কবিতার খালিদ আহসান

আবসার হাবীব | শুক্রবার , ২৫ মার্চ, ২০২২ at ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ

কবি-শিল্পী খালিদ আহসানের মৃত্যুসংবাদে তার সহযোদ্ধা কবি-শিল্পী-নাট্যকর্মী সকলের মধ্যে স্বজনহারা নীরবতা নেমে এসেছিল। তাঁর মৃত্যুতে যে শোক-স্তব্ধতা নেমে এসেছিলো, তা এখনও কাটেনি। তা আমরা কিছুটা অনুভব করতে পারি এই বছর তাঁর মৃত্যু দিবসে ফেইসবুকে লেখালেখি দেখে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পত্র-পত্রিকাগুলোতে সেভাবে লেখালেখি হয়নি।
খালিদ আহসান কবিতা সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে লিখেছিলেন, ‘কবিতা আমাকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, বাঁচিয়ে রাখে।’ খালিদ আহসান কবিতা এবং প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে।
‘কবি শিল্পী খালিদ আহসান আছে, খালিদ আহসান নেই’ এই শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম ২২ মার্চ ২০২১-এ বন্ধু কবি-শিল্পী খালিদ আহসানের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরপর। এটা কি আমার অন্তরাত্মার শংকা কিংবা ভয়! দেখলাম খালিদ আহসান সত্যিই নেই হয়ে গেল। এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। কবি-শিল্পী খালিদ আহসানকে মূল্যায়ন করবে। তার কবিতা ও শিল্পের সুষমা আমাদের কাছে তুলে ধরবে। কবি-শিল্পী খালিদ আহসানের সৃষ্টিসত্য আমাদের এক আলোর মিছিলে নিয়ে যাবে। কবি-শিল্পী খালিদ আহসান পাঠকের সত্তার ভেতর বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন। আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ একদিন নতুন এক খালিদ আহসানকে আবিষ্কার করবেন।
খালিদের সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক দেশবাংলা পত্রিকায় শিক্ষানবিস সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরুর সময়কাল থেকে, সেই বন্ধুত্ব এখন স্মৃতিতে সততসত্য হয়ে আছে। কবি খালিদ আহসান আমাদের সাথে চলাফেরায়, আড্ডায় নিত্যসঙ্গী ছিল। কখনো অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়ে, কখনো এস্টাব্লিসমেন্টবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন ‘স্পার্ক জেনারেশন’-এর আড্ডায়, কখনো সম্পাদক প্রকাশনীর কাজে চেম্বার প্রেসে, কখনো সাধুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে, কখনো চিম্বুক রেস্তোরাঁয়।
খালিদ আহসান তার কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঁঝিঁর কনসার্ট’ বই আমাকে দেয়ার সময় ভেতরের পাতায় লিখলো ‘আবসারকে খালিদ’। এই সহজ সম্পর্কের কনসার্ট এখনো বেজে চলেছে আমার ভেতর, ‘ঝিঁঝিঁর কনসার্ট’ এই কাব্যগ্রন্থের ‘যারা নিতে এসেছে’ কবিতাটি পাঠ করে।
‘শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে
সেই রক্তের ভেতর নাচছে ঘোড়াগুলো
লোরকাকে যারা নিতে এসেছিল
সেই সব ঘোড়াগুলো
ফ্ল্যাট বাড়ির কিচেনের জানালা দিয়ে
লাফিয়ে নামছে- অইতো বারান্দা পেরুচ্ছে
কোলাপসিবল ঠেসে রেখেছে
সামনের পা দিয়ে
আমাকে না নিয়ে ওরা যাবে না কোথাও’
কবি খালিদ আহসান মৃত্যুকে কবিতার ভেতর নিজের মৃত্যুকে দেখার দিব্যদৃষ্টি আমি বিস্মিতভাবে অবলোকন করলাম। কবি নিজের মৃত্যুকে ‘লোরকাকে যারা নিতে এসেছিল’ সেই ধরনের এক হন্তারকের কথা খালিদের কবিতায় উঠে আসে। কবি খালিদ আহসানকে করোনা নামক সেইসব হন্তারক ঘোড়াগুলো সাদা পোশাকে জগৎ সংসার থেকে নিঃসীম এক অন্ধকারের দিকে নিয়ে চলে গেল। কবি খালিদ আহসান কখনো করোনা নামক ক্ষমাহীন এই হন্তারকের নাম শোনেনি। কখনো কখনো অবচেতন মনে কবির কল্পনায় এক হন্তারক মৃত্যুদূত কিচেনের জানালায় দিয়ে, বারান্দা দিয়ে, কলাপসিবল গেটে ঠেসে রেখে বারবার উঁকি দিয়েছে- ‘আমাকে না নিয়ে ওরা যাবে না কোথাও’।
অনন্তলোকের যাত্রায় সবাইকে শূন্যতায় রেখে শিল্পের কবিতার অনন্য রূপকার কবি শিল্পী খালিদ আহসান আমাদের জন্য রেখে গেল শিল্পের সুষমামণ্ডিত ক্যানভাস ও কবিতা। সেই ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কবিতা পাঠ করতে করতে বারবার আমরা কবি শিল্পী খালিদকে আবিষ্কার করবো নতুনভাবে এক অনাবিষ্কৃত ভুবনে। যেখানে খালিদ আহসান নিজস্ব আবিষ্কৃত এক সত্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের জানান দেবে- ‘আমি আছি, আমি থাকবো শিল্পের সুন্দর পৃথিবীতে’।
কবি খালিদ আহসান ‘এনেসথেসিয়া’র ব্যাক ফ্ল্যাপে লেখায় কবির চিন্তা-চেতনার সুস্পষ্ট উচ্চারণ শিল্পের সুন্দর পৃথিবীতে মানব মুক্তির কথাও বলেছেন।
‘জড়তার অভিশাপ মুক্ত হয়ে
সামাজিক জাগরণ আসুক।
মানুষ-মুক্তমানুষ ভালোবাসুক
পৃথিবীটাকে-জল হাওয়াকে-
তবেই রোধ হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সামগ্রিক ভাঙন।’
খালিদ আহসানের কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঁঝিঁর কনসার্ট’-এর ‘স্পর্শ কর’ কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্‌তি আমাদের বারবার ভাবিয়ে তুলবে, আমরা যারা কাব্যচর্চা করি, বিশেষ করে তাদের। কবি খালিদ আহসান মানব মুক্তির কথা বললেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছে ‘শব্দের সুষমায় ভরা প্রিয় কবিতা’র কাছেই।
আহ-আলজিভ স্পর্শ কর, নগ্ন কর, চুম্বন কর তাকে,
শব্দের সুষমায় ভরা প্রিয় কবিতাকে,
আহ-আলজিভ স্পর্শ করে, নগ্ন কর, চুম্বন কর তাকে,
প্রেমান্ধ যাতনায় ক্লান্ত বধির বেদনাকে।
ঐতো রাজহাঁস, নীলকণ্ঠ পাখি, মেঘমালা, মিছিল-
মানুষের ক্ষুধার ও কান্নার,
তাকে স্পর্শ কর, উন্মোচন কর জাগাও নিজেকে
যেভাবে তারুণ্য কুমারী গ্রন্থি জটিল গিঁট।
স্পর্ধায় ছিন্ন কর, জীর্ণ বৈভব, ধ্বংস কর
ধ্বংসস্তূপ নিংড়ে নিংড়ে আগামী বসতি-
আহ-আলজিভ স্পর্শ কর, নগ্ন কর, চুম্বন কর তাকে,
শব্দের সুষমায় ভরা প্রিয় কবিতাকে।’
কবি খালিদ আহসান এই ‘স্পর্শ কর’ কবিতাটি এক অনন্য ভঙ্গিতে, আবেগ দিয়ে বিভিন্ন কবিতা পাঠের আসরে পাঠ করতো। কখনো কখনো এই কবিতাটি পাঠের জন্য বিশেষ অনুরোধও থাকতো।
যেখানে খালিদ আহসানের ভিন্নমাত্রার শিল্পসৃষ্টিতে, কবিতার শব্দের ব্যঞ্জনাকে দেখবো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমরা বাস্তবতাকে দেখি নিজের মতো করে, খালিদও তার মতো করে দেখেছে, তবে সে দেখার দৃষ্টিতে অপ্রিয় সত্য প্রকাশ পেয়েছে। সবাইকে যেতে হবে। তাই, কবি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেছে, ‘আমাকে না নিয়ে ওরা যাবে না কোথাও’
কবি-শিল্পী খালিদ আহসানকে ওরা নিয়ে গেল, আমরা শুধু যাওয়াটুকু দেখলাম। স্মৃতি সতত সত্য হয়ে সবসময় প্রিয়জনের হৃদয়ে বাজবে। কখনো কখনো আলো ছড়াবে। কখনো-কখনো বেদনার্ত করবে।
‘তোমাকে, পানকৌড়িকে’ খালিদ আহসানের তৃতীয় কবিতার বই, বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখায় কবি-শিল্পী খালিদ আহসানের জীবনের একটি পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি।
‘জল আর তরঙ্গে ছেয়ে আছে নিখিল পৃথিবী। সংবেদনের ঢিল তরঙ্গের কোষ অনুকোষে ছড়ায়। মহাপৃথিবীর গান শুনবে বলে উন্মুখ পথিক। মধ্যরাতে করমর্দন সমুখের কৃষ্ণচূড়ার ডালে, পাতায়। তারপরেই না শান্ত ঘুম।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধইউরোপে যে ৫ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাইডেনকে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ পারাপার