আমাদের দেশের সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে শুধু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেই হবে না, সেই প্রযুক্তিকে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগাতে হবে। তবেই জাতি উপকৃত হবে।
গতকাল রবিবার (২৮ মার্চ) কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত ‘সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে আলোচকরা এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইতি রাণী পোদ্দার। সেমিনারে আলোচ্য বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, সমুদ্রে প্রায় ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল, অথচ গড়ে ৩০ নটিক্যাল পর্যন্ত আমরা ব্যবহার করতে পারছি। অধিকন্তু বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোর ৪০ মিটারের কম গভীরতায় মাছ ধরার অনুমতি না থাকলেও তারা তা মানছে না। গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা না থাকায় এদেশের জেলেরা উপকুলের কাছকাছি মাছ ধরে। তবে এদেশের জেলেরাও যাতে গভীর সাগর থেকে মাছ ধরে আনতে পারে, তাদের প্রশিক্ষণের জন্য শ্রীলংকা থেকে কয়েকজন জেলেকে আনা হচ্ছে।
ড. শফিক বলেন, হ্যাচারীতে পোনার খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার আর্টিমিয়া আমদানী করা হয়। অথচ তিন দশক আগেই এদেশের বিজ্ঞানীরা সফলভাবে আর্টিমিয়া তৈরীর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদেশের বিজ্ঞানীরা অতীতে অনেক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু সেই প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগানো হয়নি। সুনীল অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে শুধু প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেই হবে না, সেই প্রযুক্তিকে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগাতে হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের ২০১৯-২০ অর্থবছরের গবেষণা ফলাফলসহ মোট ৭টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
সেমিনারে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে থাকা বিরল খনিজ সম্পদের ভ‚-তাত্তি¡ক জরীপের ফলাফল তুলে ধরে সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের ভ‚-তাত্তি¡ক ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, আমাদের সাগরের তলদেশে ৩১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মোনাজাইট, জিরকন, রুটাইল, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ফসরাস, সালফেট ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসহ
মূল্যবান খনিজ পদার্থের ভান্ডার পাওয়া গেছে। এছাড়া সাগরের তলদেশে সম্ভাব্য ১শ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে, যে মজুদ দিয়ে আমরা ১শ বছরের চাহিদা মিটাতে পারবো। বর্তমানে দেশে মাত্র ১৪ বছরের গ্যাস মজুদ রয়েছে।
সেমিনারে সেন্টমার্টিনের কোরালের উপর দূষণের কারণে সৃষ্ট রাসায়নিক প্রভাব তুলে ধরে কেমিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে নাফনদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেলে সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলোর উপর দূষণজনিত চাপ পড়ে। বছরের বাকী সময়ে সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলো স্বাস্থ্যবান থাকে।
সেমিনারে বঙ্গোপসাগরের রূপতত্ত¡ তুলে ধরেন ফিজিক্যাল ও স্পেস ওশানোগ্রাফি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রূপক লোধ ও শাহীনুর রহমান, সাগরের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন এনভায়রণমেন্টাল ওশানোগ্রাফি ও ক্লাইমেট বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মীর কাশেম ও সুলতান আল নাহিয়ান এবং অপ্রলিত খাদ্য ভান্ডারের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন ওশানোগ্রাফি ডাটা সেন্টারের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তানিয়া ইসলাম। এছাড়া আলোচনায় আরো অংশ নেন পরমাণু শক্তি কমিশনের সৈকত খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাসুদ করিম, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হুদা, মৎস্য বিশেষজ্ঞ পলাশ খন্দকার, ইকোলাইফের ম্যানেজার মো. আবদুল কাইয়ুম, শিল্পোদোক্তা ওমর হাসান, সাংবাদিক আহমদ গিয়াস প্রমূখ।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে আরো বক্তব্য দেন নৌ-বাহিনীর লে. কমান্ডার মাহবুবুর রহমান সিকদার ও কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বিপ্লব।