অল্প বয়সে ভারতে এসেছিলেন কানাডা থেকে মিশনারি হয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশে। খ্রিস্টের বাণী প্রচারের পাশাপাশি সিনেমার শহর কলকাতায় এসে হয়ে উঠেছিলেন চলচ্চিত্রেরও পুরোহিত। ফাদার রেভারেন্ড গাস্তঁ রোবের্জ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে পরিণত হয়েছিলেন ফাদার গাস্তঁ রোবের্জে। সকলের প্রিয় ফাদার। চলচ্চিত্র বিদ্যার এক প্রধানতম শিক্ষক। প্রাচ্য ও প্রতীচীর চলচ্চিত্র যাঁর সূক্ষ্ম বীক্ষণে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। চলচ্চিত্র অবলোকন, অনুধাবন ও বিশ্লেষণের এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি উপমহাদেশের চলচ্চিত্র অনুরাগীদের চলচ্চিত্র সমালোচনারও একটি নতুন ধারার উদ্ভাবন করেছিলেন সমাজ বাস্তবতার নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে।
চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর ছিল আশৈশবের আগ্রহ। কোলকাতায় যখন তিনি আসেন তখন সেখানে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল এই তিন যুগন্ধরের সরব রাজত্ব চলছে। এই দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে বহু ভাষায় বিভিন্ন রকমের ছবি তৈরি হয়। এই বৈচিত্র্য তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বাংলা শেখেন। লিখতে না পারলেও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতেন তাঁরও প্রিয় এই ভাষাটি। বলতেনও চমৎকার। এই শহরের গুণী চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্রকর্মীদের সান্নিধ্যে আসতে থাকেন ক্রমশ। কিংবা উল্টো করেও বলা যায়, তাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে আসতে থাকেন। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য গাস্তঁ বোবের্জকে চলচ্চিত্রবীক্ষার এক বিশদ সুযোগ তৈরি করে দেয়। ক্রমশ তিনি পরিণত হন সত্যজিতের বিশেষ সুহৃদে। সত্যজিতের চলচ্চিত্র ফাদারের অনুধাবন, সমঝদারি ও বিশ্লেষণের গুণে ভিন্ন ব্যঞ্জনাধর্মী মাত্রা পায়। এর নেপথ্যে উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ, অনুরাগ চর্চা ও পর্যবেক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করেছে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ফাদারের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকার ছিলেন লুই বুনুয়েল। চট্টগ্রামে তিনি ১৯৯০ সালে ১১ মে একদিনের একটি ওয়ার্কশপ করাতে এসেছিলেন চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের আমন্ত্রণে। সেবারই তাঁর প্রথম বাংলাদেশে আসা বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের আমন্ত্রণে। ঢাকায় বেশ কয়েক দিনের কর্মব্যস্ততার এক ফাঁকে দুইদিনের সফরে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। কর্মশালার বিষয় ছিল, ‘হাউ টু সি এ ফিল্ম’। সত্যি কথা বলতে গেলে সেই একদিনের কর্মশালায় সিনেমা দেখার চোখটি তিনি খুলে দিয়েছিলেন আমাদের। সেদিনের কর্মশালায় তিনি মূলত সত্যজিৎ ও বুনুয়েলের ফিল্ম ক্লিপিংসের উপর জোর দিয়েছিলেন । এক পর্যায়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি একজন যাজক হয়ে বুনুয়েলের মতো একজন নাস্তিককে কেন পছন্দ করেন। তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমাদের দুজনের কারবার ধর্ম নিয়ে’, একজন পক্ষে অন্যজন বিপক্ষে।’ এর পরপরই তিনি বলেন, বুুনুয়েলে মানবতাবোধ তাঁকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া চলচ্চিত্রের ব্যকরণ, প্রয়োগ ও চমৎকারিত্ব শিখতে হলে লুই বুনুয়েলের কাছে যেতে হবে।
তিনি চট্টগ্রামের নৈসর্গিক পারিপার্শ্বিকতা দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন। এরপরেও কলকাতায় যখন দেখা হয়েছে এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছেন। এতে তাঁর চরিত্রের পারিপার্শ্বিক পর্যবেক্ষণের দিকটি প্রকাশ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমরা আমাদের এই শহরের সেই নিসর্গকে নিজ হাতে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছি।
তাঁর সেবারের বাংলাদেশ সফরকালে ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ ছবিটি রমরমা অবস্থা চলছিল দেশ জুড়ে। খবরটি তিনি কোলকাতাতেই পেয়েছিলেন। ঢাকায় এসে ছবিটি দেখতে চাইলে তাঁর জন্যে এফডিসিতে একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবি দেখার পর তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এর সমাজতান্ত্রিক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন ছবিটিকে নিয়ে। পুরো বিষয়টি দুই বাংলায় যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছিল। এরকম তাঁর আরেকটি প্রবন্ধ রয়েছে ‘শোলে’ নিয়ে। চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব তিনি বিচার করতেন সমাজতত্ত্বের আলোকে। বলতেন, একটি চলচ্চিত্রকে বুঝতে হলে তার সমাজ সংস্কৃতিকেও বুঝতে হবে।
কারিগরি ও নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ তার লেখাগুলি দীর্ঘাকার হতো না। সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখার প্রশংসা করতেন। ১৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে কমিউনিকেশন সিনেমা ডেভেলপমেন্ট গ্রন্থটির জন্য ১৯৯৮ সালে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রের একজন নির্ভরশীল শিক্ষক ছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ম্যাস কমিউনিকেশন এন্ড ফিল্ম স্টাডিজ পড়াতেন। আধুনিক প্রচার মাধ্যমের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়েও তার সুচিন্তিত ভাবনা ছিল যা সাইবার বাণী গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালে তিনি প্রভু যিশু গির্জায় চিত্রবাণী নামের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানটি গঠন করেন। এটি চলচ্চিত্র শিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কেন্দ্র। তাঁর এই চলচ্চিত্র চর্চার কারণে তাঁকে হাই প্রিণ্ট অফ সিনেমা বলা হতো।
গাস্তঁ রোবের্জের জন্ম ২৭ মে ১৯৩৫ কানাডার মন্ট্রিয়লে। ১৯৫৬ সালে তিনি মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্রুপদী সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক হন। একই বছর তিনি সোসাইটি অফ জেসাসে যোগ দেন। চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগের কারণে ১৯৬১ সালে স্বেচ্ছায় শিশু সংঘের কলকাতা শাখায় বদলি হয়ে আসেন। খ্রিস্টধর্মের মিশনারি হয়ে এসে রূপান্তরিত হন চালচ্চিত্রের মিশনারিতে। ১৯৭০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিয়েটার আর্টসে (ফিল্ম) স্নাতকোত্তর হন। ১৯৭৩ সালে আইজেনস্টাইনের আইভান দ্য টেরিবর গবেষণার জন্য বৃত্তি নিয়ে মস্কো যান এবং তা সমাপ্ত করেন। এই চলচ্চিত্র পণ্ডিতের জীবনাবসান হলো ২০২০ এর ২৬ আগস্ট কোলকাতায়। চলচ্চিত্র সংস্কৃতির এই পুরোধা পুরুষ বিশ্বাস করতেন। সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্র থাকে তিনি এনাদার সিনেমা বলেছেন তা দিয়ে এনাদার সোসাইটি অর্থাৎ সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব।