দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

জলহীন হিমচ্যানেল
এ পর্যন্ত এই এয়ারপোর্টের বাহ্যিক চেহারায় যখন এটিকে কমলাপুরের রেলস্টেশনের চেয়েও মলিন মনে হচ্ছে, তখন এটির টয়লেটওতো নির্ঘাত ঐ একই স্তরেরই হবে। ঐ টয়লেটে গিয়ে উলেন থার্মাল পরার চিন্তা যে করছি সেটিতো আমার নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়, আর তা যদি প্রকাশিত হয় সকলের সামনে, তবে লাজুসহ পরিবারের সকলের যেরকম ভয়াবহ তোপের মুখে পরবো, তার চেয়ে বরং এই বেইজিংহীমে ফের কিংকর্তব্যপ্রস্তরাবরফাবৎ হয়ে যাওয়াটাই নিরাপদ। আসলে এরকম পাবলিকপ্লেস বা জনসমাগমস্থল বাইরে থেকে যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না, যদি না তার টয়লেট থাকে অপরিচ্ছন্ন। এব্যাপারে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টের সাথে টেক্কা দেবার মতো আর কোন এয়ারপোর্ট আছে কি না আমার জানা নেই। সিঙ্গাপুর বাদে বেশীর ভাগ জায়গাতেই টয়লেটে পা দিয়ে, আমাদের চলতি যে কথাটি মনে পড়েছে তা হলো, উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। আর এখানে তো উপরেই সদরঘাট। তবে ঘটনা তো উল্টাও তো হতে পারে, মানে উপরে সদরঘাট ভেতরে ফিটফাট। কারণ ব্যতিক্রম বলে একটা শব্দ আছে না, মনে হল এসময়। বুঝলাম বাইরের হাবিয়া ঠাণ্ডার ভয়ে, উলের থার্মাল পরার চিন্তাটা বাতিল করতে পারছে না আমার অবচেতন, যার কারণে সে ঐ ব্যতিক্রম ব্যাপারটি সামনে এনেছে। কিন্তু তারপরও সচেতনভাবেই বাতিল করে দিলাম ঐ ব্যতিক্রম হাইপোথিসিস। কারণ ব্যাতিক্রম ব্যতিক্রমই, ওটা আমার মতো সাধারনের কপালে ঘটেনি কখনো। অতএব বড় সুটকেসটি খুলে সেই উলেন থার্মালটি বের করার চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে, ভাবলাম কপালে যা থাকে থাকুক, সুতি থার্মাল পরেই না হয় পাড়ি দেবো আগমনী লাউঞ্জ আর গাড়ি ঠিক করার মধ্যবর্তী জায়গায় মুখ ব্যাদান করে চিত হয়ে শুয়ে থাকা বেইজিং হিমচ্যানেল। আমারই দেশের আমার পূর্বপ্রজন্মের সাতারু ব্রজেন দাশ যদি হিমশীতল ইংলিশ চ্যানেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতরে পার হয়ে রেকর্ড করতে পারেন, তবে তারই উত্তরসূরি হয়ে আমি কেন এতোসব গরম জামা কাপড় পরে থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উলেন থার্মাল না পরার কারণে ঘাবড়ে আছি মনে মনে, যখন আমাকে কিনা থাকতে হবে বাইরের হিমচ্যানেলের ঠান্ডায় খুব জোর পাঁচ বা দশ মিনিট! নাহ কুঁচ পরোয়া নেই, রাখবোই আমি ব্রজেন দাশের উত্তরসূরি হিসাবে তার সম্মান, ভাবতে ভাবতে লাজুর মাঝারী সুটকেসটা টেনে এনে ওরা কাছে রাখতেই অনুনয়ের স্বরে ও বলল, “তুমি এই সুটকেসটা একটু চেপেচুপে বন্ধ করে দাও না। ততক্ষণে আমি ওটা খুলে দেখি কোথায় রেখেছি গ্লাভস ওটাতে। এতক্ষণ কাপড় চোপড় ওলট পালট করাতে এখন আর এই সুটকেসটার ডালা আমি বন্ধ করতে পারছি না” ।
নিতান্ত বাধ্যগত সুবোধ স্বামীর মতো বিনাবাক্যব্যয়ে স্ত্রী আজ্ঞা পালন করার নিমিত্তে ওর হাতে মাঝারী সুটকেসটা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম লাজুর ভোমা সুটকেসটার মুখবন্ধ করার ব্যবস্থা করতে। ওটার সামনে বসে দু হাতে উপরের ডালাটি চেপে ধরে তালা লাগাতে গিয়ে বুঝলাম, অতো সহজে মুখবন্ধ করবে না সে, ধরতে হবে তার মুখ, হাঁটু চেপে তারপর লাগানো যাবে মুখে তার তালা। কিন্তু তা করার আগে একটু ভেতরটা দেখে নেই, যাতে ভেতরে উপরের দিকে রাখা ভঙ্‌গুর কোন কিছু ভেঙে যায়, ডালাটির উপরে দেয়া হাঁটুর চাপে।
ডালাটা তুলে ভেতরে চোখ ফেলতেই নজরে পড়লো উপরের দিকে সুন্দরকরে পলিথিনে মোড়ানো কয়েকটা প্যাকেট রাখা আছে নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেখেই বুঝলাম যে ওগুলো সেই হোটেল কর্তৃক আক্কেলসেলামি হিসাবে দেয়া সেই ফলসমূহ, যা দেখেই মনে হলো এগুলো বের করে রাখা দরকার এখন। কারণ দুপুরের খাওয়া তো এখানেই সারতে হবে মনে হচ্ছে। আর এ পর্যন্ত এয়ারপোর্টের কোথাও তো কোন রকম দোকানপাটই দেখিনি। আর বাইরের ঐ হিমচ্যানেলেও কোন খাওয়ার দোকান বা রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না। বিমানবন্দর অভ্যন্তরীণ হোক আর আন্তর্জাতিক হোক, খাবার দোকান, রেস্টুরেন্ট যা থাকে এসব জায়গায়, তার সবই থাকে আগমনি লাউঞ্জ , বহির্গমন লাউঞ্জ আর ট্রানজিট লাউঞ্জে। আর এই তিন লাউঞ্জের মধ্যে ওসব সবচেয়ে বেশি থাকে, ট্রানজিট লাউঞ্জে আর বহির্গমন লাউঞ্জে ।বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের যে কোন লাউঞ্জেই চা কফি আর হালকা নাস্তার দোকান থাকলেও, ভরপেট খাওয়ার রেস্টুরেন্ট থাকে না। অতএব আপাতত আমাদের ভরসা লাজুর চলমান রেস্টুরেন্ট বা খাদ্যভান্ডার , এ ভেবে বের করে নিলাম ঐ প্যাকেটগুলো।
‘কি ব্যাপার? কি কি বের করছো আবার? দিলাম সুটকেস বন্ধ করার জন্য, আর তুমি করে দিচ্ছ সুটকেস এলোমেলো’ উদ্বিগ্ন লাজুর স্বরে প্রকাশ পেল স্বভাবসুলভ বিরক্তি তার, তাতে আমারও বিরক্তির উদ্রেক হলেও, শান্তি রক্ষার নিমিত্তে ওটিকে গিলে ফেলে, বললাম-
কিছুই এলোমেলো করিনি তোমার সুটকেসের। উপর থেকে শুধু আলগোছে নামাচ্ছি ফলের প্যাকেট গুলো। ওগুলো দিয়ে আর তোমার হাত আর পিঠ ব্যাগের কেক বিস্কুট দিয়েই তো চুকাতে হবে মনে হয় আজকের দুপুরের খাওয়ার পাট। এ কথা বলতে বলতে ফলের প্যাকেটগুলো সব বের করে সুটকেসের ডালাটি বন্ধ করতে গিয়ে মনে হলো, অকারনেই যখন সুটকেস এলোমেলো করে দিচ্ছি এমন অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েই গেলাম, তখন না হয় আর একটু দেখিই না ঘেটে সুটকেসটা, পাই কি না খুঁজে লাজুর হাতমোজা ভেতরে, তাতে যদি ওটা আসলেই একটু এলোমেলো হয়, হলো তা! এমন ভাবনার উদয় হতেই, আধখোলা ডালাটা ডান হাতে ধরে বা হাত চালান করে দিলাম সুটকেসের ভেতরের দু পাশে থাকা কাপড়ের পকেট গুলোর ডান দিকেরটায়।
হাত ঢুকিয়ে সেই পকেটটির ভেতরে কোন কিছুরই স্পর্শ না পাওয়াতে ঠেলে দিলাম হাত আরো সামনে, তাতেই মনে হলো কোন কিছুর অস্তিত্বের টের পাওয়া গেল। এ অবস্থায় যতোটা পারা যায় বস্তুটির গায়ে দ্রুত হাত বুলিয়ে ওটিকে সম্ভাব্য হাতমোজা মনে হওয়ায় পাকড়াও করে বের এনে চোখের সামনে ধরেই নিজের অজান্তেই, মওকা পেয়ে কিছুটা জোরের সাথেই লাজুকে বললাম- কি খুঁজেছো এতোক্ষণ। এইতো পাওয়া গেল তোমার গ্লাভস । থাক আর খুলতে হবে না ঐ সুটকেস । বলেই সদ্য উদ্ধারকৃত গ্লাভস দুটো ওর দিকে ছুড়ে দিয়ে, ভোমা সুটকেসটির মুখে তালা লাগিয়ে ওইটিকে ট্রলিস্থ করার কাজে লেগে গেলাম।
জানি না যদিও, একটু আগে কিংকর্তব্যপ্রস্তরাবরফাবৎ করে দেওয়া হীম কতোটা মোকাবেলা করতে পারবে ব্যাগ সুটকেস খুলে বের করা অতিরিক্ত গরম কাপড় আর গ্লাভস, তারপরও ওটা করতে পারায় বেশ স্বস্তি এলো মনে। কিন্তু সে স্বস্তির ঘাড়ের উপর সাথে সাথেই নিঃশ্বাস ফেলল একটা অস্বস্তি। আর তা হলো হোটেলে দ্রুত কিভাবে যাবো তার সম্পর্কে নিশ্চিত কোন ধারনা না থাকার অস্বস্তি। দ্রুত তাই বাকি সুটকেস আর ব্যাগগুলোকে ট্রলিতে তুলে দিয়ে, পিঠব্যাগ থেকে সেই ভ্রমণ ফাইলটি ফের বের করে বসলাম পুত্রদের পাশে।
ফাইলের পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে বেইজিং অংশে আসতেই দেখতে পেলাম চেনা হাতের লেখাটা। হ্যাঁ অনলাইনে বুক করা আমাদের বেইজিং এর আস্তানা রিজেন্ট হোটেলের ছবি, ঠিকানা আর ঐ এলাকাটির একটি ম্যাপসমৃদ্ধ পৃষ্ঠাটি, যেটি নাকি হোটেলের ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে এই ফাইলবদ্ধ করে দিয়েছিল, অফিসের ব্যস্ত সময়ের আমার সার্বক্ষণিক সহায়তাকারী সহকর্মী সায়মা, তাতে সে নিজ হাতে লিখে একটা নোট ও দিয়ে রেখেছে। সেই নোট মোতাবেক হোটেলে যেতে হবে এই এয়ারপোর্ট থেকে ছেড়ে যাওয়া ১৫ নম্বর বাসে ! বেশ প্রীত হলাম তাতে।
কিন্তু সাথে সাথেই মনে হল, বুঝলাম না হয় ধরতে হবে ১৫ নম্বর বাস, কিন্তু সেই বাস ধরতে হবে কোন জায়গা থেকে তা তো লেখা নাই। বরং খারাপ একটা খবর লিখে দিয়েছে সায়মা, যা পড়ে মনে পড়লো যে মুখেও ব্যাপারটা বলেছিল ও। আর তা হলো অনলাইনে আমি হোটেলটি বুক করার পর সায়মা ঢাকা থেকে হোটেলে ফোন করে বিস্তারিত কথা যখন বলেছিল আমাদের রিজার্ভেশনের ব্যাপারে, তখন তাদেরকে সে জিজ্ঞেস করেছিল আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাবার জন্য কোন গাড়ি পাঠাতে পারবে কি না হোটেল কর্তৃপক্ষ। উত্তর ছিল না বোধক! মুখে তা আমাকে বলে দেবার পরও, আমি তা ভুলে গিয়ে বেইজিং এ এসে তাকে যাতে শাপশাপান্ত না করি , সেই জন্যই সে গোটাগোটা অক্ষরে তা ফাইলে লিখেও রেখেছে, সাবধানের মার নেই ভেবে। এ লেখাটি দেখে এই অস্বস্তির মধ্যেও হাসি পেল আমার, সায়মার অতি সাবধানতাটি দেখে। মনে হলো কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীদের মধ্যে আমার ব্যাপারে প্রচলিত একটি ভীতিকর ধারনা হলো আমি হলাম ইংরেজিতে যাকে বলে পারফেকশনিস্ট মানুষ। ইংরেজি এই শব্দটি বেশ গালভরা প্রশংসাসূচক মনে হলেও বাংলা এর প্রকৃত মানে দাঁড়ায় খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ, যা হওয়া গর্ব করে বলার মতো কিছু তো নয়ই, বরং তা মোটেও কোন ভাল ব্যাপার নয়!
সায়মার দেয়া এ অতি সাবধানী নোটটি দেখে ব্যাপারটির সত্যতা ফের হৃদয়ঙ্গম করে, আবারো সিদ্ধান্ত নিলাম এই বদভ্যাসটি ছাড়তে হবে আমার। সাথে এও মনে হলো আহারে ঢাকায় বসে আমাদের এ ভ্রমণটিকে যতোটা নির্বিঘ্ন করা যায় ,তার কম চেষ্টা তো করেনি সায়মা। নাহ, ফিরে গিয়ে এজন্য ওকে অফিসিয়াল কেতামাফিক কথার কথা ধন্যবাদ, না এক্কেবারে মন থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে হবে।
“এই শোন খাবারদাবার তো যথেষ্ট আছে আমাদের দুপুরের খাওয়ার জন্য, কিন্তু পানি তো নাই। পানি কিনে আনো “ ওপাশের বেঞ্চিতে বসে একটু আগে ওর সুটকেস থেকে বের করা ফলের প্যাকেট গুলো গোছাতে গোছাতে বললো লাজু ।
ঠিক আছে দাঁড়াও, বাইরে গিয়ে দেখি আছে কিনা কোন দোকানপাট আশেপাশে। ভেতরে যে কিছুই নাই তা তো দেখেছি সবাই। ভরসা এখন বাইরের ঐ হিমচ্যানেলের উপরেই, দেখি পাই কিনা ওখানে পানিয় জল কোন। বলতে বলতে জ্যাকেট খুলে একটু আগে বের করা অতিরিক্ত উলের সুয়েটারটি গায়ে চড়াতে চড়াতে সবাইকে একই তাড়া দিতে দিতে বললাম, দেখি বাইরে গিয়ে যদি আমি ভ্যান ঠিক করতে পারি হোটেলে যাবার জন্য, তাহলে কিন্তু সাথে সাথেই রওয়ানা দেবো আমরা। অতএব এখানে ওরকম ঠাণ্ডা না লাগলেও বাড়তি সুয়েটার আর গ্লাভস পরে তৈরি থাকো।
“তাহলে কি আমরা এখন খাওয়া শুরু করবো না, নাকি? আমি তো তোমার কথা মতো এখনি যাতে খাওয়া দাওয়া শুরু করা যায় তার ব্যবস্থা করছিলাম”, পিঠ ব্যাগ থেকে কেক বিস্কিট এসব বের করায় ব্যস্ত লাজুর স্বগতোক্তি শুনতে শুনতে হাতে হাতমোজা গলাতে গলাতে আবারো হিমচ্যানেলে ঝাঁপ দেয়ার উদ্দেশ্যে গেইটের দিকে রওয়ানা হতে হতে বললাম, একটু অপেক্ষা করো সবাই। যদি হোটেলে যাওয়ার ভ্যান ঠিক করেই ফেলতে পারি এরই মধ্যে, তবে হোটেলের পথে যেতে যেতে গাড়িতে বসেই খাওয়া যাবে। আমার ফাইলের তথ্য মোতাবেক জ্যাম না থাকলেও হোটেলে পৌঁছুতে লাগবে প্রায় ঘণ্টাখানেক।
কথা বলতে বলতে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওটি খুলে যেতেই ভাবলাম একটু আগেকার মতো এই লাউঞ্জের উষ্ণতা পেছনে ফেলে হঠাৎ করে না জেনেই যেমন ঝাঁপ দিয়েছিলাম তেমনি করবো কি ফের? না কি ধীরে ধীরে গায়ে ঠাণ্ডা সইয়ে নিয়ে নামবো সামনের জলহীন ঐ হিচ্যানেলে? এ সময় কিশোর কালে আমাদের কুমিল্লার বাসার সামনের বিশাল দীঘিটিতে শীতকালে গোসল করার বিশেষ টেকনিকটির কথা মনে পড়লো। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে প্রথম থ্যালাসেমিয়া আন্দোলন
পরবর্তী নিবন্ধসাইবার যুদ্ধ, প্রপাগাণ্ডা ও সোশাল মিডিয়ায় সেনাবাহিনীকে বিতর্কের বাইরে রাখা এবং নাগরিক কর্তব্য