ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা

অনুবাদ : এমদাদ রহমান | শুক্রবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

বৃদ্ধ জরাজীর্ণ লোকদের সামনে আমি দাঁড়াতে পারতাম না। আমি তাদের ঘৃণা করছি বা ভয় পাচ্ছি, বিষয়টা আসলে তেমন কিছুই নয়। কারণ তারা আমাকে খুব দ্রুত অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিতেন। চুপসে দিতেন। আমি কখনই তাদের সঙ্গে কথা কইতে চাইতাম না। আসলে আমি জানতামই না বৃদ্ধদের সঙ্গে ঠিক কী নিয়ে আর কীভাবে কথা বলা সম্ভব! মোটকথা এই আমার এই কথাটাই বারবার মনে হতোজীবনের সমস্ত গুঢ়তা সম্পর্কে কেবলমাত্র বৃদ্ধরাই জানেন। তারা শুধু এরকমই চিন্তা করেন, যাকে বলে অভিজ্ঞতা। দীর্ঘজীবনে কত সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাদের! তারা এমন সব বিষয়আশয় নিয়ে কথা বলতেন, যা ছিল আমার ধারণাকল্পনা’রও বাইরের। বৃদ্ধরা কোথাও একত্রে জড়ো হলে আমার এমন এক অবস্থা হয় যে মনে হয় এখানে আমার পক্ষে একটিও শব্দ উচ্চারণ করার সামর্থ্য নাই। তাদের তির্যক ভ্রুকুটি, মুখের জটিল আয়ুরেখা, জল ছলছল ধূসর চোখ, তাদের কম্পিত ঠোঁট, তাদের পিতামহসুলভ হাস্য আমাকে আতঙ্কিত করে ফেলত। তাদের মহত্ত্বকে মনে হত সবকিছুকে যেন অতল অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই হল জরাগ্রস্থ লোকদের বিশিষ্টতাএকটা সুদৃঢ় বন্ধন যেন যৌবন আর অন্ধকাও আেচ্ছন্ন মৃত্যুর সঙ্গে!

মৃত্যু! ধীরে, সুচতুরভাবে মৃত্যু সবকিছুর ভিতর ঢুকে পড়ে। বিশ্রাম, শব্দহীনতা, মৌনতা, স্তব্ধতা, প্রশান্ত্তি এইসব হল মৃত্যুর প্রবেশদুয়ার। মৃত্যু চতুর্দিকে। সর্বত্র। মৃত্যু হলো মহান বিজেতা। আমাদের মৃত্যু শুরু হয় অবসরে, যখন পরিশ্রান্ত আমরা বিশ্রামে যাই, পরবর্তী কোনও একদিনে, কোনও অনুষ্ঠানে, খুব প্রশান্তভাবে কথা বলার ফাঁকে, লোকেদের জুতার দিকে তাকাও। দেখবে, পরিশ্রান্ত জুতাগুলি বিশ্রাম করছে; কী ভয়ানকভাবেই না তারা বিশ্রাম করছে। তুমি দেখতে পাবে বা তোমার মনে হবে জুতাগুলি নির্বাক, বিষণ্ন, অভিব্যক্তিহীন জিনিস ছাড়া আর কিছুই না। সমগ্র সত্তা তাদের অর্থহীন, নিষ্ফল এবং ইতোমধ্যেই তারা মরতে শুরু করেছে। জুতা আর পা তারা যখনই বিশ্রামে যায় তখন তাদের নিরাধারা মৃত্যু আমার মনকে ভয়ানকরকম পীড়িত করে ফেলে। আমি একজোড়া অবসরনিতেথাকাপা’র দিকে তাকাই দেখি যে পাজোড়া অবসরের সেই শোকাবহ বিয়োগান্তক পদ্ধতিটি আয়ত্ত করে ফেলেছে আর আমি তখন ভাবতে থাকি,- দশ, বিশ, চল্লিশ কিংবা তার চেয়ে আরও বেশি কিছু বছরএবং হঠাৎ একদিন তাদের পরম এবং অন্তিম বিশ্রাম, কিংবা; হয়ত কয়েকটি মিনিট, হয়ত মাত্র একটি ঘণ্টা। মৃত্যু ইতোমধ্যেই তাদের ভিতর ঢুকে পড়েছে। পায়ে জুতাসমেত আমি কখনই ঘুমাতে যাই না, বোধবুদ্ধিহীন লোকেরা দিনের বেলার ঘুমে যেমনটা করে থাকে। আমি পা’র দিকে তাকাই এবং মৃত্যুর অনুভূতিতে ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কারো কারো পা’র দিকেযেপা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বিশ্রাম করছেতাকালে, ছেলেবেলায় দেখা মরা মানুষের দেহের কথা মনে পড়ে যেত। মরা মানুষের পা’গুলি সবসময়ই এরকমপরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ আর বিশ্রাম করছে তাদের নতুন জুতার ভিতরমৃত্যুর কারণে, সবকিছুই মৃত্যুর কারণে।

যদি হঠাৎ একদিন, আমি একেবারে বন্ধুহীন হয়ে যাই, আমার বন্ধুদের হারিয়ে ফেলি, যদি আমি ঘৃণা বিদ্রুপ আর ঈর্ষা দ্বারা পরিবৃত্ত হয়ে যাই, তাহলে কোনভাবেই আমি আর কিছুতে জয়ী হতে পারব না। এমনকী আমি লড়াই করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলব। এটা খুবই সামান্য একটা বিষয় অথবা বলা যায়, আমার জন্য এটা আদৌ কোনও বিষয় নয়, বিষয়টি আসলে আমার বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কিত, যাদের আমি মাদ্রিদে ফেলে এসেছি এবং যাদেরকে আমি বুয়েন্স আইরেসে পেয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবেই জানি, যদি কখনও আমার কোনও কাজ নিয়ে হাসিঠাট্টা করা হয়, তাহলে আমার বন্ধুরা খুব দুঃখ পাবে। আমি আমার কোনও কাজের জন্য ভুক্তভোগী হতে চাই না, ভুক্তভোগী হতে চাই আমার বন্ধুদের কারণে। তারা অনেকটাই এরকম, যারা আমাদেরকে বিজয়ী হতে বাধ্য করে ফেলে। আর তাদের শক্তিতে আমিও বারবার জয়ী হতে চাই, কারণ আমি তাদেরকে জীবনে প্রবলভাবে কামনা করি, তাদের ভালবাসা আর বিশ্বাসকে আমি হারাতে চাই না, যা তারা আমাকে উপুর করে ঢেলে দিয়েছে। একটা কথা হল, আমি কখনোই তাদের নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগি না, যারা আমাকে ভালবাসে না কিংবা আদৌ যারা আমাকে চিনে না।

আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা কোনটি? হ্যাঁ, বলছি, এইতো গতকালই অভিজ্ঞতাটা পেলাম। এইতো এই বুয়েন্স আইরেসে, জনৈক নারী নাটকের মঞ্চে আসেন, আসেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। বিনম্র, দরিদ্র আর মহিমান্বিত চেহারার এই নারী বাস করেন স্প্যানিশবলা এখানকার এই লোকদের কোনও এক ঘরে। সংবাদপত্রমারফত তিনি এখানে আমার আগমন বিষয়ে জানতে পেরেছেন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না তিনি সত্যিই কী চান। সুতরাং তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমার সামনে বেশ কিছু কাগজ বের করলেন, আর খুব সাবধানে কিছু একটা মুড়িয়েরাখা জিনিস খুলতে লাগলেন। তিনি তাকিয়ে থাকলেন আমার চোখের দিকে আর মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার সরল মুখখানিতে, যেন তিনি এই হাসির মধ্য দিয়ে কোনোকিছু মনে করবার চেষ্টা করছেন। ‘ফেদেরিকোকে বুঝতে পেরেছিলফেদেরিকো…’ কথা বলতে বলতে তিনি তার হাতের কাগজপত্রের তোড়া থেকে বের করলেন পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া একখানি ফটোগ্রাফ ছোট্ট একটি শিশুর প্রতিকৃতি। এবং এই প্রতিকৃতিটাই হলো আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা!

তুমি তাকে চিনতে পারছ, ফেদেরিকো?’

না।’

এ হলে তুমি’, যখন এক বছরেরটি ছিলে।’

তোমার জন্মের সময় আমিও ছিলাম। আমি তোমাদের বাড়ির পাশেই থাকতাম। তোমার জন্মের সেই দিনটিতে, আমরা স্বামীস্ত্রী একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তোমার মা হঠাৎ অসুস্থ আমরা অবশ্য আর সেই অনুষ্ঠানে যাইনি। তোমার মায়ের পাশে ছিলাম এবং তুমি জন্ম নিলে! তোমার এক বছর বয়সে এই ছবিটি তোলা হয়। এই যে দেখো, ছবির শক্ত কাগজ ছিঁড়ে গেছে। কীভাবে? তোমার ছোট্ট হাতই কাজটা করেছে, যখন ছবিটি একেবারে নতুন ছিল। এটা তুমিই ছিঁড়েছছবির ছেঁড়া অংশটুকু হলো আমার কাছে এক বিস্ময়কর স্মৃতিচিহ্ন।’

এইসব কথাই নারীটি বলেলেন আর আমাকে স্থম্ভিত করে রেখে চলেও গেলেন! আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ছবিটিতে চুম্বন করে আর আমি এই সবকিছুই করতে চাইলাম শক্ত কাগজের ছেঁড়া অংশটির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে। এইতো আমার প্রথম কাজ। আমি জানতাম না কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ, কিন্তু এটা আমার করা প্রথম কাজ

এটা দেখেছো? (একটা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে),- তুমি কল্পনাও করতে পারবে নাএই যে বিপুল পরিমাণ মুদ্রিত অক্ষরে আমার নামটি লিখিত হয়েছে আর জনসমক্ষে এই যে প্রচার প্রদর্শন, এটা কী পরিমাণ লজ্জার। আমি অনুভব করি, আমার নিজেকে কেবল মনে হয়, আমি যেন উলঙ্গ হয়ে গেছি; কৌতূহলী জনতার ভীড়ের সামনে! আমি কোনভাবেই আমার নামের প্রদর্শনীর সামনে দাঁড়াতে পারি না লজ্জায়। থিয়েটার আসলে কী চায়, আমি তার কথাও ভুলে যেতে পারি না। তাই যেন দেখতে পাই, প্রথমবারের মতো, আমি দেখতে পেলাম আমার নাম ব্যবহৃত হচ্ছে, মাদ্রিদে। আমার বন্ধুরা উল্লাশ করছে, তারা ঘোষণা করছে এই কথা যে আমি খুব রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার পথে। কিন্তু এইটা আমার আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমার নাম নগরীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে, যাকে ঘিরে রয়েছে কিছু মানুষের নিঃস্পৃহতা আর কিছু মানুষের প্রচণ্ড ঔৎসুক্য। এই হলো আমার নাম এবং এইখানে তার যথেচ্ছ ব্যবহার; পুরো বিশ্ব যেনামটিকে আঠা দিয়ে সবখানে সেঁটে রেখেছে আর যেই মুহূর্তে নামটি অন্যদের অবশ্যই সুখি করছে, আনন্দিত করছে, আমাকে দিচ্ছে মর্মভেদী যন্ত্রণা। এটা যেন এমন, আমি যেন আমার নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলেছি; যেন দ্বিতীয় কেউ একজন আমার ভিতর থেকে উন্মোচিত হয়ে গেছে! এক শত্রু যেন, প্রাচীনপত্রগুলো থেকে আমারি দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর আমার ভীরুতা দেখে পরিহাস করছে। কিন্তু, হে বন্ধুগণ, আমি যে নিরুপায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিয়ন্ত্রণহীন কাভার্ডভ্যান খাবার টেবিলেই পিষে মারলো ৫ জনকে
পরবর্তী নিবন্ধরুমায় হত্যা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড