প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু টানেল ও কক্সবাজার রেলের সুফল

কর্ণফুলী মোহনার আগে বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ অনেকটা সমাপ্তির পথে। অপরদিকে, কক্সবাজার পর্যন্ত রেলের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ দুইটি মেগা প্রকল্পের কোন একটিরও সুফল জনগণ নিকটতম সময়ের মধ্যে পাবে বলে মনে হয় না। জানি না এ দুইটির বা কোন একটির সুফল পেতে আগামীতে কত বছর লেগে যাবে। সড়ক যোগাযোগ ভিক্তিক কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হয়ে যাচ্ছে। স্বভাবতই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক চার বা ছয় লাইনে উন্নীত হবে।

এক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এ টানেল নির্মাণ করে এর কার্যক্রমের সুফল না আসার ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের দুরদর্শীতার অভাব বলা যাবে কিনা! চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিম পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত আঞ্চলিক সড়ক। কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেলের সংযোগ সড়ক হিসেবে ৫/৬ কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এ রাস্তার সুবিধা দিতে পশ্চিম পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী আঞ্চলিক সড়কে পশ্চিম পটিয়া-আনোয়ারা অংশে প্রায় ৮/১০ কি.মি সরু ছোট রাস্তাকে বিশালভাবে প্রশস্ত করে ৬ লাইনে উন্নতি করা হচ্ছে। উত্তর দিকে ওয়াই জংশনে (ক্রসিং) চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সংযোগ দেয়া হচ্ছে। ৬ লাইনের এ বিশাল সড়ক দক্ষিণ দিকে বাঁশখালী সড়কের সাথে সংযোগ দেয়া হচ্ছে।

সারা বাংলাদেশের ছোট বড় যানবাহন কর্ণফুলী টানেল দিয়ে এ ৬ লাইনে এসে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। যেহেতু বাঁশখালী হয়ে আঞ্চলিক মহাসড়কটি সরু। ওয়াই জংশন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১৩০ কি.মি মহাসড়ক এখনও দুই লেইনের। ফলে কক্সবাজারমুখী সারা বাংলাদেশের গাড়ি আনোয়ারা পটিয়া পশ্চিম পটিয়া এসে ভয়াবহ জ্যামে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা।

অর্থাৎ কর্ণফুলী টানেলের সুফল শীঘ্রই আসবে মনে হয় না; যতক্ষণ না চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার বা ছয় লেইনে উন্নীত করা হবে না, তত বছর বঙ্গবন্ধু টানেলের তেমন সুফল আসবে না।

কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্প তৈরি করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার বা ছয় লাইনে উন্নীত করা প্রকল্পও সাথে থাকা আবশ্যক ছিল। একভাগে কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ শুরু হবে অপর ভাগে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়নের কাজও শুরু হবে। কিন্তু তা হল না। সারা বাংলাদেশের গাড়ি চট্টগ্রাম মহানগরীকে পরিহার করে পতেঙ্গা কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল পার হয়ে যখন পশ্চিম পটিয়া আনোয়ারা আসবে তখন অবস্থা কি দাঁড়াবে! যেহেতু চাহিদা অনুপাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার বা ছয় লাইনে উন্নতি হয়নি। কাজ শুরু করে তা শেষ করে এর প্রতিফলন কতটুকু কি হতে পারে তাও পর্যালোচনা করা আবশ্যক।
কক্সবাজার রেল যোগাযোগ:

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুনভাবে জমি অধিগ্রহণ করে রেলের জন্য রাস্তা তৈরি করে রেল লাইন বসানোর কাজ চলমান। এখানে কক্সবাজার সহ কয়েক জায়গায় রেল স্টেশনের কাজ শুরু হয়েছে। দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্পের এই কাজ হয়ত আগামী ২/১ বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে। কিন্তু এর সুফল আসতে আরও কত বছর লেগে যাবে তা সময়েই বলে দিবে। যেহেতু

১. চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেল লাইন নতুনভাবে সাজাতে হবে। হয়ত ব্রিটিশের করে যাওয়া অনেক ব্রীজ কালভার্ট পুনঃ নির্মাণ করতে হবে।
২. কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর পদ্মা সেতুর মত সেতু নির্মাণ আবশ্যক হবে। যেখানে সেতুতে রেলও চলবে, সড়কের যানবাহনও চলবে।
৩. ষোলশহর থেকে ফৌজহারহাট নতুনভাবে রেল লাইন নির্মাণ করতে হবে। পুনঃ নির্মাণ করতে হবে ফৌজদারহাট ও ষোলশহর ব্রিটিশের করা রেল স্টেশন।
দোহাজারী-কক্সবাজার ২/১ বছরের মধ্যে রেলের কাজ শেষ হলেও রেলের এ বড় বড় প্রকল্পের কাজ আগামী যত বছরেই সমাপ্ত হবে না তত বছর এ রেলের সুফল আসতে পারে না। আমাদের দেশে মাননীয় মন্ত্রী, এম.পি, সরকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যক্তিদের আশ্বাসের কমতি নেই। কাজ হবে, হচ্ছে। কিন্তু কথার সাথে বাস্তবতা কতটুকু!

ব্রিটিশরা কর্ণফুলী নদীতে কালুরঘাট রেলসেতু নির্মাণ করে ১৯২০ এর দশকে। ১৯৩০/৩১ সালে দোহাজারী রেল চালু হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ শুরু করার সাথে সাথে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর পৃথক সেতু নির্মাণসহ উত্তর দিকের কাজ শুরু করে দেয়া। কাজ শুরু ত নয়ই যতটুকু জানা যায় অর্থ বরাদ্দ ও ডিজাইন চূড়ান্ত হয়নি।

মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকি.মি এর দেশ জনসংখ্যা ১৭ কোটি। বিশ্বের অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই দেশে হাজার হাজার একর জমি নষ্ট করে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেল লাইন সম্প্রসারণ কি ভেবে তত গুরুত্ব! মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ কত শত বছরে হবে তা অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সাথে মায়ানমারের সম্পর্ক ভাল নয়। এ রেল লাইনের সুফল কাদের জন্য?

আমি চট্টগ্রামের সন্তান, চট্টগ্রামেই থাকি। অনেকের সাথে আলাপ হয়। কেন জানি বেশির ভাগই কক্সবাজার রেল যোগাযোগের পক্ষে মত দিচ্ছে না। প্রায় সকলেই কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ৪/৬ লাইনে উন্নীতকরণ দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষে।

কক্সবাজারের ঐদিকে জনবসতি কম। রেল লাইনের ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাত্রা সহজ হলেও, কক্সবাজার জেলার বেশির ভাগ উপজেলার লোকজনের তেমন উপকার হবে না। কক্সবাজার জেলার পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী উপজেলায় জনগণও রেলের সুফল ভোগ করবে মনে হয় না। শুধু মাত্র চকরিয়া রামু কক্সবাজার তিন উপজেলার জন্য এ রকম হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেলের খরচ কতটুকু গ্রহণযোগ্য।

একাধিক সচেতন ব্যক্তি এও বলেন, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমুদ্রের পাড় ধরে মেরিন ড্রাইভ করার। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নির্মিত হয়ে চালু হয়ে গেছে মেরিন ড্রাইভ। কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু টানেল সাগরের কাছে, বিমান বন্দরের নিকটে। কক্সবাজার রেলের প্রজেক্টের স্থলে পতেঙ্গা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধকে মেরিন ড্রাইভ হিসেবে নির্মাণ করলে কতই না উত্তম হত। কক্সবাজার রেলের প্রয়োজনে হাজার হাজার একর জমিও নষ্ট হত না, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ব্যয়কৃত সরকারী অর্থও সাশ্রয় হত, উপকূলীয় জনগণ নিরাপত্তা পেত, পর্যটন বিকাশে সহায়ক হত।

কক্সবাজার পর্যটনের জন্য ডিভাইটেড হাইওয়ে ও আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থাকলেই ত চলে। বরং পর্যটন আকর্ষণের জন্য কক্সবাজারকে সাজানো আবশ্যক। এখানে সাগর দেখা বাদে তেমন কিছু আছে মনে হয় না। দেশের অর্থে বা বিদেশী ঋণে না হয়ে কোন দাতা সংস্থা দান হিসেবে কক্সবাজার রেল লাইন করে দিলে তা ভিন্ন কথা।

চট্টগ্রাম-ঢাকার মত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ডিভাইটেড হাইওয়ে থাকলে হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে রেলের প্রকল্প কতটুকু গুরুত্ব বহন করবে ভাববার বিষয়। ইহা ত চট্টগ্রাম-ঢাকা নয়ই চট্টগ্রাম-সিলেটের মত ন্যূনতম রেলের গুরুত্ব বহন করবে না।

চট্টগ্রামের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগে সড়ক ও আকাশের চেয়ে রেলের গুরুত্ব অত্যধিক মনে করি। শুধু তাই নয়, দেশেই চট্টগ্রাম-ঢাকা রেল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ। ব্রিটিশ পাকিস্তান পেরিয়ে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি চলমান। কিন্তু দুঃখের বিষয় লাকসাম-নারায়ণগঞ্জ ৭০/৮০ কি.মি ব্রিটিশের রেল লাইন করার প্রস্তাবটি আজও আশ্বাসে রয়েছে। বাস্তবতায় নেই। ফলে আজ শত বছরের অধিক সময় লাকসাম থেকে কুমিল্লা-আখাউড়া হয়ে ৬০ কি.মি ঘুরপথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে হচ্ছে রেলকে।

দেশের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও রেল মন্ত্রণালয় এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ভাবতে হবে কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং কক্সবাজার রেলের এ দুইটি মেগা প্রকল্পের সুফল কত কম সময়ে জনগণ পেতে পারে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু
পরবর্তী নিবন্ধবাবা-মায়ের ঝগড়ার পর গলায় ফাঁস দিয়ে কিশোরীর আত্মহত্যা