বিজয় সূর্য

দীপক বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

তখনও সূর্য উঠেনি। পাখি ডাকছে। বাইরে টগবগে অন্ধকার। তোরাব আলী চেয়ারম্যান ঘুম থেকে উঠে কাইয়ুমকে ডাকে। বড় গলায় নয়, নীচু গলায়। অন্যকারো ঘুম যেন না ভাঙে। উনি গাঁয়ের চেয়ারম্যান, সবাই ভয় পায়। ধরাজ গলা, সুঠাম দেহ, আধপাকা চুল, গাল ভর্তি দাড়ি। ভয় পায়না নাসিমা খাতুন। চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় বউ।
বড় বউ গত হয়েছে, গতবছর। বড় বউয়ের এক ছেলে। নাইনে পড়ে। নাসিমার সন্তান নেই। বয়স কম। সুন্দরী। সেলিমকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করে, ভালোবাসে।
কাইয়ুম ঘুম চোখে দৌঁড়ে আসে।
কাজের ছেলে। কাইয়ুম ছাড়া আরো পাঁচজন চাষের লোক আছে। কাজের মেয়ে তিনজন। এরপরেও নাসিমার কাজের মেয়ের দরকার হয়।
দেড়শ একর জমি তোরাব আলী চেয়ারম্যানের। হাটে দোকান আছে চারটা। তেলের, মুদির, ঔষধ এবং চাউলের। বিত্তশালী। প্রভাব শালী। বয়স কম হলেও দু’ দুবারের চেয়ারম্যান সে।
কাইয়ুম বিশ্বাসী একজন কাজের লোক। তার উপর ভরসা করা যায়। কাইয়ুমকে কাছে ডাকে। কানেকানে ফিসফিস করে বলে,
-আজ, অনেক পাঞ্জাবী সেনা আসবে বাড়িতে। খাবে। বড় ছাগলটা জবাই করতে হবে। দশটা মুরগীও। এবার আর ভয় নেই মুক্তিবাহনীকে। আমাকে কমান্ডার বলেছে অস্ত্র দেবে। প্রয়োজনে পাঞ্জাবী সেনাও দেবে।
-কী বলেন চাচা! অস্ত্র দেবে ঠিক আছে, পাঞ্জাবী সেনা দেবে! এটা কী করে হয়? গাঁয়ের চারিদিকে, পাহাড়ে, বনে মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি। রাতে আপনার ঘুম আসেনা। পাঞ্জাবী সেনা থাকবে? আর চাচীজান শুনলে কী করবেন।
নাসিমা খাতুনের আব্বা একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। এখন গ্রামে নেই। পাহাড়ে লুকিয়ে আছে। সময়সুযোগে গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধার সাথে বাড়ি আসে। খবর নেয়।
নাসিমার স্বামী জামায়াত নেতা। তাঁর বাপ, দাদাও তাই ছিলেন। কী ভেবে আওয়ামীলীগ নেতার মেয়ের সাথে বিয়ে হলো!
-ধুত্তুরি, তোর চাচীজানে শুনলে কিছুই হবেনা। একটু রাগ করবে। তোকে যা বললাম কর।
ঘরে বাইরে সবসময় তোরাব আলীর সাথে নাসিমার ঝগড়া হয়। শুধু ঐ পার্টি নিয়ে। নাসিমা ভীষণ ভালোবাসে চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যানও প্রচণ্ড ভালোবাসে বউকে।
ছাগল, মুরগী জবাই, এসব হইচই নাসিমার কানে বাজে। ফুলমিকে বলে,
-চেয়ারম্যান কোথায়? বাইরের উঠোনে এত হইচই কেন?
-জানিনা চাচী। কাইয়ুম ভাই জানে।
-কাইয়ুমকে ডাক।
ফুলমি ছুটে যায়। উঠোন জুড়ে মানুষ। সবার মুখে একটি কথা, পাঞ্জাবী আসবে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজতে। তাই ওদের জন্য রান্না হচ্ছে। গরু ঘরের পিছনে রান্নার প্যান্ডেল তৈরি করেছে। সেখানে রান্না হচ্ছে।
চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে আছে। সাথে তের চৌদ্দ জন রাজাকার। হাতে রাইফেল, লাঠি, কিরিচ। অনেক চেয়ার সাজানো। চেয়ারম্যানের মুখে হাসি।
তখনই ফুলমি ডাকে, এ্যই কাইয়ুম ভাই, তোমাকে চাচী ডাকছে। চেয়ারম্যান শুনে ফুলমিকে বলে,
-কে ডাকছে কাইয়ুমকে?
-চাচীজান।
-কাইয়ুম যা, তোকে তোর চাচী আম্মা ডাকছে। ভয়ে ইতিউতি করে চেয়ারম্যান। কী বলে নাসিমা, কে জানে!
কাইয়ুম মাথায় হাত রেখে বলে,
-চাচী আম্মা আমাকে ডাকছেন?
-হ্যাঁ, উঠোনে কী হচ্ছে, এত হইচই কিসের?
কাইয়ুম ভয়ে কথা বলে না। চুপ।
নাসিমার গলার শব্দ বড়ো হয়। রেগে বলে,
-কী, কিছু বলছিস না কেন?
ভয়ে কাঁপা গলায় কাইয়ুম বলে,
-পাঞ্জাবী সেনা আসবে। এখানে খাবে। তাই রান্না হচ্ছে।
-ওরা কিসের জন্য আসবে?
-মুক্তিযোদ্ধা ধরতে।
নাসিমা কাইয়ুমের কথায় অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে,
-আট মাসতো যুদ্ধ চলছে। চারিদিকে পাক সেনা মরছে, রাজাকার, আলবদর মরছে। পারবে পাকসেনারা? তোর কী মনে হয়?
-চাচী, এসবের আমি কিছুই বুঝি না। আপনাদের বাড়িতে থাকি। কাজ করি, খাই।
-কখন আসবে?
-আসছে।
-মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়, কে খুঁজবে?
-জানি না চাচী।
উঠোনে মানুষের শব্দ বেড়ে যায়। সবার মুখে এক কথা, পাকসেনা এসেছে দুই জীপ। কাইয়ুম ছুটে যায় উঠোনে। তখন পাঞ্জবীরা জীপ থেকে নামছে। প্রায় বিশ বাইশ জন হবে। ওদের হাতে ভারি অস্ত্র। স্ট্যানগান, এল এমজি , মর্টার, মেশিনগান, এস এলার, একে- ৪৭ রাইফেল আরো অনেক কিছু। সবাই মোটাসোটা, গোঁপদাড়িতে ভরা। লম্বা সুঠাম দেহ। চোখ টকটকে লাল। দেখতে দৈত্যের মত।
সাথে আছে রাজাকার কমান্ডার। সে উর্দু বোঝে। ভাঙা ভাঙা উর্দুতে বলে,
-চেয়ারম্যান সাহেব, মুক্তিযোদ্ধার খবর কি? জানতে চায়।
-মুক্তিযোদ্ধারা এখন পাহাড়ে থাকে। দিনে সাহস করে না আসার। রাতে কখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ভয় হয়। আমাকে চিঠিতে শাঁসিয়েছে মেরে ফেলবে।
চেয়ারম্যানের কথা কমান্ডারকে বলার পর কমান্ডার উত্তর দেয়,
-চেয়ারম্যান সাহেব চিন্তার কোনো কারণ নেই। অনেক ভারি অস্ত্র দিচ্ছি। এগুলো দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উড়িয়ে দেবে।
চেয়ারম্যান বলে,
-রাজাকারেরা এইসব অস্ত্র চালাতে জানে না। ট্রেনিং নেই। বলছিলাম, আপনাদের কিছু সেনা এখানে থাকলে ভালো হত না?
কমান্ডার ভয়ে ভয়ে বলে, না তা’ সম্ভব নয়। রাতে থাকা নিরাপদ নয়। দেশে চারিদিকে পাকসেনারা মরছে। ভারত সাহায্য করছে। যাবার আগে অস্ত্র কিভাবে চালাতে হয় শিখিয়ে দেবো।
তাড়াতাড়ি খাবার ব্যবস্থা করে পাঞ্জাবীদের। তাড়া হুড়ো খেয়ে পাকসেনারা বেরিয়ে পড়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই তখন। এসব দৃশ্য দেখে নাসিমা রেগে আগুন।
পাঞ্জবিরা যাবার পরে চেয়ারম্যান ঘরে আসে। নাসিমা কোনোও কথা বলেনা। চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকে। ভয়ে ভয়ে চেয়ারম্যান বলে,
-নাসিমা, তুমি রাগ করেছ? ওরা আসবে বলেছে। আমি না করতে পারিনি।
-রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। খাবে। আয়োজন করবে। বলে নাসিমা
হনহন করে অন্য ঘরে চলে যায়।
তোরাব আলী ভয় পায়। মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। খাবে ঠিক আছে, আমাকে মেরে ফেলবেনাতো!
একটু পর নাসিমা আবার ঘরে আসে। তোরাব আলী বিছানায় বসা। নাসিমা বলে,
-তুমি মানুষ না অন্যকিছু। মানুষ মানুষের বাড়ি পোড়ে? বাড়িতে আগুন দেয়? হিন্দুদের তাড়ায়? বাড়িহীন করে? ওরাতো এই গাঁয়ের মানুষ। এই গাঁয়ে ওদের জন্ম। ওদের জন্মস্থান। একটুও দয়া মায়া নেই। তোমার এত টাকা সম্পত্তি, টাকাকড়ি তারপরও এত লোভ। একজন মানুষের কতো টাকার প্রয়োজন, বলতে পারো?
-আমিতো আওয়মীলীগ পছন্দ করি না। ওরা হিন্দুপন্থী। আমি জামায়াত ইসলাম করি। আমার অস্তিত্ব জামায়াত। আমি বাংলাদেশ চাই না। পাকিস্তান চাই।
-ছিঃছিঃ! আমিতো না করছিনা। করো, যা ভালো লাগে। আজ রাতে ঘরে থাকবে না। বোনের বাড়ি চলে যাবে তাড়াতাড়ি। মুক্তিযোদ্ধারা আসবে, খাবে। তুমি তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে যাবে। ও হ্যাঁ, আমি বারবার বলছি, তোমার চরিত্রের উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে ওরা। তোমার অত্যাচারে গাঁয়ের মানুষ অতিষ্ঠ। রেগে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা তোমাকে মেরে ফেলবে বলেছে। আমিতো না করতে পারবো না। আমি স্বাধীন দেশের মানুষ হতে চাই। তুমিতো সেটা পারবে না। তুমি একজন রাজাকার, শয়তান।
-তুমি সত্যিই বলছো, আমাকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলবে? তুমি বাঁচাতে পারবে না?
-আমি কী করে বাঁচাবো? তুমিতো রাজাকার কমান্ডার, জামায়াত নেতা। দেশের শত্রু।
-আমার জন্য তোমার দুঃখ হবে না?
-নাহ্‌।
-কী অদ্ভুত মেয়ে? স্বামীর প্রতি মায়া মমতা নেই একটু।
-রাজাকারের উপর কার ভালোবাসা থাকে বলো। একটি কথা মনে রাখবে। তুমি রাজাকার, আমি মুক্তিযোদ্ধা। বিরাট পার্থক্য আমাদের।
ঠিক আছে দেরি করো না। মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে তাড়াতাড়ি চলে যাবে।
-আচ্ছা, নাসিমা, আমি ছাড়া তুমি থাকতে পারবেতো!
-খুব পারবো।
গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আসে। পঞ্চাশ জনের দল। কমান্ডার কানুলাল। ওদের প্রত্যেকের হাতে আধুনিক ভারি অস্ত্র, হাত বোমা, ককটেল, এল এম জি, মর্টার, মেশিনগান। পাকসেনাদের চেয়ে কম নয়! কমান্ডার উঁচু গলায় বলে,
-আপা, আজতো বিরাট পাকসেনার দল এসেছে। তোমার স্বামী খুব খাওয়ালো। অনেক ভারি অস্ত্র দিয়েছে শুনলাম। কোথায় সেই অস্ত্র। রাজাকার কমান্ডার কোথায়? চেয়ারম্যান কোথায়? দেখছি না যে। পালিয়েছে? যাবে কোথায়? সেতো বাঁচবে না।
নাসিমা খাতুন চুপ। লজ্জায় কিছু বলে না। কাইয়ুমকে খাবার নিতে বলে। মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ দলে ভাগ হয়। দশ জনে খেতে বসে, বাকী চল্লিশ জনে বাইরে, রাস্তায় পাহাড়ায় থাকে। রাজাকারদের বিশ্বাস করেনা মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার কানুলাল খেতে খেতে বলে,
-আমি অবাক হয়ে যাই। একটি পরিবার। মানুষ দু’জন। অথচ মনের মিল নেই। দুইজন দুই রকমের। একজন দেশপ্রেমিক, অন্যজন দেশদ্রোহী। দুইজনেই খাইয়ে যাচ্ছো দুইদলকে। তবে এটার পরিনাম খুব একটা ভালো নয় আপা। তবে তোমার কথা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চিরদিন মনে থাকবে। খাওয়া শেষে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যায়।
কিছুদিন পরে ঠিক বিকেলের আগে আকাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়। মেঘে নয়। প্রচণ্ড বিমান হামলায় আকাশের এই অবস্থা। বাংলাদেশে এবং মিত্রবাহিনী ভারতের এই আকাশ পথে শত্রুদের উপর আক্রমন। শুধু আকাশপথে নয়, স্‌হল পথে, নৌ পথে সবপথে আক্রমন করে শত্রুদের পরাজিত করে বাংলাদেশ ও মিত্রবাহিনী।
জয়বাংলা ধ্বনিতে সারাদেশ ফাটিয়ে পরে। নাসিমার চোখে হাসির আনন্দ। যুদ্ধ জয়ের।
পাখি ডাকে।
প্রতিদিনের মতো ভোর হয়।
নাসিমা ঘুমচোখে তোরাব আলীকে হাতে খুঁজে। পায়না। চোখ খোলে। দরজা বন্ধ। উঠে দাঁড়ায়। শোবার ঘর থেকে বাইরের ঘরে আসে। সবাইকে ডাকে। কাইয়ুম আসে কাচারিঘর থেকে। কাইয়ুমকে জিগ্যেস করে,
-তোর ভাইজান কোথায়?
-মাঝরাতে চলে গেছে। আমি হাট পর্যন্ত দিয়ে এসেছি।
নাসিমা কাইয়ুমের কথায় কিছুই বলে না। অস্পষ্ট গলায় মনে মনে কী যেন বললো।
ভোর হবার সাথে সাথে অনেক মানুষ ছুটে আসে তোরাব আলী চেয়ারম্যানের বাড়িতে। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা।
আজ ষোলই ডিসেম্বর, বিজয় দিবস।
বিজয় আনন্দে রাজাকার কমান্ডার কুখ্যাত চেয়ারম্যান তোরাব আলীকে ধরতে এসেছে ওরা। সবার সুখে হাসি, বিজয়ের।
নাসিমা খাতুন ঘরের ভেতর।
অন্তর, মুখে আনন্দ। তবে একটি অশুভ ছায়া চারপাশে ঘুরছে শুধু।
নাসিমার কেমন যেন মনে হয় একটি পাথর বুকের কাছে আটকে আছে।
একটু পরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কানুলাল আসে। সোজা ঘরে ঢুকে নাসিমার সামনে দাঁড়ায়। সহাস্যে বলে, তোরাব আলী চেয়ারম্যানকে ভোরে গুলি করে হত্যা করেছে মুক্তিবাহিনী।
নাসিমা খবরটা শুনে দাঁড়িয়ে থাকে।
তখন নাসিমার মাথার উপর একটি বিজয় সূর্য জ্বলজ্বল করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুজিব জন্মশতবর্ষ ও বিজয় ২০২১
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব