বাংলাদেশে প্রথম থ্যালাসেমিয়া আন্দোলন

ডা: মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু | রবিবার , ১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশস্থ ‘ফেয়ার হেলথ ক্লিনিক’ এ কর্তব্যরত চিকিৎসক হিসেবে ডিউটি করছিলাম। তখন একজন ভদ্রলোক ডাক্তারদের ডিউটি রুমে ঢুকলেন সাথে তার মেয়ে নাম সিঁথি। এসেছিলেন মেয়েকে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করার জন্য। আমাকে কাগজপত্র দিলে দেখলাম তার মেয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগী ব্লাড ট্রান্সফিউশন করার জন্য এসেছেন। রিকুইজিশনপত্র লিখার সময় দেখলাম তার মেয়ের ব্লাড গ্রুপ ‘বি-নেগেটিভ’। আমি বললাম আমার ব্লাড গ্রুপও ‘বি-নেগেটিভ’ । আপনার মেয়েকে পরবর্তীতে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন। আমি ব্লাড দিতে পারবো। এরপর বেশ কয়েকবার সিঁথিকে ব্লাড ডোনেশন করেছিলাম। ভদ্রলোকের নাম আশীষ ধর। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিশু সংগঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও একজন জুয়েলারী ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে আমি পোস্টগ্রেজুয়েট করার জন্য ঢাকার পিজি হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর আমার সাথে উনার যোগাযোগ ছিলনা। এফ.সি.পি.এস পাশ করার পর চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে আসার পর দেখলাম আশীষ বাবু বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্তদের নিয়ে “থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র বাংলাদেশ” নামে সর্ব প্রথম একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এ সংগঠনে এখন ৬ থেকে ৭ শত জন রোগী সদস্য। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন (TIF) এর সদস্যভুক্ত হয়েছে এ সংগঠন। আশীষ দা’র কাছে শুনেছি তিনি মেয়েকে নিয়ে ভারতের মুম্বাই টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। বেশ কিছু দিন ভাল থাকার পর কলকাতার বিশিষ্ট থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসক ও গবেষক ড. অমিত চক্রবর্তী ও ড. সুদীপা বসুর কাছে চিকিৎসার জন্য মেয়েকে নিয়ে যান। ওখানে ড. সুদীপা বসু ও নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে ব্যাপক কাজ শুরু করেছেন। চিকিৎসা, গবেষণা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রচার শুরু করেছেন অনেক আগে থেকে। ড. সুদীপা বসু উনাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই বলে- আপনি বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কাজ করেন, আমরা সকল প্রকার সহযোগীতা করব। তাছাড়া দশের জন্য, দেশের জন্য কাজ করলে ঈশ্বর আপনার ভাল করবে। ড. অমিত চত্রবর্তী কলকাতার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ড. বসু বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তার উপর থ্যালাসেমিয়ার প্রকার ভেদ এর জন্য কাজ করেছেন। পাশাপাশি বিনামূলে চিকিৎসা সেবা দিয়ে এসব রোগীদের কল্যাণে কাজ করছেন অনেক আগে থেকেই। পশ্চিম বাংলার বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ও বাংলাদেশের বাঙালিদের একই ধরণের থ্যালাসেমিয়া ধরণ বলে দু’দেশের রোগীদের চিকিৎসাও একই ধরণের হবে তাই বাংলাদেশে নিজে থেকে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আশীষদা দেখলেন প্রায়ই অর্থ-বিত্তশালী রোগীর অভিভাবকরা চিকিৎসা নিতে উনার কাছেই ছুটে যাচ্ছেন। গরীব রোগীরা ওসব চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি দেশে এসে বেশ কয়েকজন মানবদরদী ব্যক্তি ও অভিভাবকদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন। প্রথমে ত্রিশহাজার পোস্টার ছেপে সারা দেশের জেলাশহরগুলিতে আশীষদা নিজে গিয়ে পোস্টার লাগিয়ে রোগীদের তালিকা প্রণয়নের প্রাথমিক কাজটা ছয় মাসের মধ্যে শেষ করলেন। চট্টগ্রামস্থ মোমিন রোডের আজাদী ভবনের নির্মাণাধীন তৃতীয় তলায় ১৪ জুন ২০০২ সনে বাংলাদেশের প্রথমবারের মত থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা ও স্ক্রিনিংক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ক্যাম্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ড. অমিত চক্রবর্তী, থ্যালাসেমিয়া বিশেষজ্ঞ ও থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন ভারতের সাধারণ সম্পাদক ড. সুদীপা বসু, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি মরহুম প্রফেসর ডাঃ শাহদাৎ হোসেন। তিন দিন ব্যাপী এই ক্যাম্প স্থায়ী হয়। এই ক্যাম্পকে পূর্ণাঙ্গ সফল করার জন্য যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তারা হলেন সেবা কেন্দ্রের সভাপতি সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক এম, নাসিরুল হক, ড. সুদীপ ঘোষ, জাসদ নেতা ইন্দুনন্দন দত্ত, ওসমান গনি চৌধুরী বাবুল, চন্দনা মজুমদার, শ্যামল দাশ, আনোয়ারুল মুবিন, শাকিল ও এ.কে.এম সামশুদ্দিন আহমদ প্রমুখ। এ ক্যাম্পে কঙবাজার, বান্দরবন, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বরিশাল, বরগুনা, শেরপুর, পাবনা, খুলনা, সাতক্ষীরা, সিলেট, বাগেরহাট- এর প্রায় দুই হাজার সাতশত রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৪ সনে পাঁচলাইশের শেভরনে আমার চেম্বারে ও ২০০৬ সালে জামাল খান রোডস্থ থ্যালাসেমিয়া কার্যালয়ে আমার তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা ও স্ক্রীনিং ক্যাম্পে করা হয়েছিল। ২০১০ সনে থ্যাইল্যান্ডের মাহিদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক দল প্রফেসর ডাঃ সুথার্ট এর নেতৃত্বে দুই দিনব্যাপী চিকিৎসা ও স্ক্রীনিং ক্যাম্পে প্রায় নয় শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করেন। এরপর ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডের বিশিষ্ট রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ হেইন মূলার এম.ডি. পরিচালনায় চিকিৎসা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কঙবাজার, খুলনা ও ফেনীতে পৃথক তিনটি চিকিৎসাক্যাম্প পরিচালনা করা হয়। আমি রোটারী ক্লাব অব চিটাগাং এর অর্থায়নে ব্যয়বহুল বাহক যাচাই ক্যাম্প পরিচালনা করি। চট্টগ্রামের সেনসিভ ল্যাব আমাকে কম মূল্যে ৎবধমবহঃ দিয়ে সহায়তা করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়, কক্সবাজার, মহেশখালী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান জেলায় প্রায় পঁচিশটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় ‘থ্যালাসেমিয়া বাহক যাচাই ক্যাম্প’ পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায় যে বাংলাদেশে শতকরা ৪.৫ ভাগ শিশু থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এসব মানবতার কাজে পিছপা হয়নি আশীষ দা, আজও থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা রেখেই চলেছেন। আমি তাকে সব সময় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজার দিদার মার্কেটের ২য় ও ৩য় তলায় বর্তমানে ‘থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র বাংলাদেশ’ এর ঠিকানায় প্রতিদিন বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত অনেক রোগী রক্ত দিতে আসে। এ কেন্দ্রে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন করা হয়। প্রয়োজনে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ দেয়া হয়।
আশীষ বাবু ও অন্যান্যদের চেষ্টার ফসল এ ‘থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র’। এটা বাংলাদেশে প্রথম থ্যালাসেমিয়া আন্দোলনের মাইল ফলক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রধান ফিজিশিয়ান, থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র- বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.)
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে