প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৬ জুন, ২০২১ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

সুলতান ২য় আবদুল হামিদের ভয়ে নবী পাক (স.) নিয়ে ফ্রান্সের অবমাননাকর নাটক মঞ্চস্থ বাতিল
তুর্কি সুলতান ২য় আবদুল হামিদ ১৮ শতকে ইস্তাম্বুলে শাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ফ্রান্সে নবী পাক (স.)’র নামে অবমাননাকর একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুলতানের কড়া হুমকিতে ফ্রান্স তটস্থ হয়ে এ সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করে। বিষয়টি ১৮ শতকের শেষের দিকে।
১৮ শতকে এসে সুলতান আবদুল হামিদের আমলে বিশাল তুর্কি সাম্রাজ্যে নানান প্রতিকূল অবস্থা শুরু হতে থাকে। এককালে যেখানে তুর্কিরা ইউরোপের অর্ধেক শাসন করে গেছে, সেখানে ১৮ শতকের দিকে এসে পর্যায়ক্রমে নানা যুদ্ধ বিগ্রহসহ প্রতিকূল অবস্থা চলছিল। এমনি অবস্থায় ফরাসি কুখ্যাত কবি নাট্যকার মারকইস হেনরি ডি বোর্নিয়ার নবী পাক (স.)’র নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন, যা নবী মুহাম্মদ (স.) এবং ইসলাম সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য বহন করে। ১৮৮৮ সালে এই নাটকটি প্যারিসে মঞ্চস্থ হবে এমন একটি সংবাদ ফরাসি সংবাদপত্রে পড়ার পরে সুলতান ২য় আবদুল হামিদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্যারিসে সুলতানের রাষ্ট্রদূত মাহমুদ এরশাদ পাশা ফরাসি সরকারের সাথে সাক্ষাত করে প্রতিবাদ জানান। ২ বছরের ব্যবধানে ১৮৯০ সালে মার্চে নাটকটি পুনঃলিখনের চেষ্টা করে। এতে কূটনৈতিক সংকট শুরু হয়। ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছিল, এখানে নাটকটিতে ইসলাম ও নবী পাক (স.)’র অবমাননাকর খারাপ কিছু নাই। সাথে সাথে এও আশ্বাস দেন নাটকটি তাদের উপনিবেশ আলজেরিয়া ও তিওনেশিয়ায় মঞ্চস্থ হবে না।
এরই মধ্যে সুলতান ২য় আবদুল হামিদ ব্যক্তিগতভাবে ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভে অলিভিয়ার ল্যানস ডি মন্টিবেলোরকে প্রাসাদে ডেকে পাঠান। এ বিষয়ে সুলতানের পক্ষ থেকে কঠিন পদক্ষেপ নেয় হবে বলে হুংকার দেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান রাষ্ট্রদূত ফরাসি প্রধানমন্ত্রী চার্লস ডি ফ্রেইসনেটকে সতর্ক করে দেন। ফলে ফরাসি সরকার নাটকটি মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করে সারা ফ্রান্সে।
ফ্রান্সের নিষেধাজ্ঞার কারণে লন্ডনের লিসিয়াম থিয়েটারের সাথে ব্রিটেনে তার নাটক মঞ্চায়িত করতে সম্মত হন। সেই সময় রাণী ভিক্টোরিয়ার পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন রবার্ট গ্যাসকোয়েন সিসিল। ঐ সময় তুর্কি সুলতানের পক্ষে রাষ্ট্রদূত লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিষয়টি অবহিত করেন। এতে ব্রিটিশ সরকার নাটকটি নিষিদ্ধ করেন।
এটিই তাদের শেষ প্রচেষ্টা নয়। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে ১৮৯৩ সালেও ইটারীর রোমে এই রকম আরও একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে তা বাতিল করা হয়।
পরবর্তীতে ফ্রান্স থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বদনাম ঘটিয়ে নানান প্রচারণা চালাতে সচেষ্ট থাকে।
সেই সময় ১৮ শতকে এসেও তুর্কি সুলতানের প্রতিকূল অবস্থায় সুলতানের পূর্ব পুরুষের যোগ্য নেতৃত্বের প্রভাব কিছুটা হলেও থেকে গিয়েছিল। ফলে সুলতানের ভয়ে ফ্রান্স, ব্রিটেন নবী পাক (স.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে এসব নাটক মঞ্চস্থ করতে সাহস করেনি।
শুধু তাই নয়, ১৮৯৬ সালে ইউরোপে জায়ানবাদী ইহুদিদের নেতা টিউডার হার্জেল ইস্তাম্বুলে এসে সুলতান ২য় আবদুল হামিদের নিকট অর্থের বিনিময়ে ফিলিস্তিন পেতে চেয়েছিলেন। ইউরোপের কাছে সুলতানের ঋণ থাকায় সুলতানকে ২০ মিলিয়ন তুর্কি লিলা দিতে চেয়েছিল। তৎমধ্যে ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনের মূল্যের পরিবতের্, বাকী ১৮ মিলিয়ন তুর্কিদের ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হবে। এতে তুর্কি সুলতানের বহুবিধ কল্যাণ হবে বলে যুক্তি দেখানো হয়। এ প্রস্তাবে সুলতান খুব আহত হন। তাদেরকে ফিরিয়ে দেন এবং প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“তোমাদের কোটি কোটি টাকা তোমাদের কাছে রেখে দাও। আমার সাম্রাজ্য যখন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, তখন ফিলিস্তিন বিনামূল্যে পাওয়া তাদের জন্য সম্ভব হবে। তবে সালতানাত টুকরো টুকরো করার জন্য প্রথমে আমার শরীরটা টুকরো টুকরো করতে হবে। আমি বেঁচে থাকতে আমার শরীর টুকরো টুকরো করতে দেব না।”
সুলতান ২য় আবদুল হামিদ ১৮৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৩৪ বছর বয়সে খেলাফতের মসনদে বসেন। একাধারে ৩৩ বছর ওসমানী সাম্রাজ্যের খলিফা ছিলেন। ১৯০৯ সালে সুলতান ইন্তেকাল করেন।
সুলতান ২য় আবদুল হামিদ সম্পর্কে ব্রিটিশ এডমিরাল লর্ড জন ফিসার বলেছেন, “তিনি সমস্ত ইউরোপবাসীর চেয়ে দক্ষ কূটনীতিবিদ ছিলেন।” জার্মান চ্যান্সেলর অট্রো ভন বিসমার্ক বলেছেন, “ইউরোপের সমস্ত মানুষের বুদ্ধিমত্তার ৯০% ছিল আবদুল হামিদের। ৫% আমার নিজের এবং বাকি ৫% সমস্ত মানুষের!”
সুলতান ২য় আবদুল হামিদের শাসনকাল খেলাফতে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়।
সুলতান আবদুল হামিদের ইন্তেকাল ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানের সাথে তুরস্ক সুলতানের পরাজয়ে বিশ্বের বুকে বিশাল তুকি সাম্রাজ্য ভেঙে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। ব্রিটেন, ফ্রান্স মিত্ররা এতে ভাগ বাটোয়ারা বসায়। বিশ্বের বুকে মুসলমানদের নেতৃত্ব শক্তি চারকার হয়ে যায়।
১ম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর ওসমানীয় সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ফলে সুলতান থেকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করতে হল না। সুলতানের ইন্তেকালের থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি শুরু হয়ে যায় এবং তা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। অপরদিকে ফিলিস্তিনীরা ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে দিন যাপন করতো। আরও পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে শুরু করে।ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতায় ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ডে জবরদখলী ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৩ সালে বিশ্বের বুকে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল, মিশরের আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার বুমেদিনসহ অনেক নেতা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
ইতিহাস বলে, বাদশাহ ফয়সালের সাহসে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ৬ বছর আগে ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে বিশাল সিনায় উপদ্বীপ পুনরুদ্ধারে যুদ্ধে নামে। ১৭ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের অস্তিত্ব বিপন্নের পথে। এমনি অবস্থায় আমেরিকার হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি করতে বাধ্য হয়। ক্যাম্প ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে মিশর সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায়।
আজ ইউরোপসহ অমুসলিম দেশে মুসলমানেরা মার খাচ্ছে। বিশ্ব মুসলিমের রাজা বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, তক্ত রক্ষার জন্য এক প্রকার ভীতু বলা যাবে।
ব্রিটেন থেকে কুখ্যাত সালমান রুশদি নবী পাক (স.)’র শানে অবমাননাকর বই লিখে। মুসলিম বিশ্বের কোন নেতা এ বিষয়ে হুংকার দেওয়ার সাহস করেনি। একমাত্র ইরানে ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনী তাকে হত্যা করার ঘোষণা প্রদান করেন। ইমাম খোমেনী ইন্তেকাল হয়ে গেছে, কিন্তু তার ঘোষণা রয়ে গেছে। ফলে সালমান রুশদির আমৃত্যু প্রকাশ্যে আশা সম্ভব হবে না।
এখনও ফ্রান্সসহ অমুসলিম দেশ থেকে মুসলমান, নবী পাক (স.) এবং ইসলাম ধর্মের উপর আঘাত করে নানা কিছু করা হচ্ছে। কিন্তু নেতা নেত্রীরা নীরব দর্শক। বরং উল্টো তক্ত রক্ষার জন্য হাত মিলাতে ব্যস্ত।
তুর্কি বিশাল সাম্রাজ্য আর ফিরে আসবে না; আসবে না সাহসী তুর্কি সুলতানগণ। ফিলিস্তিন সিরিয়াসহ বিশ্বে মুসলমানগণের অবহেলিত অবমাননাকর অবস্থা কবে শেষ হবে বা মহান আল্লাহ পাকই জানেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমইজ্জ্যারটেক থেকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ২