পালাচ্ছে আসিফ। পালাচ্ছে নিজের বিবেকের কাছ থেকে। সরে যাচ্ছে তার সে অবস্থান থেকে। জানে এ মহা অন্যায়। তবুও পালিয়ে যাচ্ছে। কালবোশেখির ঝড় উঠেছে মনে। চোখের সামনে শীতল আগুন। এ আগুন নেভানোর সাধ্য তার নেই। তাই পালিয়ে যাচ্ছে।
কী স্পর্ধা! কতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা! কেমন নিঃশব্দে ছিঁড়ে গেলো কবিতাটি! নাকি শব্দ হয়েছিলো! আসিফের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি সেই শব্দ! নিটোল সৌন্দর্য দিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিলো এই কবিতার। কিন্তু এই কুৎসিত রূপ! না, না। কবিতাটি এখানেই থাক। শিল্পী মনটা অকস্মাত চরম বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো। তার কবিতা যে কেউ এমন দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে পারে, এটি বিশ্বাস করতে মন চাইছেনা। তবুও চোখে দেখা সত্যিটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। চোখের ভেতরটা জ্বলছে ভীষণভাবে। এই জ্বালা কী জল নেমে আসার লক্ষ্মণ কি–না তা–ও বুঝতে পারছেনা আসিফ। তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে টেবিল থেকে লেখার খাতাটি তুলে নিলো। চললো বাসার ছাদে। রাতকে, ভোর করে দেয়া কবিতাগুলো মুহূর্তে পরিণত হলো কয়েকশো টুকরোয়। আসিফ তাদের উড়িয়ে দিলো বাতাসে। বোশেখের ক্লান্ত সূর্যের টকটকে লাল চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ছিন্ন কবিতা। কাজল কালো অক্ষরগুলো ছোটো ছোটো শাদা টুকরোর ভেলায় চড়ে ভেসে যাচ্ছে ইচ্ছেমতো। যার যেদিকে যেতে মন চায়, আজ যেনো মানা নেই। খাতার বন্দি পাতা থেকে মুক্তি পেয়ে ওরা উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে বিষন্ন মনে। হাত পা মুখ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হলে যেমন তীব্র কষ্ট হয়, সেই কষ্ট নিয়ে। আসিফ বুঝতে পারছে সেই কষ্ট। তার মন আজ বড়ো বিক্ষিপ্ত। কোনো মায়া লাগছে না রাত ভোর জেগে তৈরি করা কবিতার জন্যে। একটি কবিতার মৃত্যু হয়েছে কারো হাতে। বাকী কবিতাগুলোর হন্তারক সে নিজেই।
–যা, উড়ে যা যেদিকে মন চায়। আসিফ আর কখনো খাতার ভেতরে বন্দি করবেনা তোদের। যা।
–তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি আসিফ! কী করছিস! কবিতার খাতাটা এভাবে ছিন্নভিন্ন করেছিস কেন! তোর না কবিতার বই করার কথা ছিলো! এভাবে কবিতার খাতাটাই ছিঁড়ে ফেলে দিলি! শফিকের উদ্বিগ্ন কণ্ঠের জবাবে বললো আসিফ,
– ছিঁড়ে ফেললাম। মলাটহীন কোনো বই হয় নাকি! জন্মের আগেই কলঙ্কিত সন্তান! তাকে আর ঘরে রেখে কী লাভ! যেখান থেকে ধরে এনে বন্দি করেছি, সেই প্রকৃতিতেই মিশিয়ে দিলাম।
ঘৃণা মিশ্রিত রাগ আসিফের কথায়। তরতর করে নেমে আসে ছাদ থেকে। দ্বিধান্বিত শফিক একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে নেমে আসে আসিফের পিছু পিছু। দুটো শার্ট–প্যান্ট গুছিয়ে নিতে মিনিট দেড়েক সময় নিলো আসিফ।
–যাচ্ছি রে। শহরের রাস্তাঘাটে প্রচুর আবর্জনা। বাইরে থেকে দেখলে কী সুন্দর দেখায় সব। তোর বাসার জানালাটার মতো। প্রতিটি বিকেল মনে হতো রঙ মাখানো। ওই রঙে স্নান করতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু যদি বুঝতাম…আসিফ থেমে যায়। জানালার কথায় শফিক একটা ধাক্কা খায় মনে মনে।
পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং। শফিক, আসিফের ভার্সিটির বন্ধু। করোনার প্রথম ছোবল কেড়ে নিলো তার লিভার বাদাসের্র চাকরি। করোনা আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত আসিফ একটা সিট যখন পেলো, সেদিনই অভিমানে বাবা যেনো নিজেকে ঢেকে নিলো শুভ্র পোশাকে। ঢাকায় থাকা আর সম্ভব হয়নি। মা‘কে নিয়ে ফিরে এসেছিলো গ্রামে। স্বাভাবিক জীবন। কোনো ছন্দপতন নেই এখানে। নেই গোপন হাহাকার। চলছে যে যার মতো। এর মধ্যে আসিফদের ফিরে আসাটা ছিলো অনাহুতের মতো। খালি পড়ে থাকা ভিটায় যারা রাজত্ব করছিলো, তাদের হাসিমুখেও বিদ্রুপ। কুঁচকে থাকা ভ্রুতে বুঝতে পারতো বিরক্তি। নজর এড়াতোনা আসিফের সেসব। দেখতো মা–কে। অনেক বছর পর ফিরে এসে গ্রামীণ জীবনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। মায়া হতো আসিফের। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতো,
–আমি শফিকের সঙ্গে কথা বলছি মা। সে অনেক বড়ো পলিটিক্যাল লিডার। আমাকে আশ্বাস দিয়েছে। যদি একটা চাকরি হয়, তোমাকে নিয়ে যাবো শহরে।
তারপরদিনই আসিফ এসে উঠেছিলো শফিকের বাসায়। তিন কামরার বাসাটায় সবাই ব্যাচেলর। শফিকের রুমমেটের সিটটা খালি। অনেকদিন ধরে বাড়ি থেকে আসেনা সে। শফিক যখন বললো,
–সিটের মালিক না আসা পর্যন্ত এখানে থাকতে পারিস। দুই বিছানার মাঝখানে টেবিল দেখে খুশি আসিফ। লেখালেখির অভ্যাস আছে তার। এর চাইতে উপযুক্ত জায়গা আর হয়না। মনের খুশিটা চেপে রাখতে পারেনি।
–তোর এই ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবোনা রে।
– ওসব ফিল্মি ডায়লগ এখন নয়। আগে দেখি একটা কিছু করতে পারি কি–না তোর জন্যে। সেই পর্যন্ত লিখবি, আর মন ভালো রাখবি।
শফিক বেশিরভাগ সময় কাটায় বাইরে। রাতে শোয়ার সময়টা বাদ দিলে, এই কামরার একচ্ছত্র অধিপতি আসিফ। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত সাহিত্যচর্চা ভালোই হবে। জানালা থেকে পাশের বিল্ডিংয়ের দুরত্ব হাত দুই কি তিন। একপাশে টিনের একচালা ঘর। বাকি জায়গাজুড়ে ছাদ। ছাদের কিনার ঘেঁষে টবে দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা, অপরাজিতা, অলকানন্দা। ওষধি গাছ অ্যালোভেরা। পুঁইয়ের ডগা নেমে পড়েছে ছাদের রেলিং বেয়ে। একটি লাউয়ের লতা পূর্ণ যৌবন নিয়ে খুঁজছে বেয়ে ওঠার মাচা। ঠিক সেই মেয়েটির মতো! যাকে প্রথমদিন দেখে চমকে উঠেছিলো আসিফ। পরে দ্বিতীয়, তৃতীয় আরও অনেকবার দেখেছে তাকে। কবিরা কতো উপমা দেন নারীর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে। কিন্তু কোনো উপমার সঙ্গেই আসিফ মেলাতে পারেনা তাকে। জোছনা রাতে তাকে দেখতে লাগে আকাশ পরির মতো। পূর্ণিমার চাঁদ তখন ঝলসানো রুটি মনে হয়না। তার পুরো অবয়ব জড়িয়ে থাকা জোছনা কি কিছুটা হিংসুটে হয়ে ওঠে তখন! না হলে বারবার কেনো চাঁদটা গিয়ে লুকোয় মেঘের আড়ালে! সে মুঠো ভরে জোছনা কুড়ায়। আসিফ তারই ছবি এঁকে যায় কবিতায়। বিকেলের পশ্চিমাকাশের টকটকে লাল সূর্য যখন আবির মেখে দেয় তার গায়ে! আসিফের কবিতার খাতায়ও লাগে সেই রঙ। নাম না জানা সেই অপ্সরার নাম রেখেছে ‘কবিতা‘। পাশের বিল্ডিংয়ে, লতাপাতা আর ফুলের রাজ্যের রানি। আসিফের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। এক টুকরো হাসি উঁকি দেয় ঠোঁটের কোণে। ওইটুকুই সম্বল আসিফের। কবিতার খাতা তার ভরে ওঠে অজস্র কবিতায়। সবই তাকে নিয়ে। কিন্তু মন ভরেনা। একটি অনন্য সাধারণ কবিতা লিখতে চায় আসিফ। সেটিই লেখার চেষ্টা করছে গত কয়েকদিন ধরে। মনে মনে ভাবে,
– কোনো এক সোনাঝরা বিকেলে আসবো তোমার কাছে। কবিতার খাতাটি খুলে দেখাবো তোমাকে। বলবো, কবিতার জন্যে কবিতা লেখা কেমন লাগলো?
সেদিন ভোরে বৃষ্টি হয়েছিলো খুব। অশান্ত প্রকৃতি শান্ত হয়েছিলো কিছুটা। বোশেখের হাওয়ায় চড়ে এসেছিলো সেই বিকেল। আসিফ যা কল্পনা করেছিলো তার চেয়েও সুন্দর। আকাশ পাড়ায় বান ডেকেছে সোনালি রূপের। হালিমা গ্রুপে দেয়া ইন্টারভিউটা খুব ভালো হয়েছে। কুমিল্লা স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের দিকে ছুটে চলছে উদয়ন এক্সপ্রেস। অনন্য সাধারণ কবিতার কথাগুলো দোলা দিচ্ছে মনে।
আসিফ আজ যাবে ওপাশের বাড়িতে। ট্রেন থেকে নেমেই সিদ্ধান্ত নেয়। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা তখন। বুকে মৃদু কম্পন।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে কবিতার খাতাটা নিতে গিয়ে চোখ যায় পাশের ছাদে। চাপা কান্নার শব্দে চমকে ওঠে! কে কাঁদে! কেনো কাঁদছে! বিস্মিত আসিফ দেখে ওদিকের ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে শফিক! কান্নার উৎস তখনো খুঁজছে আসিফের অস্থির চোখ। ধাক্কাটা লাগলো মিনিট দুয়েক পর। এ তো তার অসমাপ্ত কবিতা! বিধ্বস্ত, ছিন্ন ভিন্ন। শহরের মস্ত দালানের মাথায় নিঃশব্দ বিলাপ। জানলোনা কেউএকটি ফুলের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া। আজও চোখাচোখি হলো তার সঙ্গে। বিকেলের সোনা রোদ ঝিলমিলিয়ে উঠেছে তার গায়। বিরক্ত লাগে আজ আসিফের রোদের এই নাচানাচি। সেই অনন্য কবিতার কথাগুলো মুছে যায় মন থেকে। শফিকের প্রতি ঘৃণায়, ক্রোধে বিষাক্ত হয়ে ওঠে মন। থানায় ফোন দিয়ে কোনো লাভ নেই। শফিকদের মতো কেউকেটাদের বিচার হয়না। উল্টো ধর্ষিতা মেয়েগুলো ধর্ষিত হয় বারবার। অসহায় আসিফ সিঁড়ি ভেঙে নেমে চলে নিচে।
রাস্তায় পড়ে থাকা অঙ্গহীন কবিতাগুলোর অসহায় চাহনি গ্রাহ্য করেনা। দ্রুত পা চালায় বাস ধরার জন্যে। কিছু অংশ ঝুলে আছে মেহগনি গাছের নতুন গজানো পাতায়। কোনোটা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে চলেছে সঙ্গীর মতো। পিচঢালা রাস্তা থেকে, মেহগনি গাছের পাতায় বসে, বাতাসের সঙ্গে যেতে যেতে করুণ চোখে যেনো তাকিয়ে আছে আসিফের দিকে।সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। এই মুহুর্তে মনেপ্রাণে আসিফ চাইছে ঝুম বৃষ্টি নামুক। না। বৃষ্টি আসার কোনো লক্ষ্মণ নেই। বরং সূর্যটা আরো লাল হয়ে ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। যে বিকেলে আসিফের খাতা ভরে উঠতো কবিতায়, সেই বিকেলটা আজ বড়ো বেশি অসহ্য। আজ তার রূপ মুগ্ধ করছে না আসিফকে। অসংখ্য কবিতা শোকের মাতম তুলে ভেসে গেলো কালো অক্ষরগুলো বুকে নিয়ে ইচ্ছে মতো। আসিফ জানেনা ওপাশের ছাদের কবিতাটিও নিজেকে এভাবে ছিঁড়ে ফেলবে কিনা। যদি ছিঁড়ে যায়! পত্রিকার পাতা, ফেসবুক কিংবা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হবে। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে বলবে। পাশের বাসার জানালার পাশের বিছানায় শুয়ে মিটিমিটি হাসবে শফিক। নানাভাবে, নানারূপে ধর্ষিত হবে কবিতাটি। শফিকের মতো রাঘববোয়াল রয়ে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে! শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে আসিফ। শফিকের কাছে তবুও রয়ে যায় ঋণ। সবুজ পাতার ভাঁজে লুকিয়ে থাকে বিষাক্ত পোকা, সেটি বুঝিয়ে দেয়ার ঋণ।