ফেইল করিনি, এবারও করব না

বাজেটের লক্ষ্য অর্জনে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী ।। মূল্যস্ফীতি শঙ্কার, তবে নিয়ন্ত্রেণের বাইরে নয় ।। নির্বাচন আর বাজেট, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা অচল ।। বাজেট আইএমএফের শর্ত মেনে নয়

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ৩ জুন, ২০২৩ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতিবিদদের চোখে এবারের বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন কঠিন ঠেকলেও ‘অতীতের ধারাবাহিকতায়’ সফলতা অর্জনে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, গত পাঁচ বছরের বাজেটে আমাদের প্রজেকশন কী ছিল, আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, তা অ্যানেক্স (সংযুক্তি) হিসাবে দিয়েছি। আমরা ফেইল করি নাই। ইনশাআল্লাহ এবারও ফেইল করব না, আগামীতেও আমরা ফেইল করব না। এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল বিকালে ছয়জন মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেখানে সংবাদকর্মীদের জিজ্ঞাসার জবাব দেন তিনি।

এদিকে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের কারণে ‘খুব খারাপ সময়ের’ মুখোমুখি হওয়ার কথা তুলে ধরলেও বছর শেষে তা প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে বলে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতিবিদদের মতো মূল্যস্ফীতি নিয়ে শঙ্কার কথা প্রকাশ করলেও অর্থনীতিকে চাপে রাখা এ সূচক নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন তিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনি যে তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখেছেন তার মধ্যে মূল্যস্ফীতিও একটি বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। এর পুরোটাই আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। খবর বিডিনিউজের।

মানুষের কর্মদক্ষতা ও দায়বদ্ধতার ওপর ভর করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, সবকিছুর মূলে হচ্ছে এ দেশের মানুষ, জনগোষ্ঠীতাদের কর্মদক্ষতা, দেশের প্রতি তাদের মায়া মমতা, মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা। এটা অসাধারণ এক উদাহরণ আমি মনে করি। এবং সেজন্য আমার বড় বিশ্বাস, আপনার মতো করে আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের পরাজয় নেই। ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবই হব।

৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে এবার রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন কামাল। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৬ শতাংশের বেশি। টাকার ওই অংক মোট বাজেটের ৫৬.৪৪ শতাংশের মতো।

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার যখন প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন এনবিআর রাজস্ব ছিল ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যদি ৫৯ হাজার কোটি টাকা থেকে এখন যদি তিন লক্ষ কোটি টাকাতে যায়, যেটুকুন বাড়তি বলছেন, এটা আমরা অর্জন করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আমাদের প্রজেকশন যেগুলো আছে, আমরা ফুলফিল করতে পারব।

নির্বাচন আর বাজেট, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা অচল : নির্বাচনী বছরে জনতুষ্টির প্রচেষ্টা বাজেটের মাধ্যমে চালানোর বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, নির্বাচন আর বাজেট পরস্পর সম্পর্কিত। বাজেট নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার জন্য উপকারী হতেই পারে। তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছি, আমাদের বাজেট হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য আর নির্বাচনও হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য।

সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনকে সামনের রেখে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা অচল মন্তব্য করে বলেন, দুটোকেই সচল রাখার জন্য বাজেটের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য যদি কোনো উপকার হয়, হবে। সেটা মানুষের জন্যই হবে এবং মানুষ এটার ভাগ পাবে। আমি মনে করি যে, এভাবে আমরা চলি।

একই প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সরকার সব বাজেটেই পববর্তী নির্বাচনের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এতে ‘অন্যায়’ কিছু নেই। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, এটা ১৫তম বাজেট। প্রত্যেকটা বাজেটে আমরা দিয়েছি আগামীর যে নির্বাচন হবে, ১৪এর নির্বাচন, ১৮এর নির্বাচন এবং ২৩এর নির্বাচনসব নির্বাচনেই একটি রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য থাকে, সেই নির্বাচনে আমরা জিততে চাই। নির্বাচনে জিততে হলে এদেশের জনগণকে, সাধারণ মানুষকে, গরিব দুঃখী মানুষকে কীভাবে আমরা তাদের যে চাহিদা, তাদের যে দুঃখদুর্দশা এটাকে কমিয়ে তাদেরকে একটি সুন্দর জীবনের দিক নির্দেশনা কীভাবে দিতে পারি। কাজেই ২৩ সালের নির্বাচন না, সকল নির্বাচনকেই আমরা লক্ষ্য রাখি।

তিনি বলেন, কাজে বাজেটে বরাদ্দ করি যে, যার মাধ্যমে আমরা সাধারণ মানুষকে, জনগণকে আমরা খুশী করতে পারি। সুতরাং আমরা যদি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাজেট দিই, এতে আমি মনে করি না যে কোনো অন্যায়। সবসময় আমরা মানুষের কল্যাণমূলক চিন্তা করেই বাজেট দিই।

কৃষিমন্ত্রী দাবি করেন, ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে তিন মেয়াদের সরকার আওয়ামী লীগ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার সবগুলো পূরণ করেছে। তার ধারাবাহিকতায় দেশের জিডিপি চার লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এখন ৪৪ লাখ কোটি টাকা হয়েছে।

বাজেট আইএমএফের শর্ত মেনে নয় : আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্ত বা পরামর্শের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী কামাল। আইএমএফের শর্ত মেনে বাজেট হয়েছে কিনাএই প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি তাদের শর্ত বা পরামর্শ মোতাবেক আমরা আমাদের বাজেট করি নাই।

আগের দিন ২০২৩২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে বক্তৃতায় আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে আছে এই সংস্কার। এরই মধ্যে সরকার আইএমএফের ঋণের একটি কিস্তি পেয়েছে। পরের কিস্তি পেতে বাজেট প্রণয়নের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী সংস্থাটির দেওয়া পরামর্শের ছাপ দেখা গিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আর্থিক খাতে সুশাসন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।

তবে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তাদের (আইএমএফ) যে পরামর্শ আছে সেটা আমরা পুরোপুরি দেখি না। তাদের সার্বিক পরামর্শ যা আছে, যা তারা বলে, সেখান থেকে যেটুকু গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি সেটুকু আমরা গ্রহণ করব, বাকিটা আমরা নিজেদের মতো করে নেব। সেখানে তাদের কোনো আপত্তি নাই।

আইএমএফের সঙ্গে কাজ করাকে ভালো হিসেবেই দেখছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, কেবল আইএমএফ না, সবাই দেখে ব্যালেন্স শিট ঠিক আছে কিনা, রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট ঠিক আছে কিনা, ট্রায়াল ব্যালান্স ঠিক আছে কিনা, আয়ব্যয়ের পার্থক্য ঠিক আছে কিনা। শুধু আমাদেরটা না, সবারটাই দেখে, আর এই দেখাটা ভালো। আইএমএফের সঙ্গে যারা কাজ করে, আমি মনে করি এটা ভালো দিক এজন্য যে, তারা শুধু অর্থ দিয়ে মানে লোন দিয়ে সাহায্য করে না, পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের পরামর্শ দেয়। সেগুলো কীভাবে কম সময়ে বাস্তবায়ন করা যাবে, এগুলোও তারা পরমার্শ দেয়। তাই আমি মনে করি, এসব থেকে শেখার অনেক কিছু থাকে এবং আমরা সমৃদ্ধ হই।

অন্য এক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন পৃথিবীতে সবাই সবার সঙ্গে সম্পর্কিত, একই রেখায় যুক্ত। কেউ আলাদাভাবে বসবাস করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি আমদানি করলেও কাউকে না কাউকে লাগবে, রপ্তানি করলেও লাগবে। আর এখন ইউক্রেনরাশিয়া যুদ্ধ হচ্ছে, অন্য দেশ থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে কোন দেশ থেকে পণ্য পাওয়া যাবে, কোথায় থেকে আমরা তা পেতে পারি। আমাদের সাধ বা সাধ্য এখন এককভাবে পরিচালন করা সম্ভব না, মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দিলে আমরা তা ফ্লেঙিবলভাবে সমাধানের চেষ্টা করি।

আসছে অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে ছয়জন মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী। নিজের ডান পাশে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানকে বসিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

নিজের বাম পাশে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এবং পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকারকে রেখে সংবাদ সম্মেলন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী।

এদিকে সরকারের ঋণ মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, মূল্যস্ফীতির যে উচ্চ হার তা মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণে নয়। ডলার বেচতে গিয়ে দুই লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে এসেছে। আমাদের রিজার্ভ মানি জিডিপির তুলনায় এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। সরকার ঋণ নিলে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে তা আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির কারণে। আমরা যদি সরবরাহ দিকটি ঠিক রাখতে পারি তাহলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

তিনি বলেন, এখন খুব খারাপ সময়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা ভালো আছি। এবারও যেসব প্রজেকশন আমাদের আছে, সবই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে আশা করি।

বৈশ্বিক বাস্তবতা আর নানামুখী চাপের মধ্যে দাঁড়িয়েও ‘স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে’ যাত্রার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদের সামনে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজেট গরিববান্ধব গণমুখী, সমালোচনা গৎবাঁধা : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ মামলার আসামি গ্রেপ্তার