প্রসঙ্গ পারাপার

আহমেদ রাসেল | শুক্রবার , ২৫ মার্চ, ২০২২ at ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ

শহীদুল জহিরের ‘পারাপার’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে ‘মুক্তধারা’ থেকে। যদিও এটি প্রকাশকের কাছে জমা দিয়েছিলেন ৫ বছর আগে ১৯৮০ সালে। এই গ্রন্থটি খুব সামান্য কয়েকটি কারণে আমাদের কাছে আলোচ্য। যেমন এটিই একমাত্র গ্রন্থ যেখানে তিনি পারিবারিক নাম শহীদুল হক ব্যবহার করেন। আর এ-গ্রন্থ প্রকাশের খবর আপন ছোট ভাই হাবিবুল হক পর্যন্ত জানতেন না, তিনি রাজশাহীতে চাকরিসূত্রে বেড়াতে গিয়ে দোকানে বইটি দেখে পৃষ্ঠা উলটিয়ে নিশ্চিত হন এটি তাঁর ভাইয়ের লেখা। তাঁর ভাইয়ের জবানিতে আমরা আরও জানতে পারি, পরবর্তীতে তাঁর মাকে উৎসর্গ করার গ্রন্থের খবরও মা জানতেন না। এতটা আত্মপ্রচারবিমুখ কেন ছিলেন তিনি ? তার ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকলেও এটা অনুমান করা যায় যেখানে ৫ বছর পড়ে থাকার পর গ্রন্থ ছাপা হয় এমনকী পরবর্তী গ্রন্থ প্রকাশে কোন প্রকাশক পর্যন্ত জোগাড় করতে না পারা ইত্যাদি কারণে কিছুটা হতাশাও ছিল। এছাড়া পারাপার গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করতে তিনি নিজেও রাজি ছিলেন না। লেখক আহমাদ মাযহারকে তিনি পারাপার গ্রন্থটিকে তাঁর সৃষ্টিকর্ম হিসেবে গণ্য না করতে বলেন কেননা ওতে নাকি লেখকের স্বাতন্ত্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য করা যাবে না। কিন্তু আহমদ মাযহার-ই আমাদের জানান-
‘পারাপার এর লেখকের মধ্যে আশাবাদিতা ছিল প্রধান অনুষঙ্গ। মার্কসীয় জীবন দৃষ্টিরও প্রভাব ছিল প্রবল। ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে খানিকটা সরাসরি সংযুক্ততা ছিল। তা ছাড়া তখনও বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদী জীবনব্যবস্থার প্রতি একটা রোমান্টিক মনোভাব ছিল তরুণদের মধ্যে। শহীদুল জহিরেরও আগ্রহ এবং সমর্থন ছিল এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে। পারাপার এর গল্পগুলোর ক্ষেত্রে এই প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যাবে না।’
(শহীদুল জহিরের গ্রন্থ-আলোচনা পারাপার-এর শহীদুল জহির; পৃষ্ঠাঃ ৪২১, শহীদুল জহির স্মারক গ্রন্থ, পাঠক সমাবেশ ২০১০)
এবার আলোচনায় আসা যাক-
প্রথম গল্পগ্রন্থের নামগল্প পারাপার। গল্পটির বিষয়বস্তু যা-ই থাক তার উল্লেখযোগ্য দিক লেখকের বর্ণনাভঙ্গি। বর্ণনা এমনভাবে এগোয় কখনো কখনো মনে হতে পারে এটি গল্পের সীমানা পেরিয়ে উপন্যাসের দিকে মোড় নিচ্ছে। কিন্তু গল্পকার থামিয়ে দিচ্ছেন আমাদের পঠন স্রোতকে।
কাহিনিটি কোন অঞ্চল বা মহল্লার প্রতিনিধিত্ব করে না। এটি একটি চলমান ভ্রমণকালীন কাহিনী; তবে ভ্রমণকাহিনী নয় কোনভাবেই। গল্পের শুরু ট্রেনের ভেতর, কাহিনী এগোয় ফেরিতে; সমাপ্তি হয় ঘাটের কাছে স্থলভূমিতে। গল্পের নায়ক ওলি। উত্তরবঙ্গের পাবনা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছে রেলওয়েতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরে আসার সময় ট্রেন, ফেরি আর ফেরিঘাটে সংগঠিত একটি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে ওলি। ঘটনাটি খুব সামান্য; ফেরিতে সে যে সিটে বসে তার পাশে মোটা দুটো বেডিং ছিল অন্যজনের। যার বেডিং সে দোতলা নিচতলায় ঘোরাঘুরি করছিল এক ফাঁকে এসে ওলিকে সেগুলো দেখে রাখতে বলে। ইতোমধ্যে ছোট দুজন ছেলে; ভাসমান কুলি এসে ওলির কাছে আবদার করে মালগুলো অর্থাৎ বেডিং দুটো ওরা ফেরি থেকে ঘাটে তুলে দিবে। ওলির নিজের জিনিস নয় ওগুলো তবুও সে মজা করার জন্য ওদের সঙ্গে দামাদামি করে মুটে বয়ে নেবার। ঘটনাক্রমে বেডিং-এর মালিক এলে ওলি তাদের হয়ে বলে যে, বেডিংগুলো যেন ভাসমান ছোট কুলি আবুল ও বশিরকে দেয়। শেষ পর্যন্ত কম টাকায় ছেলেগুলো রাজি হয় কিন্তু একটি বেডিং নিতে গিয়ে পানিতে ফেলে দেয় আবুল। আর তা নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘাটে। কারণ বেডিং-এর মালিক লোকটি সরকারি কর্মকর্তা। এ-নিয়ে ওলি এসে আবারও নাক গলাতে চাইলে লোকটি তাকে দালাল বলে গালি দেয় এবং এক পর্যায়ে যখন ওলি ছেলেটির জন্য সুপারিশ করে ছেড়ে দিতে তখন উল্টো ওলিকে অপমান করে লোকটি শার্ট চেপে গালে চড় লাগায়। চরম অপমানবোধে ওলি তিনজন ঘাট পুলিশ দেখা সত্ত্বেও পাল্টা লোকটির থুতনিতে ঘুসি বসিয়ে দেয়। এ-সুযোগে কুলি আবুল পালিয়ে যায়। ঘটনা এখানেই শেষ।
এ গল্পের মর্মে গেঁথে আছে শিক্ষিত এক বেকার ছেলের আত্মমর্যাদাবোধ। লেখক সে-চরিত্রটি আঁকতে পেরেছেন সফলভাবে। আর গল্পের নায়কের বেকারত্বের মধ্যেও মানবতাবোধ ও সংবেদনশীলতার মিশ্রণ আছে সেটাও চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। বেকারত্বের অসহায়ত্বের ভেতর মানবতাবোধ টের পাই যখন তাকে দেখি ছোট্ট পথশিশু দুটির জন্য মমতা দেখায়। ছেলে দুটোকে তার আপন মনে হয় হয়তো তার আর ছেলে দুটোর আদতে অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল নয় বলে। ছেলে দুটো যখন বলে আপনের চাকরি হইব ছার।’ এতে ওলির ভাল লাগে; অচেনা ছেলে দুটিকে তার পরম শুভাকাঙ্ক্ষী মনে হয়। তাই সে শেষ পর্যন্ত এ-খেটে খাওয়া শিশুশ্রমিক দুটোর পাশেই ছিল। বলতে গেলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার হাতে লাঞ্ছিত হয় এ-মমতাবোধের জন্যই। আবার চাকরি-প্রত্যাশী এই যুবক খুব আবেগভরে বলেই ফেলে রেলের টিকেট চেকারের চাকরিটা পেলে আর যদি এই জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে তার পোস্টিং হয় তাহলে আবুল ও বশিরকে সে বৈধ কুলিদের সাথে নাম লেখাবে। এই আপাত স্বপ্নবান যুবকটির ভেতর তখন চাকরি পাবার আকাঙ্ক্ষায় হৃদয় কোমল যার প্রকাশিত রূপ মানবতাবোধ। দরিদ্র এ-ছেলেদুটোর প্রতি সহমর্মিতার চরম নিদর্শন পাই যখন নিরুপায় এই বেকার যুবক আবুলকে চেকারের বেডিং ফেলে দেয়ার অপরাধে আটকহাত থেকে রক্ষার জন্য নিজে সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে সুপারিশ করে আর ফলশ্রুতিতে লাঞ্ছিত পর্যন্ত হয়। আমরা এমন এক ব্যক্তিত্ববান যুবকের জন্য সহৃদয় না হয়ে পারি না। তাই লেখকও শেষ পর্যন্ত তাকেই নায়ক বানিয়ে দিলেন।
এবার আসছি গল্পটির বর্ণনাভঙ্গির কিছু নিদর্শন তুলে ধরতে। প্রথমত গল্পটির পটভূমিতে আছে ট্রেন ও ফেরি ভ্রমণের কথা। ট্রেন ও ফেরি ব্যস্ততার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক আমাদের শোনাচ্ছেন সুন্দর কিছু দৃশ্যের কথা। যেগুলোতে ট্রেন ও ফেরির বাস্তব কিছু চিত্র ভেসে উঠে। যেমন ঘুমন্ত যাত্রীদের বর্ণনা দিচ্ছেন-
‘ওর মনে হয়েছিল, দৃশ্যটা যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্রের মতো। নারী পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু জড়াজড়ি করে কাত হয়ে আছে।’
(শহীদুল জহির, ‘পারাপার’, শহীদুল জহির নির্বাচিত গল্প, সমাবেশ ২০০৭ , পৃষ্ঠা ২২)
আবার যাত্রীদের ঘুম ভাঙতেই সকলের অস্থিরতার চিত্র দেখাচ্ছেন-
টয়লেটের দরজা ঘন ঘন বন্ধ হচ্ছিল আর খুলছিল। মহিলারা আব্রু সচেতন হয়ে নড়েচড়ে বসছিল, কেউ কেউ তাদের জিনিসপত্র একত্রিত করছিল টেনেটুনে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়তে শুরু করেছিল এদিক-সেদিক থেকে। দরজার কাছে চটের বস্তা আঁকড়ে ধরে এক বৃদ্ধা তখনো কুঁজো হয়ে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ ওলির নাক পা ঝুলিয়ে দিয়ে একজন লোক ঝপাৎ করে ঝাঙ্ক থেকে নেমে পড়ল। তারপর গলা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে থুথু ফেলে বলল, ঘাট আইসা গেছে।
(প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ২২)
ঠিক তেমনি চলমান ফেরি-স্টিমার যখন ঘাটের কাছে ভিড়ল যাত্রীদের ভেতর নেমে পড়ার ব্যস্ততা বোঝাতে লেখক শোনাচ্ছেন-
স্টিমার ভেঁপু বাজিয়ে সতর্ক করল। যাত্রীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। ঘাট নিকটবর্তী হচ্ছিল ক্রমে। স্টিমার ঘাটের ফ্লাটের সঙ্গে ভেড়ার আগেই লোকজন সিঁড়ি লাগানোর জায়গায় এসে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়াল। স্টিমার আস্তে আস্তে ফ্ল্যাটের গা ঘেঁষে এল। দরাম দরাম করে লাল জামা পরা কুলির। লাফিয়ে পড়ল স্টিমারের ভেতর। আর হল্লা তুঙ্গে উঠল।
পাটাতন- সিঁড়ি নামিয়ে দিতেই থেমে থাকা জমাট জনতা গলে গেল।
(প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ২৯)
অন্যদিকে লেখক ওলির মনোজগৎ বর্ণনায় বলছেন-
* ওলি বসে বসে এক দুর্বোধ্য অপমানের ক্ষত চাটে
(প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ২৯)
* চকিতে, বোধ আর বোধহীনতাকে তুচ্ছ করে, একটি অনুজ্ঞা রক্তের ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের মতো দ্রুত শরীরের সর্বত্র, আঙুলের ডগায়, চোখের তারায়, হাতের পেশিতে সঞ্চারিত হয়ে গেল। আঙুলের ডগা গুটিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল, চোখের তারায় দুপুরের রোদ খেলে গেল, হাতের পেশি চিতার মতো তৈরি হয়ে গেল। ওলির ডান হাতের মুঠটা লোকটার চোয়াল স্পর্শ করল।
(প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৩২)
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিগুলো তরুণ শহীদুলের কথাসাহিত্যের ভিত্তি নির্মাণে যে-পরিবর্তন হচ্ছিল তারই চিহ্ন ধারণ করে।
আমরা একেবারে শেষ আলোচনায় আসব কেন গল্পটির নাম পারাপার? এর একটা সাদামাটা ব্যাখ্যা দেব। গল্পটির বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে স্টিমার পারাপারের চিত্র। আর পারাপারকারী স্টিমারে ঘটে যায় ব্যক্তি ওলি ও ছেলে দুটোর পরিচয়। সে সঙ্গে মমত্ববোধ তৈরি হয়। একসময় স্টিমার অপর পারে চলে যায়। সবার পারাপার সম্পন্ন করে। শুধু আটকে থাকে আবুল একজন চেকারের উত্তমমধ্যম খেয়ে। সে দুর্যোগ থেকে পার করতে ঘটে যায় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি। ওলি তার সর্বস্ব অপমান সহ্য করে আত্মসম্মান রোধের জাগরণ ঘটিয়ে অবশেষে ছোট্ট আবুলকে চেকারের হাত থেকে রক্ষা করে। আবুলেরও পারাপার সম্পন্ন হয়। তেমনি প্রকাশিত হয় ওলির নায়কোচিত আচরণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতার খালিদ আহসান
পরবর্তী নিবন্ধসাদার্ন ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সমাবর্তন ২৭ মার্চ