বিশ্বের প্রাচীন জনপদের মধ্যে মিশর অন্যতম। প্রাচীন সভ্য দেশ বলা হয় এই মিশরকে। শুধু তাই নয় মিশরীয় সভ্যতা হিসেবে নানান ইতিহাস রয়েছে। মিশরকে নীল নদের দান বলে প্রবাদ বাক্য আছে। এই নীল নদই মিশরে নানা অবদান রেখে সভ্যতার উচ্চ শিখরে নিয়ে যায়। খ্রিস্ট–পূর্ব ৩৩০০ থেকে মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস রয়েছে। এই দীর্ঘ ইতিহাসে যুগে যুগে নানা সভ্যতা মিশরীয়কে নাড়া দিয়ে যায় ফেরাউনিক, গ্রিক ও মুসলিম সভ্যতা গ্রহণ করে।
৯ লাখ ৯৫ হাজার ৭৩৮ বর্গ কি.মি এর দেশ মিশর। জনসংখ্যা প্রায় ৮ কোটি। শতকরা ৯৪ ভাগ মুসলমান।
নীল নদের সুবিধা নিয়ে মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম মিশরে অতি উচ্চমানের এক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, নীল নদের পানি পূর্ণ ব্যবহারের জন্য মিশরীয়দেরকে শিখতে হয়েছে কারিগরি বিদ্যা ও ভূমি জরিপ বিদ্যাসহ নানান জ্ঞান–বিজ্ঞান।
মূলত কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট বহু জ্ঞানই তাদেরকে আয়ত্ত করতে হয়েছে। মিশরীয়রা সেকালে জ্যোতিবিদ্যা শিক্ষা করে তা থেকে সঠিক পঞ্জিকা বের করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রাচীনকালের মিশরীয় সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন পিরামিড। খ্রিষ্ট–পূর্ব রাজা বাদশাহগণের সমাধি মন্দির হিসেবে গণ্য। এই সব পিরামিড বর্তমানকালের বিজ্ঞান যুগের মানুষের জন্য এক বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই পিরামিড সপ্তাশ্চর্য্যের মধ্যে একটি। খ্রিস্টজন্মের কয়েক হাজার বছর আগে প্রাচীনকালে এত ওজনের পাথরসমূহ কিভাবে মেপে নিখুত মসৃণভাবে কাটল এবং কিভাবে এত উপরে তুলে সুন্দর নিখুতভাবে তৈরি করল তা দেখলে আর চিন্তা করলে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়।
পিরামিডের সবচেয়ে বড় বিস্ময় হল নির্মাণ কৌশল। চারকোণা পাথরের অসংখ্য খন্ড বসিয়ে এই মানব সৌধ নির্মিত হয়েছিল। প্রথম তাকের উপর ২য় তাক বসানো হয়েছে সামান্য ভিতরের সাইডে। এভাবে ছোট হতে হতে তা শীর্ষে গিয়ে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। খ্রিস্ট–পূর্ব ২৭৮০ হতে এই পিরামিড নির্মাণের প্রচলন হয় বলে জানা যায়। বিরামহীন গবেষণা ও পরিশ্রমের পর তৎকালীন প্রকৌশলী ‘ইমাহুতার’ রাজা জোসাস এর জন্য ৭ তলা বিশিষ্ট সাদা পিরামিড তৈরি করেন। এটি বিশ্বের প্রথম পিরামিড বলে জানা যায়।
খ্রিস্ট–পূর্ব ২৪৪৬ রাজা হুফু নিজের জন্য নির্মাণ করেছিলেন এক বিশাল পিরামিড। ১ লাখ শ্রমিকের ২০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমেই গড়ে উঠেছিল এই পিরামিড। মূলতঃ সেকালে রাজা–বাদশাহগণের মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য এই পিরামিড নির্মাণ প্রচলন হয়।
মিশরীয় সভ্যতার মূলে নীল নদের দান বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। যেহেতু নীল নদবিহীন মিশরকে মরুভূমিই বলা হবে। নীল নদ ও এর অববাহিকা অঞ্চলে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য বিশ্বে যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত হয়ে আছে।
নীল নদের তীরে হাজার হাজার বছরের একাধিক শহর মনোরম সাজে সজ্জিত হয়ে আছে। এই নীল নদে শিশু নবী হযরত মুসা (আ.)’র ভেলা ভেসেছিল এবং ফেরাউনের শাহী মহলের মহিলারা তাকে তুলে নিয়ে লালন–পালন করেছিল।
বিশ্বের দীর্ঘতম নদী এই নীল নদ। যার দৈর্ঘ্য ৬৬৭১ কি.মি, বিশ্বে দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান। যার দৈর্ঘ্য ৬৪৩৭ কি.মি। বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী হচ্ছে ইয়াং চি যা আমাদের এশিয়াতে অবস্থিত। যার দৈর্ঘ্য ৬৩০০ কি.মি।
নীল নদের রয়েছে দু’টি উপনদ। শ্বেত নীল, নীলাভ নীল নদ। এর মধ্যে শ্বেত নীল নদ দীর্ঘতম। তা আফ্রিকার মধ্যখানের হ্রদ অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়। এর উৎস স্থল দক্ষিণ রুয়ান্ডাতে। তানজানিয়া, ভিক্টোরিয়া হ্রদ, উগান্ডা এবং দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
অপর শাখা নীলাভ নীল নদ। ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুদান প্রদেশে প্রবেশ করেছে। দুইটি উপনদী সুদানের রাজধানী খার্তুমের নিকটে মিলিত হয়েছে। নীল নদের উভয় শাখা সুদানে মিলিত হয়ে মিশরের মধ্যে প্রবাহিত।
মিশরের একাংশ মরুভূমি। বিশ্বখ্যাত সাহারা মরুভূমি মিশরে এসে শেষ হয়েছে। মিশরের বাকী অংশ নীল নদের ধারা প্রাকৃতিক ও কৃষি জনবসতিসহ নানা বিষয়ে অবদান রেখে চলেছে।
আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.)’র আমলে ৬৪১ সালে মিশর জয় হয়। ৬৬৮ সাল পর্যন্ত ইসলামি খলিফাগণের শাসনাধীন ছিল। অতঃপর তথায় খালিদ বংশ ৯৬৮ সাল পর্যন্ত, ফাতেমী বংশ ১১৭১ পর্যন্ত, আইয়ুবী বংশ ১২৫০ সাল পর্যন্ত, মামলুকী বংশ ১৫১৭ সাল পর্যন্ত শাসন করে গেছেন। অতঃপর শুরু হয় তুর্কি সালতানাতের আমল। তারা ইস্তাম্বুলে বসে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩ শত বছরের কাছাকাছি মিশর শাসন করে গেছেন।
অতঃপর শুরু হয় তুর্কিদের গভর্নর মুহাম্মদ আলী বংশের শাসন। তিনি ১৮০৫ সাল থেকে স্বাধীনভাবে মিশর শাসন করতে শুরু করেন এবং রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তারই উত্তরসূরী ইব্রাহীম পাশা ১৮৬৩–১৮৮১ সাল পর্যন্ত মিশর শাসন করে ব্রিটিশ ও ফরাসির সহায়তায় তথায় ঋণ নিয়ে। এ ঋণ যথাযথ সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় মিশরের রাজস্ব ব্যবস্থা অ্যাংলো ফ্রান্সদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যদিওবা নামে মাত্র ওসমানিয়া তুর্কিদের কথা বলা হত।
মূলত ইব্রাহীম পাশার শাসনের পর থেকে ১৮৮২ সাল হতে ব্রিটিশরা মিশর শাসনের সূচনা করেন।
১৯১৪ সালে মিশরকে ব্রিটিশের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশরা কৌশল হিসেবে ১৯২২ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম ফুয়াদকে ক্ষমতায় বসায়। ১৯৩৬ সালে তার ছেলে ফারুককেও নামে মাত্র সিংহাসনে বসানো হয়। মিশরীয় জনগণের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক নানান প্রতিকূলতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা ধীরে ধীরে মিশর ত্যাগ করতে থাকে। কিন্তু এর মধ্যে ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় মিশরও ইটালীয় আক্রমণের শিকার হয়।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তনের বুকে অবৈধ ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে মিশরসহ অন্যান্য রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ ব্যর্থ যুদ্ধের অবসান হয় ১ বছরের মাথায়। এ যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা অংশ মিশরের দখলে চলে যায়।
১৯৫২ সালে ২৩ জুলাই বাদশাহ ফারুকের সরকার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়। ক্ষমতায় আসেন কর্ণেল জামাল আবদুন নাসের। অতঃপর কিছুকাল মিশরে রাজতন্ত্র উৎখাত হয়ে ক্ষমতার হাত বদল হতে থাকে। তারপরও কর্ণেল নাসের মিশরে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে থাকেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী অতঃপর রাষ্ট্র প্রধান হন। তিনি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে মিশরের নানান উন্নয়ন ও সংস্কার সাধন করেন। তার আমলেই ব্রিটিশ বাহিনী থেকে সুয়েজ খাল মুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ব্রিটিশ ও ফ্রান্স মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তখন বিশ্বে প্রভাবশালী রাশিয়া কেন্দ্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য প্রভাবশালীর চাপে যুদ্ধ বন্ধ হয়।
১৯৬৭ সালের ৫ জুন সুযোগ বুঝে ইঙ্গ মার্কিন ইন্ধন ও সহায়তায় ইসরাইল এক সাথে মিশর, জর্ডান, সিরিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মাত্র ৬ দিন স্থায়ী এ যুদ্ধে ইসরাইল মিশরের পশ্চিমে বিশাল সিনাই উপদ্বীপ, উত্তর পূর্বে সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং পূর্বে জর্ডানের পূর্ব জেরুজালেম ও জর্ডানের পশ্চিম তীর দখল করে নেয়।
এখানে উল্লেখ্য ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালীন জেরুজালেম নগরী ভাগ হয়ে যায়। এ নগরীর পশ্চিমাংশ ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে এবং বায়তুল মোকাদ্দাসসহ পূর্ব জেরুজালেম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৬৭ সালের এ যুদ্ধে চরম ব্যর্থতার গ্লানি নানা রোগে আক্রান্ত হন জেনারেল নাসের।
১৯৭০ সালে আবদুন নাসের মারা গেলে কর্ণেল আনোয়ার সাদাত তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি যোগ্যতার সাথে মিশর শাসন করতে থাকেন। ১৯৭২ সাল থেকে পরাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেন। ১৯৭৬ সালে তা কার্যকর করে রাশিয়া কেন্দ্রিক সোভিয়েত ব্লকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মার্কিন ব্লকে চলে যায়। যদিওবা ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে আনোয়ার সাদাত সিনাই উপদ্বীপ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় যুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছিল।
ইঙ্গ মার্কিন হস্তক্ষেপ না হলে এই যুদ্ধে ইসরাইলের অস্তিত্ব টিকে থাকত কিনা বলা মুশকিল। অর্থাৎ মিশর ও সিরিয়ার এক সাথে আক্রমণে ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। হুমকির সম্মুখীন হয় ইসরাইলের অস্তিত্ব। এমতাবস্থায় ইঙ্গ মার্কিন কঠোর হস্তক্ষেপে ১৭ দিন পর যুদ্ধ স্থগিত করতে মিশর বাধ্য হয়। যুদ্ধ স্থগিতে গোপন প্রতিশ্রুতি মতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ক্যাম ডেডিট চুক্তির মাধ্যমে মিশর সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায়। কিন্তু সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর ইসরাইলের জবর দখলে থেকে যায়।
মিশরীয়রা দু’টি শব্দ আওড়াতে থাকে। আর তা হল ‘উম্মুত দুনিয়া’। অর্থাৎ দুনিয়ার মা। এই শব্দটি মনে হয় শত ভাগ মিশরীয়দের কাছে প্রসিদ্ধ। আজও তাদের দিলে রক্তে প্রবাহিত বিশ্বের সভ্যতা উৎপত্তি তাদের কাছ থেকে। এই জন্য তারা উম্মুত দুনিয়া তথা দুনিয়ার মা বলে দাবি করতে কুণ্ঠিত হয় না।
হজ্ব, ওমরাহ যেয়ারত উপলক্ষে সৌদি আরবে গমন করলে মিশরীয়দের মুখ থেকে এই কথা বারে বারে শুনতে পাই।
বস্তুতঃ মিশর বিশ্বে আলোচিত পরিচিত দেশ। প্রাচীনকাল থেকেই তারা সভ্য জাতি বলে গর্ববোধ করে থাকে। শুধু তাই নয়, মিশরীয় সভ্যতা হিসেবে বিশ্বে খ্যাত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট