প্রশ্নের মুখে শিক্ষাবোর্ডের ভাবমূর্তি

ফলাফলে অনিয়ম-অসঙ্গতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলব

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। ওই দিন দুপুরে ফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর প্রদর্শনে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে বোর্ডের ভাবমূর্তিও। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। ফল প্রকাশের পরদিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) থানায় জিডির পাশাপাশি এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। সর্বশেষ এ ঘটনায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা শিক্ষাবোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীমের স্বাক্ষরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। পত্র প্রাপ্তির তিন কর্ম দিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে।
উল্লেখ্য, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা শাখার। আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ শাখার প্রধান। এইচএসসির ফলাফলে নানা অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার কারণে শিক্ষাবোর্ড যে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সেটি এই পরীক্ষা শাখার কারণেই।
শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফলাফলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টির পরও বিষয়টি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত করা হয়নি। বিভিন্ন অভিভাবক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রশ্নের মুখে বিষয়টি জানতে পারেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। অথচ এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বিষয়টি আগে জানানোর নিয়ম
থাকলেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সেটি করেন নি।
এর আগেও ২০২০ সালের অটোপাশের জেএসসিতে বড় ধরণের অনিয়মের খবর প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদীতে। ফল প্রকাশের ৯ মাস পর নতুন করে রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বর জেনারেট করে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে জেএসসি পাসের তালিকায় যুক্ত করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষা শাখা ও বিদ্যালয় শাখার সরাসরি সম্পৃক্ততায় ওই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। আর এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দেয়। সন্তান পরীক্ষার্থী এমন ১০/১২ জন শিক্ষককে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের (পরিশোধন) দায়িত্ব দেয় শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শাখা। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে এসব প্রশ্ন বাতিল করে নতুন করে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরিশোধনের দায়িত্ব দেয়ার আগে কোনো শিক্ষকের সন্তান পরীক্ষার্থী কী না, সেটি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব পরীক্ষা শাখার। কিন্তু দায়িত্ব প্রদানের আগে যাচাই-বাছাই না করেই ওই সব শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া জেএসসি পাস না করেই প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন ও এসএসসির ফরম পূরণের ঘটনাও ঘটেছে এই সময়ে। বোর্ডের বিদ্যালয় ও পরীক্ষা শাখার সম্পৃক্ততা ছাড়া এ ধরণের জালিয়াতি সম্ভব নয় বলে মনে করেন শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টরা। সবমিলিয়ে সামপ্রতিক সময়ে পরীক্ষা পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে বোর্ডের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষও। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে প্রদত্ত চিঠিতেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ফলাফলে অসঙ্গতির কারণে বোর্ডের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে এ চিঠি প্রাপ্তির ৩ কর্মদিবসের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে নিজের বক্তব্য (ব্যাখ্যা) প্রদানের জন্য বলা হয়েছে চিঠিতে।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে থাকা বোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীম এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। যদিও এ ঘটনায় থানায় জিডি ও তদন্ত কমিটি গঠনের কথা স্বীকার করে বিষয়টি তদন্তনাধীন বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, এবার (২০২১ সালে) তিনটি বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। গ্রুপ ভিত্তিক যে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছে, এর প্রতিটিতে দুটি করে পত্র রয়েছে। প্রতি পত্রে একশ করে দুটি পত্র মিলে একটি বিষয়ে মোট নম্বর (মার্কস) ২০০। অর্থাৎ একটি বিষয়ে ২০০ নম্বরের মধ্য থেকেই শিক্ষার্থীদের নম্বর দেয়া হয়। কিন্তু মোট নম্বর ২০০ হলেও দুই পত্র মিলে একটি বিষয়ে দুইশ’র বেশি নম্বরও পেয়েছে একাধিক শিক্ষার্থী। এক বিষয়ে ২১৮ নম্বর পাওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর নম্বর ফর্দ আজাদীর হাতে এসেছে। এছাড়া দুপুরে ফল প্রকাশের পরপর ওয়েবসাইটে পাওয়া নম্বর ফর্দে প্রাপ্ত নম্বর সন্ধ্যা গড়াতেই পাল্টে গেছে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের ক্ষেত্রে এই নম্বর পাল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো নম্বর ফর্দে আবার প্রাপ্ত নম্বর ‘এ’ প্লাসের হলেও গ্রেড উল্লেখ করা হয়েছে ‘এ’ মাইনাস। এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শিক্ষাবোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বহু অভিভাবক এ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘মোট নম্বর ২০০, পেল ২১৮! দুপুরে প্রাপ্ত নম্বর পাল্টে গেল সন্ধ্যায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই দিনই (১৪ ফেব্রুয়ারি) এ বিষয়ে থানায় জিডির পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুধ ছাড়াই ঘি তৈরি
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার