বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ২৮ জুন, ২০২১ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

মহারোগ কোনটি
মহারোগ কোনটি? একজন ব্যবসায়ীকে আমি এই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন, ‘ক্ষুধা’ হচ্ছে মহারোগ। বাংলাদেশে এর মহাষৌধ হলো ‘ভাত’। আমার মাথার ভিতর এখন করোনাভাইরাস ছাড়া অন্য কোন চিন্তা কাজ করে না। বাংলাদেশে এখন ভারতীয় ধরনের করোনাভাইরাস ‘ডেল্টা’ মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চুয়াডাঙ্গায় ১০০ শতাংশ মানুষের শরীরে ডেল্টার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। ঢাকাকে অন্যান্য জেলা থেকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ ছাড়া আর কোন মহারোগ থাকতে পারে এবং ভ্যাকসিন ছাড়া প্রতিরোধের জন্য অন্য কোন মহাষৌধ থাকতে পারে এটা আমার মাথায় আসছে না। আমি ঐ ব্যবসায়ীকে বললাম, তুমি কোভিডকে ভয় পান না? তিনি বললেন, সাধারণ মানুষ এতো কিছুর পরেও কোভিডের ভয়ে ভীত নয়। লকডাউন দিলে মানুষ তা মানে না। আমি তাকে বললাম, কেন মানে না? তিনি বললেন, মানুষ প্রশ্ন করে লকডাউনের মধ্যে ঘরে বসে থাকলে আমরা খাবো কি? লকডাউন ব্যর্থ হওয়ার জন্য বিএনপি সরকারকে দোষারোপ করে। আওয়ামী লীগ বলে আমাদের সরকার এবং দল প্রাণপণে মানুষকে বোঝাচ্ছে। আমাদের চেষ্টার কোন ঘাটতি নাই। মানুষকে বোঝাতে বোঝাতে আমরা ক্লান্ত। নিজের বিপদে মানুষ সতর্ক হয় না। প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা যদি এর চাইতে বেশি বল প্রয়োগ করি তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা শুরু হবে। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থে কঠোর হওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন বিকল্প থাকবে না। আমি ব্যবসায়ীকে বললাম, তোমার কি মনে হয়? কেন মানুষ মাস্ক পরে না? কেন বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয় না? কেন দূরত্ব বজায় রাখে না? ব্যবসায়ী বললেন, মানুষের মনস্তত্ত্বে ‘রেসিস্টেন্স টুওয়ার্ড চেঞ্জ’ বা পরিবর্তনে অনীহা নামক একটি ফ্যাক্টর আছে। মানুষ কোন নতুন অভ্যাস সহজেই গ্রহণ করতে চায় না। শত চেষ্টা করলেও মানুষের মাস্কপরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে নেওয়ার গতি ধীর হতে বাধ্য। আমি ব্যবসায়ীর বক্তব্য শুনে উৎসাহিত বোধ করলাম। মনে হচ্ছে তার চিন্তা ভাবনাতে নতুনত্ব আছে। আমি তাকে বললাম, তুমি বলেছো ক্ষুধা একটি মহারোগ। তুমি একজন বড়ো শিপিং ব্যবসায়ী। তোমার অনেক জমিজমা আছে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তুমি ক্ষুধার্তদের জন্য কিছু করার কথা ভাবছো? সে বললো, আমি কি ভাবছি এবং কি করছি তা আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারি যদি আপনি সময় নিয়ে আমার কথা শুনতে চান।
ঐ ব্যবসায়ী আমাকে কি বলেছিল, এবার আপনারা তার মুখ থেকে তা শুনুন। ব্যবসায়ী বললো, এক রাত্রে আমি আমার বাড়িতে বসে আছি, দরজার বাহিরে একজন মানুষের কাতর শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল সে সাহায্য চাইতে এসেছে। আমি দরজা না খুলে প্রশ্ন করলাম, তোর নাম কি? সে বললো, ইছুপালি। আমি দরজা খুললাম। তাকে বললাম, ভেতরে আয়। সে বললো, আমি লেইঙ্গা (পঙ্গু)। আমি বললাম, তোকে আমি ভেতরে আসতে সাহায্য করবো। সে বললো, আমার জামাকাপড়ে ময়লা, আপনার কার্পেট, সোফা, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার বরবাদ হয়ে যাবে। আমি বললাম, মানুষ পবিত্র। তাকে আমার সাথে টেবিলে বসিয়ে খাবার খেতে দিলাম। আমি খাবার খেলাম।
আমার বাড়ীটি একশো বছর আগে আমার পূর্ব পুরুষেরা নির্মাণ করেছিলেন। বাড়িতে নিরাপত্তা প্রহরীর কোন অভাব নেই। কোন মানুষ ভিতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু যারা সাহায্য চাইতে আসে, যারা অভুক্ত, প্রহরীরা তাদেরকে আমার দরজায় পৌঁছে দেয়। দুইবেলা খাওয়ার আগে আমি মোসাফিরের জন্য অপেক্ষা করি, একা খাইনা। আমার বাবার নাম মোশারফ আলী খান। আমাদের উর্দ্ধতন পুরুষের একজন হলেন ডরফ আলী খান। উনার জাহাজের ব্যবসা ছিল। সে যুগের সমুদ্রগামী জাহাজকে বলা হতো সরের জাহাজ। তিনি ব্রিটিশ বঙ্গ থেকে জাহাজ ভর্তি করে আকিয়াব, মান্দালয়, রেঙ্গুনে ডিম সরবরাহ করতেন। মৃত্যুকালে তিনি তার সন্তানদের হাতে ৯৬০০০ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে যান। তার প্রচুর ভূসম্পত্তি ছিল। আমি এই সম্পদের একটি অংশের মালিক হয়েছি। আমি শিপিং ব্যবসা করে নিজে অনেক টাকা রোজগার করেছি। এখন আমার সন্তানেরা ব্যবসা দেখাশুনা করে। আমি ঘরে বসে মানুষের মঙ্গল চিন্তা করি। ব্যবসায়ীদের এরকমই হওয়া উচিত। আমি আমার সম্পদের এক কানা কড়িও কবরে নিয়ে যেতে পারবো না। কিন্তু যদি ভালো কাজ করি, সে ‘আমল’ আমার সাথে পরকালে সাথী হবে।
তার আরো বহুদিন পরের কথা, আমি কিছু মানুষের খাওয়ার আয়োজন করেছিলাম, সেখান থেকে রাত্রে হেঁটে বাসায় আসার সময় রাস্তায় একজন সুদর্শন মানুষের দেখা পাই। অন্ধকারের মধ্যেও তাকে আমি চিনতে পারি। তাকে বলি তোর নাম কি? সে বলে ইছুপালি। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি না পঙ্গু? সে বললো, আমি পঙ্গু নই। আমি আপনার মতো একজন ব্যবসায়ী। আমি আপনাকে পছন্দ করি। আপনার কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করি এবং আপনাকে অনুসরণ করি। আমরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে আমার ঘরে এসে মুখোমুখি বসলাম। সে বললো, আপনি বিশিষ্ট শিপিং ব্যবসায়ী আলী হায়দার খান আর আমি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী খান। আপনার পদক্ষেপগুলো আমি খুব কাছ থেকে অবলোকন করি। আপনি চট্টগ্রামে অনেকগুলো ক্লাবে গরীব দুঃখী মানুষকে খাওয়ানোর আয়োজন করেছেন। প্রতিদিন খাবার দাবার চলতে থাকে। একটি ক্লাবে একবেলায় পাঁচশো মানুষকে খাওয়ালে দুই বেলায় এক হাজার মানুষকে খাবার দিতে হয়। জনপ্রতি ১০০ টাকা খরচ হলে ১০০০ মানুষের জন্য প্রতিদিন ১ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিদিন ১০টি ক্লাবে খাবার সরবরাহ করলে আপনার ব্যয় হয় ১০ লাখ টাকা। সে হিসেবে আপনার মাসে ব্যয় হয় ৩ কোটি টাকা। একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে প্রতিমাসে ৩ কোটি টাকার খাবার মানুষকে খাওয়ানো কল্পনার অতীত বলে আমার মনে হচ্ছে। যদি কোন সুযোগ থাকতো, আমি আপনার বুক কেটে কলিজাটা হাতে নিয়ে দেখতাম, আপনার কলিজাটা কতো বড়ো। হায়দার আলী খান হাসলেন। ইউসুফ আলী বললেন, আমি গার্মেন্টস ব্যবসাতে ভালো আয় রোজগার করি। আপনার চিন্তাটা আমার মাথার ভিতর ঢুকে গেছে। এই দেশে মহারোগ কোনটি? মহারোগ হচ্ছে ‘ক্ষুধা’। মহাষৌধ হচ্ছে ‘ভাত’। করোনা মোকাবিলা করতে হলে আমরা ব্যবসায়ীরা টাকার থলে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে ভাত দিলে তারা লকডাউনে কম ঘোরাঘুরি করবে। আমি আমার টাকা, সম্পদ কবরে নিতে পারবো না। মানুষকে খাওয়ালে অন্ততঃ একটা ভালো কাজ করার তৃপ্তি পাবো। হায়দার আলী খান, আপনি প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকা আপনার ব্যবসায়িক তহবিল থেকে খরচ করেন। আমি প্রতি মাসে আপনাকে আরো ৩ কোটি টাকা দিবো। আপনি আপনার মানুষকে খাওয়ানোর কেন্দ্র আরো দশটা বাড়িয়ে দিন। যদি মানুষকে একসাথে বসিয়ে খাওয়ানোতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে তাহলে আমরা মানুষের হাতে খাবারের প্যাকেট দিয়ে দিবো। মানুষ দেখুক ব্যবসায়ীরা শুধু মুনাফার টাকা নিজে খায়না, মানুষকেও খাওয়ায়। (চরিত্রগুলো কল্পিত)।
ব্যবসায়ী হায়দার আলীর বক্তব্য এতোক্ষণ ধরে শুনছিলাম। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধের জন্য আমি খানকে ধন্যবাদ জানালাম। একটি গণমাধ্যমে ছোট্ট একটি সংবাদ দেখে মানুষের মানবতাবোধ সম্পর্কে আমার মনে আরো আস্থা তৈরি হলো। রাজশাহীতে পুলিশ সদস্যরা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির ঘরে টেলিফোন করা মাত্র অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেখানে অক্সিজেন ব্যাংক স্থাপন করেছে। ব্যাংকে ৭০টিরও বেশি সিলিন্ডার আছে। কোন অসহায় করোনা রোগী শ্বাসকষ্টে পড়ে গেলে পুলিশের কাছে ফোন করে, পুলিশ সদস্যরা দ্রুত সিলিন্ডার নিয়ে রোগীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার শ্বাসকষ্ট দূর করার চেষ্টা করে। একেক রোগীকে ৩টিরও বেশি সিলিন্ডার দিতে হয়। পুলিশ বলছে তারা সিলিন্ডারের সংখ্যা এবং সেবাদানের পরিমাণ আরো বাড়াবে। বাংলাদেশ এখন করোনা বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। একে অপরকে দোষারোপ না করে সবাই এই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ুক এটাই আমরা চাই। বাংলাদেশে মহারোগ কোনটি এটি নির্ণয়ের চেষ্টা আপনিও করতে পারেন। আমরা কি ক্ষুধায় মরবো? না করোনায় মরবো? নাকি দুটিকেই আমরা পরাজিত করতে পারবো?
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধগোদের ওপর বিষফোঁড়া রোহিঙ্গা : বাংলাদেশ আর কতকাল সইবে এই বোঝা
পরবর্তী নিবন্ধকানাডার আদিবাসী এলাকায় পুড়ল আরও ২ গির্জা