সাইবার যুদ্ধ, প্রপাগাণ্ডা ও সোশাল মিডিয়ায় সেনাবাহিনীকে বিতর্কের বাইরে রাখা এবং নাগরিক কর্তব্য

মেজর (অব.) আহমেদ ফেরদৌস | রবিবার , ১ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

একজন সতেরো আঠারো বছরের যুবক এইচএসসি পাস করে অফিসার হবার স্বপ্ন নিয়ে যোগদান করেন চট্টগ্রামস্থ ভাটিয়ারীতে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমিতে। টগবগে তরুণ এই যুবক ২ বছর কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে শপথ নেয় দেশ ও জাতিকে বহিঃ শত্রুর হাত হতে রক্ষা করতে। একজন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যের কাঁধে ন্যস্ত সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব যা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সে থাকে অবিচল এবং অকুতোভয়। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য এবং একজন সাধারণ নাগরিকের মাঝে প্রধান মৌলিক পার্থক্য কি কেউ বলতে পারবেন?
একজন সৈনিক জীবনে তার কর্মের Consequence ভেবে কোনো কাজ করে না। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত নন, যদিও তিনি জানেন এ যাত্রায় তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। অধিনায়কের আদেশ তাই তার জন্য হয়ে দাঁড়ায় পালনীয় বেদবাক্য। পক্ষান্তরে সেই সৈনিকেরই একজন বেসামরিক বন্ধু কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় ১০০% গ্যারান্টেড সাফল্য নিশ্চিত পথে সুকৌশলে এড়িয়ে যাবে Better Option অন্বেষণের চেষ্টায়।
এতো লম্বা ফিরিস্তির প্রয়োজন অনুভূত হয় যখন আইনের সুশাসন নিয়ে আত্মায় শংকার দানা বাঁধে। কমরেড মেজর রাশেদ সিনহা এবং সদ্য ঘটে যাওয়া নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেঃ ওয়াসির ঘটনা যেকোন দেশেই একটি অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই নয়, উদ্বেগজনকও বটে, যখন বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী কিছু ব্যক্তিবর্গ বিশেষত সাবেক সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ হঠাৎ ২/৩ মাস ধরে কানাডা ও যুক্তরাজ্য হতে ইউটিউব ও সোশাল মিডিয়ায় সত্য মিথ্যা তথ্যের ককটেল মিশিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী এবং দেশের সুনাম ধ্বংসকল্পে উতলা হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে উস্কে দিচ্ছেন সাংঘাতিক কিছু সাংবাদিক, যাদের পূর্ব ইতিহাস কলংকিত।
আমি ব্যক্তি বিদ্বেষের ঘোরতর বিপক্ষে বিধায় এতোদিন মুখে কুলুপ মেরে ছিলাম বসে। কিন্তু Enough is Enough.
আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দ্বিমত থাকতে পারে রাজনৈতিক সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে। আমি তা শ্রদ্ধা করি।
কিন্তু রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বিশেষত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধান এবং সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কমান্ড চ্যানেলের কর্মকর্তাকে যখন পাবলিকলি বক্তৃতা ও বক্তব্যের মাধ্যমে হেয় করার চেষ্টা করা হয় প্রতিদিন কলের গানের মতোন, তখন আমার প্রতিবাদী কলম কন্ঠে জেগে ওঠে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমির পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত উক্তি ‘চির উন্নত মম শির’। একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাহেবের কথাবার্তা শুনে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারেন। ইনি কে?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতি মরহুম জেনারেল জিয়াউর রহমানের ন্যায় সুনির্দিষ্ট আদেশ দেয়া নাকি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
এই দুই প্রয়াত নেতার কানি আঙুলের সমান যোগ্যতাও যদি থাকতো মেজর অবঃ’র, তবে কসম খোদার ১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছায় অবসর জীবন কাটানোর পরেও দেশের প্রয়োজনে আবারো নিতাম সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব।
কিন্তু যে মানুষটি আজ ইউটিউবে রাত-দিন ‘গোয়েবল’স থিওরীর’ মতোন হাজারবার অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে তাকে সত্য বানাতে মরিয়া, যে মানুষটি Materialistic Gain এর জন্য অনেক গভীর প্রণয়কে সম্পূর্ণ অস্বীকার করত বালিকা বিবাহে সম্মত হন তৎকালীন জেনারেল অফিসার কমান্ড জেনারেল সা.. এর কন্যাকে বিবাহের দ্বারা, যে মানুষটি ন্যায় নীতির হেদায়েত করেন, অথচ নিজেই চোখ পাল্টি দিয়ে বারবার তার নিজস্ব রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন – সেই মেজর অবঃ দে..র এর কথা শুনে বিভ্রান্ত হবো? পাগল নাকি বাংলাদেশী জনগণ? তবে একটা জিনিসে তাদের কৃতিত্ব দিতেই হয়। বাংলাদেশে এতোগুলো টিভি চ্যানেলের উপস্থিতিতে বিনোদনমূলক চ্যানেলের মাঝে ভাঁড়/কৌতুক অভিনেতার আকালে এদের Entertainment এ সত্যি কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে হাসানোর জন্য কানাডা প্রবাসী এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসারের রসাত্মক কার্যক্রম অবলোকন করে মাঝেমধ্যে মন চায় সরকার হতে বিনোদন চ্যানেলের একটা লাইসেন্স নিয়ে এই দুই সদ্য ভাঁড় ও কৌতুক অভিনেতাকে দিয়ে বকবক করিয়ে জনগণকে ব্যাপক বিনোদন দিয়ে কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতার পথ বেছে নিতে। যাকগে, আজকের বিষয়ের অবতারণা এসব ভাঁড়দের নিয়ে নয়।
বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের হাইওয়েতে 4th Gear এ বাহন ধাবমান, বাংলাদেশ যখন করোনা পরবর্তী ধাক্কা বহু কষ্টে কাটিয়ে ৫ম গিয়ারে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকাস্থ মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক দিয়ে মাত্র ৪২ মিনিটে মাওয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত উড়াল দিচ্ছে, তখনি এসব বিচ্ছিন্ন পরিত্যক্ত ব্যক্তিবর্গ কেন, কি জন্য এবং কি উদ্দেশ্য নিয়ে কা কা করছে, তা বোঝার অন্তঃদৃষ্টি বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণেরই আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
একটা কথা মনে রাখতে হবে। প্রয়াত জেনারেল এরশাদ শাসনামলে তার অর্থনৈতিক কু-কর্ম জনগণ মেনে নিলেও তার আলুর দোষের কাহিনী যখন জনগণ জানতে পারলো, তখনি ৯০ এর গণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে গদিচ্যুত করলো।
ব্যক্তি চরিত্র আক্রমণ আমার পছন্দ নয় বলে এই উপরিউক্ত দুজনকে মাশা’ল্লাহ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেবের যোগ্য উত্তরাধিকার বললে ভুল হবে কি? বাংলাদেশের জনগণকে দয়া করে অশ্রদ্ধা করবেন না, তারা যথেষ্ট সচেতন। তাদের বিভ্রান্ত করবেন এতো সহজে? আহাম্মক পেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষজনকে?
হাজী সেলিম এমপির পুত্র পাজি অমুক – আপনি এবং আপনার ইন্ধনদাতাগণ – সাবধান। আগুন নিয়ে খেলবেন না। এক মাঘে শীত যায় না। তাই বলে এই নাজুক ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য মেজর অবঃ দ গং – আপনি ও আপনার মদদ দাতাগণও সাবধান। দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে খেলতে চাইলে বাংলাদেশের জনগণ শুধু এইটুকুন বলবে ‘৭১ এ বিশ্বের সবচেয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীকে যখন ৯ মাসে নাস্তানাবুদ করে প্যাকেট বন্দী করে ওয়া-পাস পাঠিয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানে – তেমনি তোমাদেরও পরিণতি হবে আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে।’
জোঁকের কামড়ে রক্ত কণিকাগুলো বাঁচাতে তখন উন্নত বিশ্বের Justin Trudo এর দেশও পারবে না বাঁচাতে তোমাদের হে উজবুকগণ। বাংলাদেশের মানুষের আস্থার প্রতীক এবং শেষ অবলম্বন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্যের বাহিনী। এটা কোনো দল, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তির সেনাবাহিনী নয় বিধায় জাতীয় স্বার্থে প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব এই বাহিনীকে রাজনীতি ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের জনগণ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও গর্বের ধন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইমেজ স্ব-প্রয়োজনেই আগলে রাখবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবসায়ী সাতকানিয়ায় অপহরণ, বাঁশখালীতে উদ্ধার