বই হোক নিত্যসঙ্গী

ডা. দুলাল দাশ | সোমবার , ৪ মার্চ, ২০২৪ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্নদেশে বইকে বিভিন্ন ভাষায় ডাকা হয় যেমন: পুস্তক, কিতাব, বই, বুক, গ্রন্থ আরও অনেক। বই বিভিন্ন আকারে বিভিন্ন রঙ্গে ছাপানো হয়। কাগজেরও তারতম্য থাকে। বই এসেছে ছাপাখানার ও আগে। শিশু বয়সে জীবনে প্রথম যে দিন পড়তে বসি সেইটাই বই। সেই যে শুরু হলো তার সাহায্য নিয়ে সারা জীবন চলতে হয়। সুস্থ মননশীলতা গঠনে বইয়ের ভূমিকা অফুরন্ত। যারা বই পড়ে তাদের চিন্তা চেতনা প্রগতি ও সৃষ্টিশীলতা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখ হয় র্স্মাট ফোন সব বয়সী লোকদের বই বিমুখ করে ফেলেছে। আমাদের কৈশোর, যৌবন বয়সে দেখতাম বই পড়া একটা বিরাট নেশা ছিল। বইগল্পউপন্যাস নিয়ে জানালার পাশে, খাটে, গাছ তলায় এমন মগ্ন থাকত, ঐ দিকে মা ভাত খেতে ডাকছে আসি আসি করে ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। জরুরি কাজ বাদ গেলো। এখন সেই দৃশ্য দেখা যায় না। এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি আছে। বলা হয় একটি বই ১০০টা বন্ধুর সমান। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। সমস্যা হলো, সব বইয়ের এখন ওয়েব ভার্সন হওয়াতে পড়ুয়ারা গুগুল সার্চ করে ঐগুলি পড়ে। তাই তারা বই পড়তে আগ্রহী নয়। এই প্রজন্মের পড়ুয়াদের ইন্টারনেট, স্মার্টফোন গ্রাস করে ফেলেছে। সারাটাদিন তারা যোগাযোগ মাধ্যমে লুটোপুটি খাচ্ছে। তরুণ সমাজকে মাদকাশক্তি, উত্ত্যক্তকরণ, কিশোর গ্যাং কালচার সহ নানা ক্ষতিকর প্রবণতা হতে মুক্তি দিতে বইপড়ার আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। অভিভাবকেরা একটু সচেতন হলে ছেলেমেয়েদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব। বই চিরকাল এই বিশ্ব জগতে জ্ঞানের ভাণ্ডার ছড়িয়ে দিচ্ছে। জ্ঞানের অভাবে যারা অন্ধকারে ছিল তাদের আলো দেখাচ্ছে বই। বিদ্যা অমূল্য ধন। সেটা অর্জন করতে হয় বইয়ের মাধ্যমে। বই অজানাকে জানাচ্ছে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা দীক্ষা। যুগে যুগে গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে বইয়ের মাধ্যমে। হাজার বছরের পুরোনো গ্রন্থ, সভ্যতার বিকাশ, ইতিহাস, ধর্মীয় অনুশাসন খুঁজে বেড়ায় বইয়ের মধ্যে। বিশ্ব পর্যটন, আবিষ্কার, ভৌগোলিক, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সব জানা যায় বইয়ের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রীস, প্রাচীন ভারত, চীন থেকে শুরু করে আজ অবদি সর্বস্তরে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বই ছাড়া ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন উন্নতি লাভ করতে পারে না। যতই পরিবর্তন আসুক তবুও বইয়ের বিকল্প হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে লাইব্রেরি, পাঠাগার খালি পড়ে থাকত। ফেব্রুয়ারির ২১শে বই মেলাসহ বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশে আয়েজিত বইমেলাসমূহ বিপুল উৎসহ উদ্দীপনার সাথে উৎযাপিত হয়। এই বই মেলা শুরু হয় ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর পর। প্রচুর পাঠকের সমাগম হয়। কবি, সাহিত্যিকের দেখা মেলে। যেভাবে এই প্রজন্ম বই পড়তে উৎসাহ হারাচ্ছে। সেখানে বই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। জানা যায় এখন শিক্ষকেরা ক্লাসে ঢুকে স্মার্ট ফোন হাতে। যেখানে লেকচার রেডি করা থাকে। আমাদের সময় দেখতাম স্যারেরা বই ও ডাস্টার হাতে শ্রেণিকক্ষে ঢুকত। ষাটের দশক পর্যন্ত বিয়ে উৎসবে নামকরা কবি, লেখক ও উপন্যাসিকের বই উপহার হিসাবে দিত। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও বই আদান প্রদান হতো। এখন একেবারে নেই। যেমন শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, দেবদাস, রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা, নজরুলের ব্যথারদান আরও অনেক। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ডিকশনারী, এনসাইক্লোপেডিয়া এইগুলি যুগ যুগ ধরে বই আকারে পৃথিবীতে থাকবে। বইয়ের মূল্যবোধ সম্বন্ধ প্রেসিডেন্ট এ. পি জে আবদুল কালাম বলেছেনযে দেশে জুতা বিক্রি হয় এয়ার কন্ডিশন রুমে আর বই বিক্রি হয় ফুটপাতে সে দেশে দুর্নীতিবাজরা থাকবে পাঁচ তলায়, আর জ্ঞানী লোকেরা থাকবে গাছ তলায়। কবিগুরু শত বৎসর আগে শত বৎসর পরের কথা বলে গেছেন– ‘আজ হতে শত বৎসর পরে কে তুমি পড়েছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে। এই গুলি খুঁজে পাওয়া যায় বইয়ে। বই এমনি একুটা জিনিশ ব্রাজিলের কিছু কারাগারে বই পড়লে অপরাধীদের শাস্তি কামিয়ে দেওয়া হয়। একজন বন্দী মাসে একটি বই পড়লে তার সাজার মেয়াদ মাসে চার দিন কমে যায়। এক বৎসরে কমে যায় ৪৮ দিন। আমাদের জীবদ্দশায় বিশ্বব্যাপী কোভিড১৯ ঘটনাগুলি এবং সুনামির মতো ধ্বংসজজ্ঞ বিপুল সংখ্যক লোকের প্রাণহানি আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি। এই ঘটনাগুলি বই আকারে লিপিবদ্ধ থাকলে একদিন ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। চীনে প্রায় চার হাজার বছর আগের তথ্য পাওয়া যা। একটা বই একটা ছাত্রকে নিশ্চিত ফাঁসি থেকে কীভাবে বাঁচাল এই ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করব। ১৬৫৬ সাল, তখন পালতোলা জাহাজের যুগ। ইংল্যান্ড ও স্পেনের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ লেগে থাকত। সমুদ্র যাত্রা একেবারেই নিরাপদ ছিল না। ইংল্যান্ড থেকে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ পর্তূগাল যাচ্ছিল। সেই জাহাজে করে ১৫ বছরের একটা ছাত্র ইংল্যান্ড থেকে পর্তুগালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাচ্ছিল। মাঝপথে স্প্যানিয় একটা যুুদ্ধ জাহাজ সেটাকে আক্রমণ করে। তারা ব্রিটিশ জাহাজটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। স্প্যানিয় সৈন্যরা জাহাজটির প্রায় সব নাবিকদের কেটে সমুদ্রে ফেলে দিল। যে কয়জনকে বন্দি করল তার মধ্যে ঐ ছাত্রটা ছিল। ছাত্রটা স্পেনীয় ক্যাপ্টেইন কে বললো, ‘স্যার আমি নাবিক নই, আমি কোনও অপরাধ করিনি, আমাকে ছেড়ে দিন। ক্যাপ্টেইন বললো যেহেতু ‘তুমি এদের সাথে এসেছো, তুমিও নিশ্চই স্প্যানিয়দের হত্যা করেছ। তোমাকে ফাাঁসিতে লটকানো হবে। ছাত্রটা বললো– ‘আমি একজন ছাত্র। পর্তুগালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাচ্ছি’। ক্যাপ্টেইন তাকে বিশ্বাস করলো না। ক্যাপ্টেইন সেই ছাত্রের প্রমাণ চাইলো। ছাত্রটা কড়জোরে বললো, ‘আমার কাছে বই আছে।’ এবার ছেলেটা বইটা ক্যাপ্টেনের হাতে দিল। তিনি বললেন এটা কি তোমার পাঠ্যপুস্তক? তাহলে এই কবিতার বই থেকে তুমি কবিতা মুখস্ত বল। ছাত্রটা একটার পর একটা কবিতা মুখস্ত বলে যেতে লাগলো। ক্যাপ্টেন পাতার পর পাতা উল্টাতে লাগলো। কেপ্টেন খুব খুশি হলো এবং নিজের হাতে ফাঁসির দড়িটা খুলে দিল। মহা কবি ভার্জিলের কবিতার বইটা সেদিন ছাত্র কর্ডিরোর প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আমরা চাই বই হোক নিত্যসঙ্গী।

লেখক :প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট, বাংলাদেশে রেলওয়ে, হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্কের মূল্যবোধ
পরবর্তী নিবন্ধইটভাটা যেন স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দূষণের কারণ না হয়