বিজয়ের মাসে আরেক অনন্য অর্জন

পূর্ণ অবয়বে স্বপ্নের পদ্মা সেতু ।। ২০২১ সালে চালু করতে চায় সরকার

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

৪১তম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে যুক্ত হলো পদ্মার দুই পাড়। এর মধ্য দিয়ে পূর্ণ অবয়বে দৃশ্যমান হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতু। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২ মিনিটে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির (পিলার) ওপর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হয়। এর মধ্য দিয়ে বিজয়ের মাসে এলো আরেক অনন্য অর্জন, বিশ্বকে নিজেদের সক্ষমতা দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ।
এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি জানিয়েছে, পদ্মা সেতু যান চলাচলের উপযোগী হতে ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত লেগে যাবে। তবে বাংলাদেশের সরকার চেষ্টা করছে, স্বাধীনতার ৫০ তম বছরের মধ্যেই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার। অর্থাৎ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন করে যান চলাচল শুরু করতে চায়।
মূল সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের বলেন, ৪১তম স্প্যানের জোড়া লাগানোর মাধ্যমে যুক্ত হলো মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত পদ্মার এপার-ওপার। স্বপ্ন আজ সত্যি হলো। তিনি আরো বলেন, এরপর দ্বিতল এই সেতুর ঢালাইয়ের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোড ও ভায়াডাক্ট প্রস্তুত করা, রেলের জন্য স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলেই পদ্মাসেতু যানবাহন চলাচলের উপযোগী হবে। ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সড়ক পথে সংযোগ ঘটবে মংলা বন্দরের। গত বুধবার বিকেলে ৩২০০ টন ওজনের ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানটি মাওয়ার কুমারভোগের কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে এনে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটি থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে অবস্থান করে ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান ই’। গতকাল সকাল ৯টায় হালকা কুয়াশার মধ্যেই ইঞ্চি মেপে শুরু হয় স্প্যান স্থাপনের কাজ। পরে স্প্যানটি নিয়ে সকাল ১০টার দিকে খুঁটির দিকে রওনা দেয় ভাসমান ক্রেন। এ সময় ঘটনাস্থলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ স্প্যানটির এক পাশে টাঙানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। অন্য পাশে চীনের পতাকা। স্প্যানটি নিয়ে ভাসমান ক্রেন যখন খুঁটির দিকে রওনা দেয়, তখন উপস্থিত কর্মকর্তাসহ সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অনেকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ছবি তোলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্প্যান নিয়ে ভাসমান ক্রেন খুঁটির কাছে পৌঁছে যায়। তারপর ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর স্প্যানটি বসানোর কাজ শুরু হয়। দুপুর ১২টা ২ মিনিটে স্প্যান বসানো শেষ হয়। এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো আলোচিত পদ্মা সেতুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড় কাজের। এরপর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি খুঁটির ওপর বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাকি ৪০টি স্প্যান বসাতে তিন বছর দুই মাস লাগল।
নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের জানান, যে ৪১টি স্প্যান দিয়ে পুরো পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ২০টি স্প্যান। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে। দ্বিতল এই সেতুতে স্প্যানের ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ হলেই পিচ ঢালাই হবে। ২২ মিটার প্রশস্ত এই সেতুতে চার লেইনে যানবাহন চলতে পারবে। আর নিচ দিয়ে এক লাইনে চলবে ট্রেন। ওই এক লাইনেই মিটারগেজ ও ব্রডগেজ- দুই ধরনের ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা হচ্ছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য (মুন্সীগঞ্জ-২) অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করে বাঙালি বিশ্বর সামনে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিল। এর মূলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে। এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। সেই টানাপড়েনে একজন মন্ত্রীকে সরে যেতে হয়, তখনকার সেতু সচিবকে দুদকের মামলায় কারাগারেও যেতে হয়। অভিযোগের সত্যতা না থাকায় সেই মামলায় পরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক। কানাডার আদালতেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। মোট ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু মাঝে ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া গেলে নকশা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। তাতে বাড়তি সময় লেগে যায় প্রায় এক বছর। এরপর করোনাভাইরাস মহামারী আর বন্যার মধ্যে কাজের গতি কমে যায়। সব বাধা পেরিয়ে অক্টোবরে বসানো হয় ৩২তম স্প্যান। এরপর বাকি স্প্যানগুলো বসানো হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই।
মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। সিনোহাইড্রো করপোরেশনই পদ্মা সেতুর জন্য নদী শাসনের কাজ করছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত সে কাজের ৭৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছিল।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে মোট দেশজ উৎপাদন এক দশমিক দুই শতাংশ বাড়বে এবং প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমবে বলে সরকার আশা করছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমরাও পারি
পরবর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্য সহকারীদের কর্মবিরতির মধ্যেই কাল থেকে হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন শুরু