ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

৭ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার। ইসরায়েলে উৎসব চলছিলো মহা ধুমধামে। খুব ভোরে সেই উৎসবের মধ্যেই হঠাৎ আক্রমণ করে বসে হামাস। এদিন হামাসের অতর্কিত ও আকস্মিক হামলায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইসরায়েল। যাদের এত দিন মানবেতর ভাবা হয়েছিলো, তারা এমন সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালাবে তা ছিলো কল্পনার বাইরে। সেনাছাউনির পাশাপাশি ইহুদি বসতির উপরেও আক্রমণ হয় নিহত হন বেসামরিক নাগরিক, নারী ও শিশু। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ইসরায়েল শুরু করে পাল্টা হামলা। তিন লাখের বেশি সৈন্য গাজা সীমান্তে মোতায়েনের আয়োজন চলছে, শুরু হয়েছে অহর্নিশ বোমাবর্ষণ, পাখির মতো মরছে মানুষ। নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে তিনি এমন শিক্ষা দেবেন যাতে তারা অনন্তকাল ভয়ে কাঁপে।

কিন্তু হামাস কেন এমন সাড়াশি আক্রমণ চালালো? এর রয়েছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে আছে আঞ্চলিক রাজনীতির পরিবর্তন। ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নয়ন। যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের পাশ কাটিয়ে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে কূটনীতি শুরু করেছে, তা হামাসের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। এদিকে সৌদি আরব ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না এবং ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির আওতায় পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন যে ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’, তা আর বাস্তবায়ন হবে না। অন্যদিকে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও হামাসের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বছরের বেশি সময় ধরে সংকটে আছেন। তাঁর প্রতি জনসমর্থন কমছিল এবং তিনি বিভিন্ন আইনি সমস্যার মোকাবিলা করছিলেন। নিজেকে রক্ষায় তিনি ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরও উগ্রপন্থী নীতি গ্রহণ করছিলেন, এতে তিনি উগ্রবাদি দলের সমর্থন পেয়েছেন। হামাস বুঝে গেছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ইসরায়েলের ক্ষমতায় যাঁরা আসবেন, তাঁরা আরও বেশি যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠবেন। একসময় ইসরায়েল ভুখণ্ডটি ছিলো ফিলিস্তিনের অংশ। জোর করে সেই রাষ্ট্রের বৃহৎ অংশে বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা পৃথিবীর আর কোনও অঞ্চলে হয় নি। আসলে ইসরায়েল ফিলিস্তিন বিরোধ শুরু ১৯১৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ফিলিস্তিনেই প্রতিষ্ঠা করা হবে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র। সে সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি ছিলো মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬%। তখন একটি নিজস্ব বাসভূমির জন্য ইহুদি জনগোষ্ঠী আন্দোলন করে আসছিল। যেকোনো স্থান, এমনকি আফ্রিকার কোথাও হলেও তাদের আপত্তি ছিলো না।

বেলফোর ঘোষণা তাদের হাতে যেন চাঁদ এনে দিল। শুরু হলো পূর্ব ইউরোপ থেকে ইসরায়েলে ইহুদি অভিবাসন। তখন জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা খাইম ওয়াইজম্যান পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছিলেন। তিনি বেলফোর ঘোষণার পর বলেছিলেন ফিলিস্তিনের মাটিতে একবার পা ফেলতে পারলেই হলো,বাকিটা তাঁরা দেখে নেবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার শুরু করেছিলেন ইহুদি নিধনের ‘ফাইনাল সলিউশন’। লক্ষ্য হয় হত্যা, নয় বহিষ্কার। যেভাবেই হোক জার্মানিকে ইহুদিমুক্ত করা। এই ফাইনাল সলিউশনের ফলে ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়, যে ঘটনা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। এরপর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন ভাগ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। এক ভাগ দেওয়া হয় নতুন রাষ্ট্র ইসরায়েলকে, অন্য ভাগ ফিলিস্তিনকে। ছয় লাখ ইহুদি যাদের অধিকাংশই পূর্ব ইউরোপ থেকে সদ্য আসা, তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয় মোট ভূমির ৫৩%। আর ১৫ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য ৪৭%, যার একটা বড় অংশ তপ্ত মরুভূমি এবং কৃষি কাজের অযোগ্য পাথুরে মাটি। এতে প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে রাতারাতি তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিম তীর ও গাজায় এসে আশ্রয় নিতে হয়। কেউ কেউ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী কোনো আরব দেশে। এ ঘটনা ফিলিস্তিনিদের চোখে ‘নাকবা’ বা মহা বিপর্যয় নামে পরিচিত। তবে ফিলিস্তিনসহ এ অঞ্চলের কোনো আরব দেশ ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা মেনে নেয়নি, প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৪৮ সালে শুরু হয় প্রথম আরবইসরায়েল যুদ্ধ। এরপর ১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের আরব ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি করা হয়। ১৯৮৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা হামাস গঠন করা হয়। কিন্তু এরিমধ্যে ইসরায়েল ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে ফিলিস্তিনি ভুখণ্ড দখল করতে থাকে। আর এতে ইন্দন যোগায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ পশ্চিমা বিশ্ব। বর্তমানে ইসরায়েলের ভূখণ্ড ২১,০০০ বর্গ কিঃমিটার আর ফিলিস্তিনের মাত্র ৬,০০০ বর্গ কিঃমিটার।

পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম মিলে ‘প্যালেস্টাইন স্টেট’ বা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো চুক্তির ভিত্তিতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে নবগঠিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আংশিক প্রশাসনিক দায়িত্ব পায়। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকরের নিয়ন্ত্রণ রয়ে যায় ইসরায়েলের হাতে। এখান থেকে ঢোকা বা বের হওয়া সবকিছু ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।

লাখ বিশেক মানুষের বাস গাজায়,প্রায় সবাই উদ্বাস্তু।পুরো এলাকাটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গাজার যেকোনো এলাকা থেকে তাকালেই দেখা যায় এই দেয়াল। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। চার দিকে রয়েছে কড়া ইলেকট্রনিক নজর দারির ব্যবস্থা, ফলে কারো পক্ষে এই দেয়াল টপকে ইসরায়েলে ঢোকা সম্ভব নয়। মিসরের সঙ্গে কয়েক মাইলের সীমান্ত যোগাযোগ আছে, রাফায় একটি চৌকি দিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু মিসরীয়দের নির্দেশে তা অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে।

গাজা প্রস্থে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত মাইল, দৈর্ঘ্যে ২৫ মাইল, সব মিলিয়ে ১৪১ বর্গমাইল। যে ২০২২ লাখ মানুষের বাস গাজায়, তার অধিকাংশই ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কারোরই নিজের বাড়ি নেই। শহরের উত্তরে ও দক্ষিণে মোট আটটি উদ্বাস্তু শিবিরে গাদাগাদি করে অসংখ্য উদ্বাস্তু ঠাঁই পেয়েছে, কয়েক প্রজন্ম ধরেই তারা মুরগির খোপের মতো এক বা দুই ঘরের বাসায় দিন কাটায়। অধিকাংশ মানুষই বেকার, জাতিসংঘের কাছ থেকে ত্রাণ ও উদ্বাস্তু ভাতা পেয়ে দিন গুজরান করে। বলার মতো কোনো মিল ফ্যাক্টরি নেই, কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। যে সামান্য কিছু লোক কাজকর্মের সুযোগ পান, তাঁদের অধিকাংশই হয় ছোট ব্যবসা, নয়তো জাতিসংঘের কোনো না কোনো দপ্তরে কাজ করেন।

তবে ইসরায়েলের হামলায় গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ, সেখানে শোনা যাচ্ছে কেবল মানুষের ক্রন্দন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে। গাজায় কোনো আধুনিক হাসপাতাল নেই। ক্যানসার বা জটিল কোনো ব্যাধির নিরাময়ের জন্য ইসরায়েলে আসা ছাড়া তাদের অন্য পথ নেই। এটা ঠিক মানবজীবন নয়, মানবেতর জীবন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, তারা মানবপশু। আসলে যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিরা মরেই আছে তাই মৃত্যুতে তাদের ভয় নেই।

এভাবে ফিলিস্তিনইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত চলছে প্রায় ৭৫ বছর ধরে। সেই সংঘাতে গাজা আবারও রক্তাক্ত এক বিরান প্রান্তর। মানুষ ঘরহারা, সন্তানের মৃত দেহ পিতার কাঁধে, চোখে অশ্রু, তবু বুকে তাঁরা জিইয়ে রেখেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন।

তবে সময় এসেছে মুসলিম বিশ্ব এক হয়ে ফিলিস্তিনের সাহায্যে এগিয়ে আসার। মুসলমানদের প্রথম কেবলা ও ফজিলতপূর্ণ আল আকসা মসজিদ আজ ইহুদিদের কব্জায়। এটি রক্ষা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব। এই বিষয়ে ওআইসি সহ মুসলিম বিশ্বের দেশ ও সংগঠনগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ আজ মুসলিম সমাজের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মনে রাখতে হবে তেলসমৃদ্ধ মুসলিম বিশ্ব যদি এক হয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ায় তবে ইসরায়েল একদিনও টিকতে পারবে না। না হলে আল আকস মসজিদ বা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়ন হবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : প্রসঙ্গ ড. এ আর মল্লিক
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল