বাংলা কবিতায় ঈদ : স্বরূপ ও ঐতিহ্য

আদনান আহমেদ | রবিবার , ১ মে, ২০২২ at ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ

ঈদের সকাল। ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে ওঠে শিশুকিশোর, নারীপুরুষ। কণ্ঠে কণ্ঠে তাকবীর, তাহমিদ।

ঈদ ধনীগরিব, বাদশাহফকির, মালিকশ্রমিক সবার মহামিলনের প্লাটফর্ম। এ দিনে সবাই জড়ো হয় এক কাতারে, ঈদের জামাত পড়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। একে অপরের সাথে করে আলিঙ্গন, তুলে সাম্যের জয়ধ্বনি।

প্রতিবছর ঈদ আসে আমাদের জীবনে আনন্দ, সীমাহীন প্রেম প্রীতি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে৷ আহবান জানায় সকল মলিনতা আর কলুষতাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে, পরস্পর প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে।

ঈদমুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক নেয়ামত। এ হাদিস হয়ত অজানা নয় কারো:

রাসূল (সঃ) যখন মদিনায় আগমন করলেন, মদিনাবাসীর বিশেষ দুটি দিন ছিলো। এদিনে তারা খেলাধুলা আমোদফুর্তি করতো। রাসূল (সাঃ) জানতে চাইলেন এ দুটি দিনের তাৎপর্য কি? মদিনাবাসি উত্তরে বললেন: আমরা মূর্খতার যুগে এ দুদিন খেলাধুলা করতাম। রাসূল (সঃ) বললেন: আল্লাহ এ দিনের পরিবর্তে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন তোমাদের দিয়েছেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।’ (সুনানে আবু দাউদ: ১১৩৪)

যদিও ঈদ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, তবে তা একাকার হয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে।

আমাদের শিল্পসাহিত্য অঙ্গন তো ঈদ নির্ভর বললেই চলে। ঈদ এলেই ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দেখা যায় কতো আয়োজন। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রতিটি চ্যানেল ঈদ উপলক্ষে নাটক, টকশো, আলোচনা, কৌতুক, সাক্ষাৎকারসহ প্রচার করে কতরকম অনুষ্ঠান। বসে থাকে না প্রিন্ট মিডিয়াও, প্রকাশ করে বিশেষ ঈদ সংখ্যা আর সমাবেশ ঘটায় সৃজনশীল লেখকলেখিকার। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস কোনো কিছুই বাদ পড়ে না এতে। ঈদ নিয়ে লিখেননি এমন কোনো মুসলিম কবিসাহিত্যিক বা লেখক হয়ত মিলবে না।

এক্ষেত্রে বাংলাভাষী কবিসাহিত্যিকরাও বহু এগিয়ে। ঈদ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লিখালেখি হয়েছে বিপুল পরিমাণ।

হিন্দু ও মুসলিম কবিসাহিত্যিকরা কতো ভাবে ঈদকে উপস্থাপন করেছেন তাদের লেখনীর ভাষায়।

১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মাসিক নবনূরপত্রিকার ঈদসংখ্যায় সৈয়দ এমদাদ আলীর ঈদকবিতা প্রকাশিত হয়। ঈদ নিয়ে যা ছিলো মুসলিম বাংলার প্রথম কবিতা। কবিতাটির প্রথম দুটি স্তবক হলো:

কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে

তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে

রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে

আজ কি হর্ষ ভরে।

আজি প্রভাতের মৃদুল বায়

রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়

মুসলিম জাহান আজি একতায়

দেখ কত বল ধরে?”

নবনূরের পৌষ ১৩১১ সংখ্যায় কায়কোবাদ লিখেছেন ঈদ শীর্ষক কবিতা, ফাল্‌গুন ১৩১১ সংখ্যায় ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত লিখেন ঈদজ্জোহাপ্রবন্ধ। এছাড়া নবনূরের পৌষ ১৩১২ সংখ্যায় ঈদ সম্পর্কিত তিনটি লিখা প্রকাশিত হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ঈদকবিতা, জীবেন্দু কুমার দত্তের ঈদ সম্মিলনকবিতা, এবং বেগম রোকেয়ার ঈদ সম্মিলনগদ্যপ্রবন্ধ। মুসলিম জাগরণের কামনা করে, ‘ঈদ আবাহননামে দুটি কবিতা লিখেছেন কায়কোবাদ। একটি তার অশ্রুমালাকাব্যগ্রন্থে অন্যটি অমিয়ধারাকাব্যগ্রন্থে। মান্দাকিনীধারা কাব্যগ্রন্থে ঈদ নিয়ে ছোটদের কবিতাও লিখেছেন তিনি।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার সম্পাদিত মাসিক আল এসলামপত্রিকার ভাদ্র ১৩২৩ সংখ্যায় কোরবানির যুক্তি দেখিয়ে লিখেছেন ঈদুল আজহাপ্রবন্ধ।

এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, ঈদ নিয়ে সবচে বেশি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, নাটক। তার সৃষ্ট কবিতা,গান আজো বাঙালি মুসলমানকে উজ্জীবিত করে, প্রেরণা যোগায়।

কবি হিসেবে নজরুলের আবির্ভাব ১৯১৯ সালে। ১৯২০ সালেই লিখেন ঈদুল আযহা নিয়ে বিস্ময়কর কবিতা কোরবানি। কবিতাটি লিখেন জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল আলমের এক প্রবন্ধের জবাবে। তরিকুল অভিযোগ করেন, কুরবানিতে পশু জবাই করা হয়, যা অনুচিত। তার এ অভিযোগের জবাবে গর্জে ওঠে কাজীর কলম। তিনি লিখেন

ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহশক্তির উদ্বোধন।

দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন।’

তার ঈদ সংক্রান্ত কবিতাগানে যেমন আছে আনন্দউল্লাস, তেমন সাম্যের আহবান, আছে নবজাগরণের বাণী।

কবির ঈদুল ফিতরের কবিতাসঙ্গীতে ফুটে উঠেছে, অসহায় গরিবদের জন্য তার সহানুভূতি। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক:

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ (কৃষকের ঈদ)

প্রজারাই রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী,

তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।’ (ঈদের চাঁদ)

তিনি তার ঈদুল আজহা নিয়ে লেখা কবিতায় যেমন ঘটিয়েছেন অপূর্ব সব অলঙ্কারের সমাবেশ, তেমনি প্রকাশ ঘটিয়েছেন জাতীয় চেতনার। অবলীলায় বাজিয়েছেন জাগরণের বীণ।

” ‘শহিদান’দের ঈদ এল বকরীদ!

অন্তরে চিরনওজোয়ান যে তারই তরে এই ঈদ।

….

উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদে মনে কর,

শুধু সালওয়ার পরিয়ো না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো!…” (বকরীদ)

মনের পশুরে কর জবাই,

পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।

কশাইএর আবার কোরবানী!-

আমাদের নয়, তাদের ঈদ,

বীরসুত যারা হ’ল শহীদ,

অমর যাদের বীরবাণী।’

(শহীদী ঈদ)

নজরুলের খুশির ঈদগান ছাড়া বাঙালির ঈদুল ফিতরের আমেজ যেন অপূর্ণই থেকে যায়। ঈদুল ফিতর এলেই চারদিকে বেজে ওঠে তার গান।

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’

নজরুল ইসলামের জীবদ্দশায় এবং তার পরবর্তীকালেও ঈদ নিয়ে কবিতা, গান ও গদ্যের ধারা অব্যাহত থাকে।

তাছাড়া কাজী আব্দুল ওদুদ ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর বহুমাত্রিক ভাবনায় এসেছে ঈদ প্রসঙ্গ। ঈদুল ফিতরঈদুজ্জোহাদুই শিরনামে প্রবন্ধ লিখেছেন আব্দুল ওদুদ।

তিরিশের অনেক কবিরাও ঈদের কবিতা লিখেছেন। বেগম সুফিয়া কামালের ঈদকবিতার প্রথম চার লাইন হলো:

আমার নিশীথের আধার সিন্ধু পাড়ি দিয়ে এল তরী

ফিরদৌস হতে সওগাত লয়ে গগন কিনার ভরি

কত উত্‌সুক মানব মনের শান্তি কামনা লয়ে,

দ্বিতীয়ার চাঁদ অস্ত গগনে পাবক প্রতীক হয়ে।

কবি মঈনুদ্দীন লিখেছেন ঈদুল ফিতরনামে কবিতা। কবি আশরাফ আলী খানের ঈদকবিতা একসময় যথেষ্ট বিখ্যাত হয়েছিলো।

পরবর্তীতে ঈদ নিয়ে কবিতাগান লিখেছেন কবি ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন, সানাউল হক, আজিজুর রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, মনোমোহন বর্মন, মুফাখখারুল ইসলাম, আল মাহমুদ, মুসা আল হাফিজ প্রমুখ।

কবি ফররুখ আহমদ তার ঈদের স্বপ্নকবিতায় যেন স্বপ্নরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন:

আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবিত মতন,

নতুন কিশতি বুঝি এলো ঘুরে অজানা সাগর

নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর

আজ এ স্বপ্নের মাঠে রাঙা মেঘ হল ঘন বন!’

কবি ফররুখ দুনিয়াকে ঈদগাহের সাথে তুলনা করে ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাইনামে লিখেছেন কবিতা। কবি লিখেছেন

আজকে এলো খুশির দিন

দেখনা চেয়ে খুশির চিন

দেখ না চেয়ে আজ রঙিন

খুশির ঝলক ঈদগাহে

ঈদের নতুন চাঁদ সকলের তরে আনন্দময় হয় না বা সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। গরিবদুঃখিদের দুঃখকষ্ট দূর হয় না। তাদের মনের আকুলতা ফুটে উঠেছে কবি তালিম হুসেনের ঈদের ফরিয়াদকবিতায়

ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খুশরোজে

দাওয়াত কবুল করো মানুষের বেদনার মহাভোজে।

ঈদ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সবার মাঝে নব উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ঈদ এলে সমাজে যে আনন্দলহরি বয়ে যায়, তা ফুটিয়ে তুলেছেন কবি আ..ম বজলুর রশিদ তার ঈদ আসেকবিতায়

ঈদ আসে হাসিখুশি

তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে অনেক আনন্দ নিয়ে

কিছুক্ষণ ভুলে যাই দুঃখ জ্বালা যত

আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ হয়ে থাকা

অবিরত আল্লাহর প্রশংসায় গান

তার দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে

ঈদ আনন্দউল্লাসের দিন হলেও গরিব, দুঃখী, অসহায়দের ভাগ্যে জুটে না এ আনন্দ। বা তারা আনন্দের ভাগ পায় না। ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুসরণ না করায় ক্ষুধাঅনাহারে কাটাতে হয় তাদের ঈদের দিনটিও। এ দিকটি ফুটে উঠেছে কবি শাহাদত হুসেনের বাংলার ঈদকবিতায়

বাংলার মুসলমান শুধু চেয়ে রয়

মৌন ম্লান ক্লিষ্ট মুখ নির্বাক নিশ্চল

ফিত্রার খুশি কোথায় তার?

কি দান সে দিবে ক্ষুধিতেরে?

নিজেই কাঙ্গাল রিক্ত

ভিক্ষা মাগি ফিরে দ্বারে দ্বারে।

ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় জাকাত, ফিতরা দেয়া হলে, গরিবদুঃখি, অসহায়রাও উপভোগ করতে পারবে ঈদানন্দ।

সমাজে ধ্বনিত হবে শান্তি সুখের কল্লোল। এদিকে ইঙ্গিত করেই হয়ত কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে কল্পনা করেছেন মানবতার সমাবেশস্থল হিসেবে। রচনা করেছেন ঈদ উৎসবকবিতা

কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম বাণী

বক্ষে ভরা তার শান্তি

চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতিভার

বিশ্ববিমোহন কান্তি

প্রিতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে

এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে

দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগবেদনার শ্রান্তি।

ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা আমাদের জীবন রাঙাতে পারি, তবেই আমাদের ঈদ উৎসব স্বার্থক হবে। ঈদ এলে যেভাবে ধনীগরীব, বাদশাফকির ভেদাভেদ ভুলে যাই, সারা বছর সেই ভেদাভেদের দেয়ালকে উপড়ে ফেলতে হবে। কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায়

আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লাভিয়াছে হর্ষে

আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়াছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে

এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য, নিখিল মানবের মিলন জন্য

শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।

কবি সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদে যেনো দেখেছেন নতুন দিনের বার্তা। তার নতুন দিনের বার্তাকবিতায় লিখেছেন

এসেছে নতুন দিন

আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ

জরির জোব্বা শেরওয়ানী আর আমামার সজ্জায়

আতরের পানি মেশকের রেনু খুশবু বিলায়ে যায়

বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর

সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে রাত্রি হয়েছে ভোর।’

শত বছর ধরে ঈদের কবিতা,গান আমাদের ধর্মীয় আনন্দকে আরো আনন্দময় করে তুলছে। তাই বলা যায়ঈদ ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি এখন সাংস্কৃতিক উৎসবেও রূপ নিয়েছে। বাংলা কবিতায় ঈদের স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে আনন্দ মুখর শব্দ ও ছন্দে। সাম্য, মানবতা ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে, শত শত কবির কবিতায় এর অনিন্দসুন্দর উপস্থাপনায় ঈদ হয়ে উঠেছে বাংলা কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ, বিশেষ ঐতিহ্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদীপ জ্বলা রাতে
পরবর্তী নিবন্ধঈদ : সাম্যের শ্রেষ্ঠ দর্শন