প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা হয়ে গেল বাংলাদেশী!

দুদকের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য।। জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন, পাসপোর্ট করে কেউ কেউ গিয়েছেন বিদেশেও

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গা হয়ে গেছেন বাংলাদেশের নাগরিক। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতায় পেয়েছেন জাতীয় পরিচয়পত্র, হয়েছেন ভোটার। তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে পাড়ি দিয়েছেন বিদেশেও। গত দুই বছর ধরে দুদকের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুধীমহল বলছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে যারাই সহযোগিতা দিয়েছেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা।
জানা যায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সরকারি হিসাবে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১১ লাখের বেশি। কঙবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিজেদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন- এমন অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গত পাঁচ দশকে এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পেয়েছেন। কঙবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছেন প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কেও জড়িয়েছেন। বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছেন প্রায় ৩০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজারের বেশি অবৈধ ভোটার বানানো হয়েছে। এ অবৈধ ভোটারদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় একশ জনকে আসামি করে ২০টির মতো মামলা করেছে দুদক। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা সনদপত্র ও জন্মনিবন্ধন দিয়েছেন। নির্বাচনের কমিশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ইসির সার্ভার ব্যবহার করে অবৈধভাবে এ রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বিদেশে যেতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি। এসবে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করছে দুদক।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরী বাদেও দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি উপজেলায় অবস্থান রয়েছে রোহিঙ্গাদের। পাশাপাশি পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ী উপজেলাগুলো বাদেও কঙবাজার জেলায় প্রায় সব উপজেলায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশীদের সহযোগিতায় ভোটার হয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় পরিচয়পত্রও। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশী ভোটার হওয়ার পর স্থানীয়ভাবে জায়গা-জমিও কিনেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘যারা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভিনদেশী রোহিঙ্গাদের দেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত রয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ শখ করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী নাগরিক করেননি। জাতীয় পরিচয়পত্র দেননি। দুয়েকজন হয়তো ভুলে দিয়েছেন, কিন্তু বেশিরভাগই অবৈধভাবে লাভবান হয়ে দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া এবং পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের ধীরে ধীরে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী হয়ে যাওয়ার এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। সংস্কৃতির জন্য হুমকি। সরকারি দলের লোক, আমলা, জনপ্রতিনিধি বলে যদি কাউকে ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের জাতিসত্ত্বা মারাত্মক হুমকিতে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
অনুসন্ধান টিমের সদস্য দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রামে দায়িত্বপালনকালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কঙবাজার, দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবানের সব কটি উপজেলাতেই রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যাদের অনেকে বাংলাদেশী নাগরিক হয়ে গেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর অনেক ওয়ার্ডেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক করা হয়েছে। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তারা এ রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহযোগিতা দিয়েছেন। প্রায় এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হয়েছে। এসব অপরাধে ইতোমধ্যে দুদকে প্রায় ২০টির মতো মামলা হয়েছে। যেসব মামলায় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামি করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে কমপক্ষে ২০-২২ কাউন্সিলর রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়েছেন।’
দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি মামলা হয়েছে। যেসব মামলায় রোহিঙ্গাদের ভোটার করা, পাসপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), জেলা নির্বাচন অফিস, উপজেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সাধারণ লোকজনও রয়েছেন। ভুয়া পাসপোর্ট পাওয়ার বিষয়টি দুদক খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। তিনি বলেন, এসব অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। অপরাধী যারাই হোক না কেন, তাদেরকে দুদক আইনে বিচারের মুখোমুখী করা হবে বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোড়ে, বাজারে জটলা গলিতে আড্ডা
পরবর্তী নিবন্ধভোজ্যতেলের বাজার ফের বাড়ছে