ফড়িং চোখের দৃষ্টি

কাজী জাহাঙ্গীর | শুক্রবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

ছোট বেলা থেকেই ফড়িং এর পিছনে দৌড়েছে অনেক। বাড়ির বেড়াটা পেরিয়ে মজা পুকুরটার ঐ পাড়ে অনাবাদী পড়ে থাকা এক চিলতে জমিতে অবহেলায় গজিয়ে উঠা কাঁটা বেগুনের ঝোপ, ঝুনঝনি আর আলমিশ গাছের বাদাড়ে পরিণত হওয়া টিলাটারও একটা ভূমিকা হয়ে পড়েছিলো স্কুল পড়ুয়া শাহেদের কাছে । কারণ সেই ছোট্ট ঝোপাচ্ছাদিত স্থানটাই হয়েছিলা নানান রকম নাম না জানা আগাছা ভর্তি বৈচি ফুলে ভরা এখান থেকে ওখানে উড়ে বেড়ানো ঝাঁক ঝাঁক ফড়িং’দের অভয়ারণ্য। কখনো ফড়িং এর পিছনে দৌড়ানোয় কাঁটা বেগুনের কাটায় আহত হওয়া, কখনো ফুলের উপর বসা খানিকটা জিরিয়ে নিতে আসা ফড়িং ধরে ফেলতে পারার আনন্দ, আবার কখনো ফড়িং এর লেজে সুতা বেঁধে উড়তে ছেড়ে দিয়ে ওটার পিছন পিছন দৌড়ে ছোটা, যেমন করে নাটাই থেকে সুতা ছেড়ে দিয়ে আকাশে ভেসে থাকা ঘুড়িকে নিয়ন্ত্রণ উম্মাদনায় মেতে উঠার অদম্য শৈশব পাড়ি দেওয়া কিশোর আবার কখনো হাত ফসকে উড়ে যাওয়া ফড়িংটা ধরতে না পারার এক মুঠো হতাশায় হাতদুটোকে দুপাশ থেকে মাথার উপর রেখে আকাশের গায়ে উড়তে থাকা ফড়িংগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা, আহা কী আনন্দে যেন মাতোয়ারা হয়ে বাতাসে ভেসে থাকে ফড়িং গুলো।
ডানাগুলোর নাড়াচাড়া কিন্তু বোঝা যেত না, স্বচ্ছ পাখনাগুলো দুদিকে মেলে দিয়েই মনে হতো ফড়িংগুলো এক অজানা আনন্দে ভাসতে থাকতো বাতাসের স্রোতে। আরো মনে হতো উপর থেকে মুরগীর ছানা খোঁজা ঈগল চোখে ফড়িংগুলো পর্যবেক্ষণ করতো সেই হতচ্ছড়াটাকে কখন সে বিদেয় হবে সেই ফড়িং রাজ্যের সীমানা থেকে। তার পরেই যেন ফড়িং গুলো নেমে আসবে ফুলে ফুলে , পাতায় পাতায়। যেন একটু জিরিয়ে নিয়েই আবারো উড়ে গিয়ে সাতার কাটতে থাকবে বইতে থাকা উজান বাতাসে।
২.
শাহেদ এখন অনেক বড় ব্যবসায়ী। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা বাড়িটা দোতলা ভবন হয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রীর অনেক বড় আমদানিকারক সে। এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য যখন উর্ধ্বছুট হয়, সেই সময়গুলোতে শাহেদদের মত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক একাউন্ট গুলো একবার করে ফুলে ফেপে উঠে। এখন ফড়িং এর পিছনে ছুটতে যাওয়া সেই বাদাড়টা নাই। ছাদের কার্নিশ ছাড়িয়ে পাশের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া বীমের উপর ভেসে থাকা খোলা বেলকনিটায় দাঁড়িয়ে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা আর চাঁদনি এসব উপভোগের মানসে শাহেদ যখন ইচ্ছে দাড়িয়ে যেতে পারে এখন। কিশোরবেলায় সেই ঝোঁপে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে ফড়িং দেখার সেই ইচ্ছেটা এখনো মরেনি তার। তাই সময়ে সময়ে সেই খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগে শাহেদ। যদিও ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে তারা। কিন্তু সেই পুরনো আবেগগুলো তো আর সবসময় খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে চায় না। মাঝে মাঝে তাই ব্যবসায়ীক ঝক্কি ঝামেলায় মনটা যখন বিমর্ষ হয়ে পড়ে, সেই মুহূর্তগুলোকে উপেক্ষা করে ভাল থাকার মানসেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হাতদুটোকে দুপাশ থেকে মাথার উপর রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কখনো কখনো ফড়িং থাকেনা সে আকাশে, তার ব্যবসায়ী জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড়ের পূর্বাভাসের মত আকাশে ভেসে থাকা কালো কালো মেঘ পর্যবেক্ষণ করে সে। কখনো অপ্রত্যাশিত মুনাফায় ফুলে ফেঁপে উঠা একাউন্টটার কথা ভেবে আনন্দে আত্মহারা সুখ নিয়ে শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশে টুকরো টুকরো শুভ্র সাদা মেঘের বালিয়াড়ী দেখে আবেগে গদ গদ হতে থাকে শাহেদ।
তার মনে হতে থাকে হাত ফসকে উড়ে যাওয়া ফড়িংটার মত, এক কাাঁধি মুনাফা অর্জনের ভাবে সচ্ছলতায় টিকে থাকার সংগ্রামে ছুটতে থাকা মানুষগুলোর ভীড় থেকে সেও আরেকধাপ উপরে উঠে গেল। জীবন সংগ্রামে পোড় খাওয়া সেই মানুষগুলোর কাছে সেও হয়তো নাগালের বাইরে ডানা মেলে উড়তে থাকা একটা বৃহদাকারের বিলাসি ফড়িং এখন। কেননা বিভিন্ন গুদামে তার এখেেনা অনেক মালামাল বিক্রয় অপেক্ষায় আছে, কিন্তু করোনাকালের এই পরিস্থিতিতে মুরগী ছানাকে ছোঁ মারায় উদ্যত চিলের মত আরো মুনাফার ছাপ দেখতে পাচ্ছে সে। কিছুদিন আগে আমদানির একট বড় কনসাইনমেন্ট খালাস করেছিল শাহেদ, সবেমাত্র বিক্রি বাট্টা শুরু হয়েছে স্‌েই কনসাইনমেন্টের মালামাল থেকে, কিন্তু এরই মধ্যে পাল্টে গেছে বাজারের পরিস্থিতি। করোনাকালিন সময়ে ছোটবড় ব্যবসায়ীরাত আছেনই, এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যেও আপদকালিন সময়ে খাদ্যরশদ মুজুদ করার যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে, যার সুবাতাসে শাহেদের নাকে পুরোন ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানির মত ভেসে আসতে থাকে আরো আরো মুনাফার ঘ্রাণ।
৩.
আজ কি হয়েছে শাহেদের বুঝতে পারছেনা সে। গত কয়েকদিন ধরে তার সর্দি সর্দি ভাব লাগছিল, মাঝে মাঝে একটু জ্বর জ্বরও বোধ হচ্ছিল তার। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল রাতে শোয়ার সময় জ্বরটা মনে হয় একটু বেড়েছিল। তবে বিছানায় শুয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে যখন বালিশে মাথা রেখেছিল তখন বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল তার। প্রিয়তমা স্ত্রীটা যখন লেপের উপর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল তখন তার কী যে সুখানুভূতি হয়েছিল সেটা বর্ণনা করে বোঝাতে পারবে না শাহেদ। মাঝে মাঝে প্রিয়তমা স্ত্রীটার কোমল হাতের আলিঙ্গনের আকুলতায় জ্বরের ভান করতো সে, সেটা স্ত্রীর ভালবাসায় জড়ানো পরশ পাবার ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছু ছিল না তার। তবে কখনো স্ত্রীকে বুঝতে দেয়নি সে। স্ত্রী তার এধরনের আকুলতায় বেশ সদয় হয়ে যত্ন করেছে তার, তার চাওয়াতেই তাকে লেপে জড়িয়ে ধরে ভালবাসার পরশেই ক্লান্ত দেহটাকে ফুরফুরে করে দিয়েছে তার। কিন্তু আজ কী হল তার, চোখ খুলেও লেপ থেকে কেন জানি বেরিয়ে আসতে পারছেনা সে। তার স্ত্রী কি তাহলে এখনো তাকে জড়িয়ে ধরে আছে ? স্বামীর জ্বরগ্রস্ত শরীরটা দেখে স্ত্রীটা কি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে তাকে সারারাত এভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে? না, তা কী করে হয়। শাহেদ কেমন যেন হাস ফাঁস শুরু করেছে এই লেপমোড়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না সে। মনে হচ্ছে সূর্যের আলো জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে সকালের আলোয় পুরো ঘর আলোকিত করে ফেলেছে। লেপের ভেতর দিয়ে সেই আলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে, পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে সঠান হয়ে শুয়ে থাকার অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে সে।
এ অবস্থায় আর শুয়ে থাকা যায় না, তাকে অফিসে যেতে হবে। অনেক গুলো গ্রাহকের সাথে পণ্য সামগ্রীর ডেলিভারি দেওয়ার কথা আছে , সাথে সাথে মোটা অংকের অনেকগুলো টাকারও পেমেন্ট হবে আজ। এখন শুয়ে থাকার সময় না তার, কিন্তু বিধি বাম হলো নাকি, সেতো কিছুতেই নড়াচড়া করতে পারছেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ চোখ পড়ল তার দুপায়ের জোড়া করা বুড়ো আঙুলের দিকে। শরীরের মাঝ বরাবর একপ্রতিসমতার লাইন ধরে একটা করোনার চাকা গড়িয়ে গড়িয়ে উপরের দিকে উঠে আসছে। ঠিক যেরকম টেলিভিশন চ্যানেলে করোনা সতর্কতার অনুষ্ঠানে ছবি দেখেছিল সেরকম। একটা কদম ফুলের মত ‘গোলাকার বল’ সারা গায়ে অনেকগুলো কাঁটা জড়ানো। যখন সেটা গড়িয়ে উপরের দিকে উঠে আসছে সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে কাঁটাগুলো তার চামড়া ভেদ করে শরীরের মাংসে ঢুকে যাচ্ছে আর প্রচন্ড যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে করে গলা ফাটিয়ে প্রাণপণে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু কারো কোন সাড়া শব্দও পাচ্ছে না সে। কোথায় তার স্ত্রী, কোথায় তার দুই ছেলে, কোথায় তার আদরের কন্যাটা। তার চিৎকার কি কেউই শুনতে পাচ্ছে না? যন্ত্রণায় তার চোখ মুদে আসছে, শরীরটা কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে তার। হাত পা কিছুতেই নাড়াতে পারছে না আর। শুধুই চোখ গুলোই খোলা তার, আর যেন খোলা আছে অসহায় অনুভব। সে অনুভব করল তার দু’পায়ের বুড়ো আঙুল জোড়া কেউ যেন শক্ত করে বেঁেধ দিয়েছে। সাদা লেপের ভেতরে শক্ত হয়ে আসা পুরো নগ্ন শরীরটা সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু যন্ত্রণায় ছটফট করা আবেগে চোখগুলো বন্ধ হয়ে গেল একবার।
আবার হঠাৎ করেই যেন চোখগুলো খুলে গেল। আর অবাক হয়ে শাহেদ ডানে বাঁয়ে তাকাতে থাকলো শুধু। এত বড় বড় ফড়িং সে জীবনে দেখেনি, এত্ত বড় বড় ডানাওয়ালা ফড়িং? তাও আবার তার সাথে সাথেই উড়ছে ফড়িং গুলো এদিক ওদিক বাতাসের স্রোতে? ছোটবেলায় মরে যাওয়া ফড়িং এর পূঞ্জাক্ষি চোখ হাতে ধরে যেভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছিল, সেরকমই তার সাথে সাথে উড়তে থাকা ফড়িং গুলোও তাদের ইয়া বড় বড় পূঞ্জাক্ষিগুলো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেন তার দিকেই দেখছে। আর পাখনা ছাড়াই সেও কিভাবে যেন ফড়িংগুলোর সাথেই উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর মত শব্দে শব্দে। ব্যাপারটা বুঝে আসবার সাথে সাথেই নিচের দিকে তাকালো সে। কিশোর বেলায় সেই ঝোপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বা এই তো সেদিন ঝুলন্ত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যেভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফড়িং দেখেছে সে আর ফড়িং গুলোও যেভাবে আকাশের গায়ে বাতাসে ভেসে থেকে তার দিকে ঈগল চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকাতো তার দিকে, বুঝতে পারছে ঠিক সেরকমই সেও সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সেও ফড়িং চোখের দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু দেখছে উপর থেকে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েগুলো একে অপরকে জাড়াজড়ি করে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার দোতালা ভবনের দুয়ারে আর উঠোনে খাটিয়ায় পড়ে আছে সাদা কাফনে মোড়ানো একটা মরদেহ। কেউ কাছে আসছেনা তার, কেমন যেন সাদা পোশাক পরা কতগুলো লোক এগিয়ে আসছে লাশটার দিকে। হাঁ মনে পড়েছে, করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে লোকগুলো বিশেষ পোশাক পিপিই পড়ে আছে। লাশটাকে তারাই নিয়ে যাবে বোঝা যাচ্ছে, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কেউই লাশটার কাছে যাচ্ছে না। লোকগুলো লাশের খাটিয়াটাকে কাধে নিয়ে এগুতেই শাহেদ অনুভব করল ফড়িংগুলোকে পিছনে ফেলে অনেক দ্রুত গতিতে সে উঠে যাচ্ছে অনন্ত আকাশের দিকে ঝাপসা ধুয়ায় কুণ্ডলি পাকানো মেঘমণ্ডলির মাঝে…।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃত ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানুষের মনকে কোমল করে : সুজন
পরবর্তী নিবন্ধধোঁয়ার প্রাচীর