ফের পানিবাহিত রোগের প্রকোপ

হাসপাতালে দুইদিনে ১২৪ জন রোগী ভর্তি আক্রান্তদের ৩৫ শতাংশের শরীরে কলেরার জীবাণু

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৮ আগস্ট, ২০২২ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

২০১৮ সালের এপ্রিল-মে মাসে জন্ডিসের প্রকোপ দেখা দেয় নগরীর হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায়। মৃত্যু হয় ৩ জনের। বছর পেরুতেই (২০১৯ সালের জুলাই মাসে) পানিবাহিত ডায়রিয়া-কলেরা ছড়িয়ে পড়ে ঘরে-ঘরে। দুই বছরের ব্যবধানে গত মে মাসে (চলতি বছরের) পুনরায় পানিবাহিত ডায়রিয়া ও কলেরা রোগের কবলে পড়েন ওই এলাকার বাসিন্দারা। তবে ওই সময় হালিশহর ছাড়াও বন্দরসহ সমুদ্রবর্তী এলাকাগুলোতে পানিবাহিত এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
এবার তৃতীয় দফায় পানিবাহিত এই (ডায়রিয়া-কলেরা) রোগের কবলে পড়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। প্রি-পোর্ট, ইপিজেড, পতেঙ্গা-হালিশহর, উত্তর আগ্রাবাদসহ সমুদ্রবর্তী এলাকাগুলোতে এই রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। গত দুদিনে এসব এলাকার শতাধিক (১২৪ জন) রোগী ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকসিয়াস এন্ড ডিজিজেস) ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মাঝে সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ৬৯ জন এবং মঙ্গলবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত (শেষ ২৪ ঘণ্টায়) আরো ৫৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে এর মাঝে অনেকেই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে বিআইটিআইডি সূত্রে জানা গেছে।
৩৫ শতাংশের শরীরে কলেরার জীবাণু : ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হলেও আক্রান্তদের ৩৫ শতাংশের শরীরে মিলেছে ভিবরিও কলেরির (কলেরার) জীবাণুর উপস্থিতি। এ তথ্য নিশ্চিত করে বিআইটিআইডির ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড ইনফেকসিয়াস ডিজিসের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. মামুনুর রশীদ আজাদীকে বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম দিন ভর্তি হওয়া ২০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। ২০ জনের মাঝে ৭ জনের শরীরে ভিবরিও কলেরির (কলেরার) জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই জীবাণু সাধারণত লবণাক্ত পানিতে অবস্থান করে। ভিবরিও কলেরির জীবাণু যুক্ত ওই পানি যেকোনোভাবে এসব এলাকার মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। যা পানিবাহিত এ রোগে আক্রান্তের কারণ।
এটি (ভিবরিও কলেরা) সাধারণ ডায়রিয়ার তুলনায় একেবারে ভিন্ন জানিয়ে ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, এই জীবাণু আক্রান্তের ফলে আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে মলের পরিবর্তে একদম পানি বের হতে থাকে। এতে করে ওই রোগী দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন। এ ধরনের রোগীকে যথাযথ ফ্লুইড থেরাপি দিতে না পারলে ওই রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। যদিও চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে তেমন খারাপ কোনো রোগী নেই বলেও জানান এই চিকিৎসক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি সিভিল সার্জনের : এসব এলাকায় হঠাৎ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। মঙ্গলবার বিআইটিআইডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরিদর্শন করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার পরিচালক বরাবর তিনি এ চিঠি পাঠান। জেলা রিজার্ভ স্টোরে পর্যাপ্ত স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন সিভিল সার্জন। চিঠি পাঠানোর তথ্য নিশ্চিত করে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী গতকাল আজাদীকে বলেন, আমরা বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অবহিত করেছি। বিষয়টি পর্যবেক্ষণে অধিদপ্তর থেকে বুধবার (গতকাল) একটি টিম আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। অবশ্য ওই টিম কবে আসবে সে বিষয়ে আর কিছু জানানো হয়নি বলেও জানান সিভিল সার্জন।
এদিকে ডায়রিয়া আক্রান্ত ৫৬ জন রোগী বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তিনি বলেন, আগের দিন ডায়রিয়া আক্রান্ত মোট ৭২ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। তবে একদিনে কমে বর্তমানে ৫৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। আর শিশুদের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৪২টি শয্যার সবকয়টিতে (৪২ জন) রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল রেজাউল করিম আজাদ। শিশুদের ওয়ার্ডে একটি শয্যাও খালি নেই বলে জানান তিনি।
বিআইটিআইডি সূত্রে জানা গেছে, কলেরা সার্ভিলেন্স প্রোগ্রামের আওতায় কলেরা শনাক্তকরণের কলকিড টেস্ট কার্যক্রম চালু রয়েছে বিআইটিআইডিতে। এ প্রোগ্রামের আওতায় ২০১৪ সাল থেকে কলেরা শনাক্তকরণের টেস্ট (পরীক্ষা) হয়ে আসছে এ হাসপাতালে। টেস্ট কিট দিয়ে মাত্র আধ ঘণ্টায় এ পরীক্ষার ফল জানা যায় জানিয়ে ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন যেসব নতুন রোগী আসে, সম্মতিগ্রহণ সাপেক্ষে আমরা তাদের এই কলেরা টেস্ট করছি। চিকিৎসকরা বলছেন- ডায়রিয়া ও কলেরা মূলত পানিবাহিত (ব্যাকটেরিয়াজনিত) রোগ। পানির কারণেই এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ জীবাণুযুক্ত বা দূষিত পানি যে কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করার কারণেই এসব এলাকার বাসিন্দারা ডায়রিয়া-কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের অধিকাংশই (৯০ ভাগ) সমুদ্রবর্তী (প্রি-পোর্ট, ইপিজেড, পতেঙ্গা-হালিশহর, উত্তর আগ্রাবাদ) এলাকার বলে জানিয়ে বিআইটিআইডির ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকসিয়াস ডিজিসের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মামুনুর রশীদ বলছেন, দূষিত পানি হয়তো ফুটিয়ে পান করছেন। কিন্তু যে কোনোভাবে দূষিত ও জীবাণুযুক্ত পানি শরীরে প্রবেশ করছে। হয়তো গোসল করার সময়, মুখ ধোঁয়ার সময়, ওজু করার সময়, নয়তো থালা-বাসন ধোঁয়ার সময়, কিংবা রান্না-বান্না বা শাক-সবজি কাটার সময় দূষিত পানি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। মোটকথা, যেকোনোভাবে ওই দূষিত পানি মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে বা করছে। যার কারণে পানিবাহিত এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআদালতে বিয়ে, মিলেছে স্বীকৃতি
পরবর্তী নিবন্ধ৫ জেএমবি সদস্যের মৃত্যুদণ্ড