দীপ জ্বলা রাতে

রুনা তাসমিনা | রবিবার , ১ মে, ২০২২ at ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ

বোশেখের হাওয়া হঠাৎ উন্মাদ হয়েছে আজ। কাঁচা আমগুলো টুপ টুপ করে ছিঁড়ে পড়ছে। বাতাসে উড়ছে ছেঁড়া কাগজ, পাতা, ছেঁড়া পলিথিন। কিন্তু ওই হাওয়াকে পাত্তা দেয় কে! বাড়ির বউ ঝি সবাই আমগাছের নিচে জড়ো হয়েছে। সালেহার খুব ইচ্ছে করছে, কয়েকটি আম সেও কুড়িয়ে আনে। নিজের বাড়ি হলে কবেই দৌড়ে চলে যেতো। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে হাওয়ার উন্মাদনা ছুঁয়ে দেখছে সালেহা। হাতের বেলোয়ারি চুড়ি বাতাসের ধাক্কায় রিনরিনে শব্দ তোলে। বিয়ের ছয় সাত মাস পেরিয়ে গেছে। তার ভেতর আরেকটি জীবন পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে তার অস্থির নাড়াচাড়া। এই সময় নাকি জিন ভুতের কুনজর লাগে। শাশুড়ির কড়া নিষেধ, ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না এই সময়। আগে যাও একটু আধটু উঠোন পর্যন্ত যাওয়া যেতো, এখন তাও বন্ধ। জামিল বলে,

মা তোরে বাইন্ধা রাখেনি রে। আমগো পরি দুইন্যায় আওনের পর মা তোরে আর বারণ করবো না।

বুঝি তো। মায়ে তো আমার ভালাই চায়। হেল্লাইগ্যা ঘরের বাইর অইতে মানা করে।

সময় যতোই গড়ায়, ভেতর থেকে পরির অস্থিরতা বাড়ে। কষ্টেও সালেহার মুখে ছড়িয়ে পড়ে একটুকরো হাসি। সুখানুভূতি জলতরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে মনের পদ্মপুকুরে। জংলী ছাপার লাল শাড়ির আঁচল মাথার উপর থেকে কাঁধে লেপ্টে থাকে বাতাসে। সালেহার মন ছোটে নিজের বাড়িতে। এমন আম কুড়ানি দিনে কাঁচা আমের ভর্তা বানিয়ে কতো কাড়াকাড়ি হতো! জোছনা রাতে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে জোছনা দেখতে যাওয়া! বিয়ের পর কেমন বদলে যায় সব!

জামিলের সংসারে শুধু তার মা। শাশুড়ি মার আদর, নিজের মায়ের মতো। তবুও পরের বাড়ি। এখনে মন টানলেও অনুমতি নেই যখন ইচ্ছে ঘরের বাইরে যাওয়ার। বোশেখের মাতাল হাওয়ার লুটোপুটি দেখা হয় না শাড়ির আঁচলে। তা নিয়ে যে সালেহার খুব আক্ষেপ আছে, তাও নয়। মাঝে মাঝে কেবল ইচ্ছেগুলো বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করে মনের সঙ্গে। ওরা চায় বোশেখের উন্মাদ হাওয়ায় উড়তে থাকা পাতাগুলোর মতো স্বাধীনতা। পাশের বাড়ির পুরনো বউ ঝিয়ের মতো ছোটা। উত্তর পশ্চিম দিক জমতে থাকা মেঘেদের মতো মনের কোথাও গম্ভীর হয়। কোথাও একটু কষ্ট জমে।

বাইরে যাইবার মন চায়? কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ওঠে কেউ। চমকে ফিরে তাকায় সালেহা। জামিলকে অসময়ে বাড়িতে দেখে অবাক!

আইজ জলদি চইলা আসলা! কুনু সমস্যা অইছে?

দূর, সমস্যা অইবো ক্যান? এক ট্রিপ মাইরা চইল্যা আসছি। আইজ গহীন রাইত পর্যন্ত জাইগ্যা তর কষ্ট করন লাইগবো না।

শহরে গাড়ি চালায় জামিল। বাড়ি ফেরে রাত করে। কখনো নিকশ কালো আঁধারে। কখনো আকাশ ভেঙে জোছনা নামে। বাড়ির আশপাশের গাছের পাতায় পাতায় লুকোচুরি খেলে। জোছনার স্নান করতে করতে জামিল আসে। সমস্ত পাড়া তখন ঘুমায়। ঘুম জড়ানো চোখে সালেহা কান পেতে থাকে পথে। জমির আলপথে জামিলের পায়ের শব্দ পষ্ট শোনা যায়। শুক্লপক্ষের চাঁদে তখন গনগনে আলো। দরজায় টোকা পড়ার আগেই খুলে যায় কাঠের দরজার দুপাট। প্রথমদিকে জামিল অবাক হয়ে বলতো,

ক্যামন কইরা বুইজলি আমিই আসছি? চোর ডাকাইত যদি হইত?

হাসতো সালেহা। ওই হাসিতেই জামিল বুঝে নিতো, অন্তরের মানুষটির ঘামের গন্ধের মতো, বাতাসে মিশে থাকে তার পায়ের শব্দও। খেতে বসে বলে,

আমাদের পরিডা আওনের পর তোরে লইয়া একদিন জোছনা দেখতে যামু। নিঝুম রাত্তিরে জোছনা কী সুন্দর কইরা বড় পুকুরে সাঁতরায় দেহিস। বাতাসে দুইল্যা ধানের চারায় চড়ে কত্তদুর চইল্যা যায়!

এই কথাডি কয়বার বিয়ার পর থেইক্যা কইছ কও তো? গাড়ি লইয়া হেই বিয়ানে চইলা যাও। রাইত দুপুরে বাড়ি আসো। তুমি আবার আমারে জোছনা দেখাইবা। সালেহার কথায় অভিমান ঝরে।

মন খারাপ করিস ক্যান! সামনের বোশেখে ঠিক লইয়া যামু। ওই সময়ডায় যাত্রীর চাপ থাহে না। আমাদের পরিরে লই যামু। সমুদ্দুর দেখছিস? তোরে লইয়া যামু। শামুকের গয়না কিন্যা দিমু।

সালেহার চোখের সামনে অকস্মাৎ ফিকে হয়ে যায় বোশেখের রঙ। আজও উন্মাদ হয়েছে বোশেখের বাতাস। ঠিক দুবছর আগের মতো। কিন্তু এই বাতাসে আমের ঘ্রাণের বদলে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তের গন্ধ! ঝরা আম কুড়োতে আসা বউ ঝিয়ের মুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগে। পরনের শাড়ির শুভ্র রঙে ঢাকা পড়ে গেছে জীবন। জংলী ছাপার শাড়ি পড়ে থাকে টিনের বাক্সের কোণে। হাতের কব্জিতে রিনিঝিনি করে আর বাজে না বেলোয়ারি চুড়ি।

পরি আসার একবছর পর, ঠিক এমন বোশেখে জামিল নিখোঁজ হয়েছিলো। শুক্লপক্ষের চাঁদ সেদিনও আলো বিছিয়ে দিয়েছিলো। উঠোনের হাসনাহেনা ফুলের মাতাল গন্ধ উৎসব করছিলো বাড়ি জুড়ে। জোছনায় ভিজতে ভিজতে এসেছিলো জামিলের বন্ধু অসীম। হাতে একটি ছোট্ট জামা। পরির ছোট্ট হাতে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলো,

নেও মা। বাপজান তোমার লাইগ্যা শেষ বারের মতো কিন্যা দিয়া গ্যাছে।

রাতের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো সালেহা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো অসীমের দিকে। সে বলছিলো, পিকনিকের রিজার্ভ ভাড়া ছিলো। দুটো গাড়ি নিয়ে তারা গিয়েছিলো বান্দরবন। পরির জামাটা কিনে বলেছিলো, –জামাডা পরলে আমার পরিরে পাহাড়ি পরির লাহান দেহাইবো। দোস্ত, জামাডা তোমার গাড়িতে রাইখো।

সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলো সে। তীব্র গতিতে ছুটে আসছিলো শহরের দিকে। পেছন থেকে অসীম বারবার হর্ন বাজিয়ে সাবধান করছিলো। গাড়িতে লাগানো মাইকে বাজছিলো গান। মেঘলায় মোড় নিতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস পড়ে যায় খাদে। অসীম বলে যাচ্ছিলো জামিলের গাড়িটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে কীভাবে নেমে গেছে পাহাড়ের গোড়ায়। লাফিয়ে নামতে গিয়ে গাছে ঝুলেছিলো অনেকে। প্রাণহীন দেহ। কেউ হারিয়ে গেছে পাহাড়ি জঙ্গলে। লাশের মধ্যে জামিল ছিলো না। সালেহার চোখ থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামেনি অসীমের কথা শুনে। পরিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে শুধু বলেছিলো,

হেই আইব। পরিরে লইয়া আমরা দুইজন জোছনা দেখতে যামু। বড় পুকুরে জোছনা ক্যামনে সাঁতরায় আমারে দেহাইতে লইয়া যাইব। আমি কহনো সমুদ্দুর দেহি নাই। হেয় আমারে সমুদ্দুর দেহাইতে নিবো। শামুকের গয়না কিন্যা দিবো।

জানালা থেকে সরে আসে সালেহা। পরি আধো বোলে বাব্বা ঢাকা শিখেছে। ছোট্ট পা ফেলে দৌড়োয় সারা ঘরে। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ডাকে, বাব্বা! সালেহার মনে হয়, পরি দরজার কাছে যায় বাব্বা এসেছে কিনা দেখতে। যেমন করে প্রতি রাতে সালেহা কান পেতে থাকে, এই বুঝি জামিলের পায়ের শব্দ শোনা যায়! চাঁদের দীপ জ্বলা রাতে সে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলবে,

বাইরে যাইবার মন চায়!

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ‘হুমকি দেখছে না’ যুক্তরাষ্ট্র
পরবর্তী নিবন্ধবাংলা কবিতায় ঈদ : স্বরূপ ও ঐতিহ্য