প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি

কাপাসগোলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ‘যৌন হয়রানি’ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ, তিন পর্যবেক্ষণ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ ওঠা কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক এমপিওভুক্ত স্থায়ী কর্মচারী হওয়ায় এ সুপারিশ করা হয়। তদন্ত কমিটি তিনটি পর্যবেক্ষণও দেয়।

 

এতে অভিযুক্ত শিক্ষকের ‘চরিত্রগত সমস্যা’ রয়েছে এবং বিশেষ কোনো ছাত্রীকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দেয়া হয় বলে মন্তব্য করা হয়। তাছাড়া ওই শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারের চ্যাট করার বিষয়টি স্বীকার করে কমিটির কাছে।

জানা গেছে, গত ১ জানুয়ারি ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ এনে মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে প্রায় ৩ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। একইদিন তাকে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করে চসিক।

পরদিন ২ জানুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া উত্থাপিত ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ তদন্তে চসিকের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার। গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা ও শিক্ষা কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা। গত সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

এ বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার কল দিলেও মোবাইল ফোন রিসিভ করেন নি প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার। গতকাল সন্ধ্যায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্ট আমার হাতে আসেনি। পেলে সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ শামসুল তাবরীজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছি। অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণিত না হলেও সার্বিক পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে সত্য মনে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।

তিনি বলেন, তদন্তকালে কোনো ভিকটিম পাইনি, যে বলবে অবিচার হয়েছে। সংক্ষুবদ্ধ ব্যক্তি এবং চাক্ষুস স্বাক্ষী পাইনি। যে ভিডিও’র কথা বলা হচ্ছে সেটাও এডিটিং করা, সেখানে শুধু অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের অংশ ছিল। তবে সামগ্রিকভাবে মনে হয়েছে, মেয়েদের সঙ্গে ফোনে ও ম্যাসেঞ্জারে ওনার হয়তো কথা বলার প্রবণতা রয়েছে। যা ওনার অযোগ্যতা।

সৈয়দ শামসুল তাবরীজ আজাদীকে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছে মেয়েদের ফোন করা ও ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করার বিষয়ে জানতে চাই। উত্তরে তিনি তার আইডি হ্যাক হয়েছে বলে জানায়। তবে এ বিষয়ে তিনি কোনো জিডি করেন নি বলেও জানান। তবে শেষ পর্যায়ে তিনি ছাত্রীদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করার বিষয়টি মৌখিকভাবে স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

তিন পর্যবেক্ষণ : তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তদন্ত কমিটি। প্রথম পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের পুরোপুরি স্বাক্ষ্য প্রমাণাদি না থাকলেও তার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। ম্যাসেঞ্জার এ চ্যাট করার বিষয়ে তার স্বীকারোক্তি তা প্রমাণ করে। এছাড়াও ছাত্রীদের সাথে তার আচরণ যে শিক্ষকসুলভ নয় তা ছাত্রীদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।

দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তদন্তকালীন সময়ে সরাসরি কোন ভিকটিম এর স্বাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ছাত্রী বা অভিভাবক বা সহকর্মী শিক্ষিকাবৃন্দ কেউ শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা অথবা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমনকি মেয়র বরাবর কোনো যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেননি। তবে বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রীদের সাথে জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত শিক্ষকের চরিত্রগত সমস্যা আছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

তৃতীয় পর্যবেক্ষণ হচ্ছেবিদ্যালয়ের বিশেষ কোন ছাত্রীকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে অন্য ছাত্রীদের উপর বিরুপ মনোভাব পোষণ এবং সেই সাথে বিদ্যালয়ে এ বিশেষ ছাত্রীর জন্মদিন উদ্‌যাপন করা প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেশাদারিত্বের পরিচয় বহন করে না।

অন্যান্য : তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা দুই দফা স্কুলে পরিদর্শন করেন। তারা শিক্ষকশিক্ষিকা, ছাত্রী এবং অফিস সহায়কদের সাথে কথা বলেন। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য নেন। সবার সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি জানতে পারেন, ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী জনৈক এক ছাত্রীর সাথে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের সখ্যতা গড়ে উঠে।

সেই ছাত্রী প্রধান শিক্ষকের সাথে সখ্যতার জের ধরে যখন তখন হেড স্যার ডেকেছেন বলে বের হয়ে যেতো। তাছাড়া শ্রেণি শিক্ষকের উপর অসদাচরণ করার মনোভাব পোষণ করত। এছাড়া কোনো ছাত্রীকে একা পেয়ে ফোন নম্বার চাইতেন এবং পরবর্তীতে মেসেজ বা ফোন করতেন বলেও তদন্ত কমিটির কাছে জানায় তারা।

শিক্ষিকগণ জানিয়েছেন, তিনি (আলাউদ্দিন) যৌন হয়রানি বা কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করতেন না। তবে প্রধান শিক্ষকের চাহনি তাদের কাছে অস্বস্তিকর ছিল। এছাড়া আলাউদ্দিন শিক্ষকদের সাথে উগ্র মেজাজ দেখাতেন এবং খারাপ আচরণ করতেন। শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের সাথে কারো মতানৈক্য দেখা দিলে তিনি (প্রধান শিক্ষক) সবাইকে পতেঙ্গা বদলি করে দিবেন মর্মে হুমকি দিতেন।

এক এস এস সি পরীক্ষার্থী তদন্ত কমিটিকে জানায়, তার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, বয়ফ্রেন্ড গিফট দেয় কিনা, গিফট দেওয়া ভালো এই ধরনের আলাপ করতেন। এছাড়া প্রধান শিক্ষক প্রায়ই ছাত্রীদের টিসি দিয়ে বের করে দেয়া, রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিবেন বলে ভয় দেখাতেন।

গত ১ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করা প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির ব্যাখ্যা হচ্ছেশিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ যে আন্দোলন করে তা সমসাময়িক কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। বরং তা পূর্বের বিভিন্ন অভিযোগ এবং বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একই সময়ের মধ্যে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিাতি ও আন্দোলন সৃষ্টি করায় মনে হয়, আন্দোলনকারীগণ পরিকল্পিতভাবেই একইদিন উপস্থিত হন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে হলুদ দল ৭, স্বতন্ত্র ৪
পরবর্তী নিবন্ধ১৬ কলেজে শতভাগ পাস, শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান নেই