হয়তো। এবাসনার বয়সও তাহলে কম হলো না! এখনও কেমন বেঁচে আছে দেখো। তাই হয়তো লিখছি আমরা, ক্রমাগত, নিজেকে, নিজেদের। সূর্যের মহাকাল যাত্রায়, আলোআঁধারের

 

ক্রমিক ক্যালেন্ডারের কোনো এক পৃষ্ঠায় হঠাৎ উদ্ভব হচ্ছে আমাদের, আগে বা পরে। আবার কয়েক পৃষ্ঠা পর নেই হয়ে যাচ্ছি। অনেকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, গোল হয়ে বসা হচ্ছে; কারো শুধু ছবি দেখছি, কারো বা ছবি আঁকা হচ্ছে মনে। সে ছবি এঁকে দেয় আখ্যান, আমাদেরই লেখা। যেভাবে পাথরে লিখে রাখতাম, আজ

যেভাবে লিখে রাখছি কাগজে, আননকাননে। এরকমই আখ্যনের পসরা রয়েছে বিধু বাবুর দোকানে, যে দোকানে বসে আছে আমাদের সৈকত, ডেবার পাড় নিবাসী সৈকত দে। চোখে কড়াকাঁচের চশমা আঁটা, নানাপ্রকার অমনোনয়নের গ্লানি গায়ে লেপ্টে সচেতন হয়ে গাঁট বসে আছে ও।

বিধু বাবু বস্তুত চলে যাওয়া সময়ের মানুষযিনি নিজের অভিযোজন ঘটাতে পারেন নাই এই সময়ের সাথে। তিনি স্মৃতির ভেতরে থেকে যাওয়া একজন। আমাদের সকলের ভেতর একজন বিধু বাবু তার দোকান খুলে বসে থাকেন, পসরা সাজিয়ে, মৃদু আলো জ্বেলে।’

আমাদের স্মৃতিই আসলে এই বিধু। তবু, তার দোকান কেবলই বিগত সময়ের আয়োজন নয়। এন্টিক শপ তো নয় মোটেই। এ দোকানে চকলেটের বয়ামের মতো চোখ টাটানো উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের বর্তমানও। সমূহ বর্তমান আদতে অতীতই, দিনশেষে স্মৃতি, অনাগতএই যা। এক বারোয়ারি চরিত্র নিয়ে

দাঁড়িয়ে বিধুর দোকান, আর বয়ামগুলোতে ঘুরে ঘুরে উড়ে এসে বসে সাধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্মৃতিভারাক্রান্ত মাছি। সামনের জনাকীর্ণ পথে চলে যাচ্ছে পার্টির মিছিল, সিনেমার দিনলিপি, লিটলম্যাগ সম্পাদক আর পুস্তক প্রকাশকের প্রতারণা।

একদিন দেখলাম, চুমু খেতে গেলে চশমা খুলে নিলে সুবিধা, নইলে সেটা আশ্লেষে পরিণত হয় না। চেহারার মধ্যে একটা ইন্টেলেকচুয়াল ভাব আনতে চশমা অনিবার্য, এদিকে মায়ের আদরের উৎপাতে চুল বাটি ছাঁট রাখতেই হবে, ওয়েস্টার্ন ফিল্মের মতো রাবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বাঁধার অনেক শখ ছিলো। দুঃখের বিষয়বাটি ছাঁট চুল, ক্লিন শেভড গাল আর চশমা আমার চেহারার যৌন আবেদন বাতিল করে আমায় এক ভেতো বাঙালি করে দিলো।’

আমাদের কনজিউমারিজম ঘষা মনে আবেদনময়তার পশ্চিমা প্যারাডাইমটিকে খুঁটি ধরে স্মৃতির দেয়াল তুলে ঘর গড়েছে সৈকত, আর নিজের বাতিল হয়ে যাওয়াটুকু সে ঘরের আসবাব। ডালপালা মেলে তাতে নুয়ে আসে যাপিত জীবন। ব্যক্তি সৈকতের বেড়ে ওঠার সাথে একীভূত হয়ে যায় আমাদের শহর আর

তার ছোট ছোট ছবি, টুকরো দৃশ্য, সহনাগরিকদের নাম আর ইতিহাস। এসব, বলা বাহুল্য, ব্যক্তির গায়ে লেগে থাকা ধূলোময়লার মতো, ঝাড়তে হয় তবেই বেরিয়ে আসে, এসে পড়ে পায়ের কাছে, তুলে নিতে হয়; সনতারিখ আর শাসনামলের ক্লেদক্লিষ্ট ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আমরা যেভাবে হাতে তুলে নিই

জার্নাল, দিনলিপি এমনকি ভ্রমণকাহিনীও, কেবল সত্যের সন্ধানে। সত্য, যে সত্য ব্যক্তির নিজের, যে সত্য ব্যক্তির যাপিত। কেননা, সত্য আদতে নিরপেক্ষ কিছু নয়। সম্ভাব্য সকল দৃষ্টিকোণেই কিছু না কিছু সত্য থাকে। আমরা তাদেরই খুঁজি বারবার, প্রত্নের গায়ে কিংবা কাগজে ছাপা কালিতে। বিধু বাবুর দোকানে ‘ভান ও ছলনামুক্ত’ কিছু সত্য লেখা রইলো এইসব প্রসঙ্গে। থাকার মধ্যে আরও রইলো আমাদের বিধু বাবু আর সৈকতের দোকানদারি।

আমার মনে পড়ে, মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞানের স্থিতিস্থাপকতা অধ্যায়ের একটি সূত্রপীড়নের ফলে বিকৃতি ঘটে। অবস্থাদৃষ্টে দেখছি প্রাণহীন পদার্থ এবং সপ্রাণ মানুষ দুইয়ের ক্ষেত্রেই এটি খাটে। স্ল্যাং থামানোর জন্য যত বেশি চেষ্টা হবে ততই তা ছড়িয়ে পড়বে পাবলিক ইউরিনালের দেয়ালে যৌন দুর্বলতার ওষুধে ফ্যাকাশে বিজ্ঞাপনের পাশে সচিত্র, কখনো তা আকাঙ্ক্ষার উল্লাস ও বরাভয় কখনো রাষ্ট্রনির্মিত নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে চেতাবনি।’

আমরা ধরে নিতে পারি, সৈকত মানবজাতির ইতিহাসকে নিজের জীবনেরই অংশ বিবেচনা করে। আমরা বুঝে নিতে পারি, মানবজাতির ইতিহাস যে পথে রচিত হচ্ছে তার প্রতি এক ভীষণ মায়াভরা বিরক্তি সৈকতের। ফলে, একদিকে যেমন কফি কিংবা জিন্স কিংবা আয়নার ইতিহাস লিখছে ও, তেমনই যুদ্ধ, শোষণ ও

বঞ্চনার ইতিবৃত্তও তার কলম এড়ায় না। নিরেট সমাজতাত্ত্বিক মন্তব্য যেমন রয়েছে, একইসাথে রয়েছে ব্যক্তিগত স্মৃতিকল্পনার প্রলেপও। তাই তো জিন্স নিয়ে লিখতে গিয়ে থেকে থেকে আসে বাল্যনায়ক রুবেল কিংবা কিশোরবেলার প্রেম তানিয়া আফরিন। প্রেমিকাকে লেখা চিঠিতে গিয়ে কী করে চলে আসে কফি, সুফিবাদ, থিও এঞ্জেলোপুলুসতাও দেখতে পাবো আমরা।

অপমান জিনিসটা সারাজীবন হাড় মাংসের উপর দিয়ে বয়ে যায় যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের। যিনি সহ্য করতে পারেন তিনি থেকে যান, সৃজনের শস্যে আরেকটু পূর্ণ হয়ে ওঠে এই ধোঁয়াধূলিবালিগালিমাখা সভ্যতা। নইলে তিনি অকালপ্রয়াত মেধাবী হন।’

বিধু বাবুর দোকান কি কেবলই ব্যক্তিগত লেখাজোকা, স্মৃতির ভার? সৈকতও মরে যাবে একদিন, রীতিমতো, যেভাবে আর সকলেই যায়, কেবল এইসব লেখাপত্তর রয়ে যাবে। সৈকতের সেইসব না থাকার দিনগুলোতে কেউ হয়তো ওর এই বিধু বাবুর পাতায় চোখ রাখবে, যেভাবে আমরা তাকাই গুহার বাইসন কিংবা পিরামিডের হাইরোগ্লিফে।

যদিও অতোখানি মহত্বগুরুত্ব আরোপ অত্যুক্তি, তবু, উদ্দেশ্য তো সেইবিগত সময়ের পাঠোদ্ধার। যে সময়ের যাপন সৈকতের, কই আর কেউ তো এখনো লিখলো না সেই কথাগুলো। যে মোড়ে সৈকতের মতো আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে চা খেয়েছে, কেউ কেউ সিগারেটও, ওরা তো সেইসব ধোঁয়া ওড়ানোর স্মৃতিটুকু লিখলো না। পাতা ওল্টাতেই নতুন সময়ের পাঠক দেখতে পাবে সৈকতের হাতের স্পর্শে সজীব হয়ে ওঠা মৃত সময়ের ছবি; সৈকতের সঙ্গে মারা যাবে যে সময়গুলোও। আর, কে না জানে, মৃত সময়ের স্মৃতিই আদতে ইতিহাস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিটুকু থাক
পরবর্তী নিবন্ধরাঙামাটিতে বাসা থেকে অজগর উদ্ধার, অবমুক্ত করল বন বিভাগ