বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও দিকনির্দেশনা

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | শুক্রবার , ২৯ মার্চ, ২০২৪ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায় ৭১ এর ৭ মার্চের ঘোষণাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিহিত। এ প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রায় ২৪টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা যাঁর আদর্শের পথে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে আবির্ভূত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মূলত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন, নিষ্পেষণ চালিয়ে আসছিলো প্রায় ২৪ বছর ধরে।

বাঙালির ক্ষোভ, ঘৃণা দীর্ঘ সময় ধরে পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকলো। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৬৬ এর ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ‘৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ‘৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবতে বাঙালিকে নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল। ৫২ থেকে বাঙালির প্রতিটি সংগ্রাম বিপ্লবে যাঁর সুবিশাল অবদান ছিল তিনি হলেন নিপীড়িত জনগণের ত্রাণকর্তা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে বিচার করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বড় মাপের মানুষ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

৭০ এর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী চায়নি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানে সরকার গঠিত হোক। সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির নন্দিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে বৃথা কালক্ষেপণ করে চলেছিল। এরিমধ্যে অগ্নি ঝরা মার্চ বাঙালির জীবনে বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। ১ মার্চ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধের ঘোষণায় ২ মার্চ থেকে ঢাকায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৩ মার্চ থেকে ঢাকাসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে মঞ্চ কপানো ভাষণে পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন “সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। মরতে যখন শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর,বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এ গগনবিদারী স্লোগান জনসমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিশে গিয়েছিল। স্বাধীনতা শব্দটা যেন উদগ্রীব, উদ্বেলিত জনতার মনের ধ্বনিতে পরিনত হয়। উচ্ছসিত আগ্রহ নিয়ে জনতা অপেক্ষায় ছিল কখন বঙ্গবন্ধুর মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা যাবে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদিও শঙ্কিত ছিল বঙ্গবন্ধু আবার কখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়ে সেদিনের মহাসমাবেশে সুকৌশলে ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণটি ছিল বিশ্বনেতৃবৃন্দের এক অত্যুজ্জ্বল ভাষণ। মূলত জাতির পিতার ৭ মার্চে ঐতিহাসিক এ ভাষণটি স্বাধীনতার পূর্ব ঘোষণা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের অগ্নিঝরা মার্চের দিনগুলো যতই অতিক্রান্ত হচ্ছিল স্বাধীনতার বিজয় লাভের আন্দোলন ততই চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করলো। ক্ষোভে, নিপীড়নে শোষিত বঞ্চিত বাঙালি ক্রমেই গর্জে উঠে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিনটিও ছিল গণবিক্ষোভে টালমাটাল। ফলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের ওপর অকার্যকর হয়ে পড়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর স্বাভাবিক প্রশাসন।

পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কূটচাল দীর্ঘ মাসব্যাপী চলার পর বর্বর পাকবাহিনী ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শুরু করে নির্মম গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ ঢাকার বিভিন্ন যায়গা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুমন্ত লোকের ওপর আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। শুরু হয় মানবতার ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করে জঘন্য হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে নরখাদক টিক্কা খানের “আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, মাটি চাই” পোড়ো নীতির বাস্তবায়ন। গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান ই পি আর হেডকোয়ার্টারে ওয়ারলেসের মাধ্যমে ৭ মার্চের ঘোষণার আলোকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । বঙ্গবন্ধু বলেন “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমার জীবনে তোমাদের সাথে দেখা হতে না পারে। বাংলার ঘরে ঘরে জানিয়ে দাও যে পর্যন্ত না সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা না পাবে, সংগ্রাম চালিয়ে যাও, যুদ্ধ চালিয়ে যাও । পরদিন ২৬ মার্চ সকাল থেকে রাত গভীর পর্যন্ত কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা এম এ হান্নানের ভরাট কন্ঠের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনগণ শুনতে পেয়েছিল। পরদিন ২৭ মার্চ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু’র পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয় “শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলামনা”। এখানেও ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিহিত ছিল। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছিল।

পাপ কখনো চাপা থাকেনা। ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের মিত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং মুক্তি বাহিনীর অন্যতম সেক্টর কমান্ডার এয়ার মার্শাল এ কে খন্দকারের নিকট নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লক্ষের অধিক শহিদ এবং দু’লক্ষাধিক মাবোনের সম্ভ্রম এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালির অর্জিত স্বাধীনতার আনন্দ বেদনায় ঢাকা পড়ে যখন ‘৭১ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতে এদেশীয় এবং আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্রের দোসর কর্তৃক বাঙালির নন্দিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং আরো অনেক আত্মীয়স্বজনসহ নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপনি মহান মৃত্যু দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। বৃটিশ সাংবাদিক ব্রায়ান ব্যারন বলেছিলেন “শেখ মুজিব সরকারি ভাবে এবং জনগণের হৃদয়ে অন্যতম আসনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার”। তিনি বাঙালির হৃদয়ে এবং বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে মৃত্যুঞ্জয়ী বীর হয়ে বেঁচে আছেন। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর কথায় টুঙ্গীপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের কবর আজ সমাধিস্থল এবং বাঙালির তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। কোটি জনতার অন্তরে আজ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন চেতনা বহমান। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা গণতন্ত্রের মাতা ( মাদার অব হিউম্যানিটি) দেশরত্ন শেখ হাসিনার যাদুকরী নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে আছে। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঙালির নিরলস প্রচেষ্টা, কঠোর ত্যাগ, সততা ও দেশপ্রেম পারবে বাংলাদেশকে উন্নয়ন অগ্রবর্তীতে জাতির পিতার সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে পূরণ করতে।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাকাত অনাদায়ে কোরআনে বর্ণিত শাস্তিসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা