প্রকৃত শিক্ষা খোঁজাও একটা দায়িত্ব

ছন্দা চক্রবর্তী | সোমবার , ২ জুন, ২০২৫ at ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ

স্বামী বিবেকানন্দ মানবজাতিকে শিক্ষা সম্মন্ধে বলতে গিয়ে একটা প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘যে শিক্ষা দ্বারা ইচ্ছাশক্তির বেগ ও স্ফুর্তি নিজের আয়ত্বাধীন ও সফলকাম হয় তাহাই শিক্ষা। আর যে শিক্ষার ফলে এই ইচ্ছাশক্তি ক্রমাগত বংশানুক্রমে বলপূর্বক নিরুদ্ধ হইয়া এক্ষণে লুপ্তপ্রায় হইয়াছে, যাহার শাসনে নতুন ভাবের কথা দূরে থাক, পুরাতনগুলিই একে একে অন্তর্হিত হইতেছে, যাহা মানুষকে ধীরে ধীরে যন্ত্রের ন্যায় করিয়া ফেলিতেছে সে কি শিক্ষা ?’’

স্বামীজীর সেই তত্ত্বকথাটা আজ কদিন ধরে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে ছোট বেলায় স্কুল থেকে পুরস্কার পাওয়া ডেল কার্নেগী সিরিজের পড়া বা শিখাগুলি আবার পড়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। এখন এই সিরিজের দুটো বই; যথাক্রমে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ড এন্ড ইনফ্লয়েন্স পিপল’ ও ‘ডেভলাপমেণ্ট অব পার্সোনালিটি এন্ড ইজি ওয়ে টু সাক্সেস’ হাতের কাছে পেলাম বলে পড়ে দেখার লোভ হলো। তার সাথে এই প্রজন্মের পড়ুয়া তরুণ প্রজন্ম যে সব বইকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ে যেমন ব্রাজিলীয় ঔপন্যাসিক পাওলো কোয়েলহো এর আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার বই ‘দ্য আলকেমিস্ট’, হ্যাল এলরড এর ‘দ্য মিরাকল মর্নিং’, ‘থিবো মেরিসের ‘ডোপামিন ডিটক্স’ এ রকম কিছু বই পড়ে দেখলাম।

ছোট বেলায় বই গুলির কয়েকটা পড়া ছিল, কিন্তু পড়ে হয়তো কিছু টেকনিক বা তথ্য জেনেছিলাম কিন্তু জ্ঞান বলে যে জিনিস সেটা গ্রহণ করতে পারিনি, কারণ জীবনে যে শেখাকে কাজে লাগানো যায় না তাকে জ্ঞান বলা যায় না, কিছু খুঁটিনাটি তথ্য জমা হয়েছিল হয়তো। প্রয়োগের চর্চা তেমন হয় নি বলে সেসব ক্ষেত্রে স্বামীজীর তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন যন্ত্র নির্ভরতায় সার। অনেকটা কবির কথার মতো ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন,/নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন’। আসলে যে কোনো বইকে যত বার পড়া হয় ততবার করে এক একটি নতুন বোধের ধারনা জন্মে। আর সেই ধারনা সমূহকে মানুষ নিজের চর্চায় রাখতে পারলে সেই পাঠকের জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়।

ডেল কার্ণেগীর বই পাঠ করে আমি কাজে লাগাতে না পারলেও বিশ্বের অনেক সাকসেস্ফুল মানুষ এই বইকে আঁকড়ে ধরে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন।’ হাউ টু উইন ফ্রেন্ড এন্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’ বই টিতে অনেক কৌশল বাতলানো আছে যেমন কীভাবে নিজেকে অন্যের কাছে চট করে ভালো লাগানোর কৌশল, অন্যকে স্বমতে আনার কৌশল, তর্কে জেতার শ্রেষ্ঠ উপায়, অন্যের নিকট নিজেকে পছন্দনীয় করে তোলার কৌশল। এসব কৌশলে ভরা আছে বইটি। এটি আসলে অনেকটা আমেরিকান মানুষ এর জীবন যাত্রার সাথে চলমান কৌশল। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে সকলে এখন বিশ্বসংস্কৃতির অংশীদার। সহজ সরল মানুষের উপযোগী কিছু বিষয় আছে মুগ্ধ হওয়ার মত যেমন জন সংযোগের কৌশল, কখনো অন্যের সমালোচনা না করার বিষয়, অপরের প্রতি ব্যবহার রহস্য, অন্যকে সঙ্গী করার সুফল, ভালো বক্তা হওয়ার কৌশল, ভুল করে থাকলে তা স্বীকার করার সাহস রাখা, শুভ বুদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে চলা, অভিযোগের সাবধানতা, অন্যদের উৎসাহী করার পদ্ধতি ইত্যাদি যে কোনো জায়গার যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য মূল্যবান শিক্ষা এখানে রয়েছে।

অসংখ্য উদাহারণ এর দ্বারা বইটি লেখা হয়েছে যেমন যে কাউকে লেখক ভদ্র এবং বিনয়ী হতে বলছেন কারণ তিনি ব্যাখার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, তাই অন্যকে সবসময় বলতে দিন, আর সেই সব বলা কথা আপনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকুন। বিখ্যাত দার্শনিক হেনড্রিক্স এর একটা কথা আছে ‘জ্ঞানীরা বলেন আর প্রাজ্ঞরা শোনেন’ তাই লেখক প্রাজ্ঞতাকে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি আরো বলছেন, আপনি যদি শত্রু বাড়াতে চান, তাহলে বন্ধুদের অতিক্রম করুন, আর যদি বন্ধু বাড়াতে চান, তবে তাদেরকে আপনাকে অতিক্রম করতে দিন। লেখক এর ভাষায় একজন মুর্খ ও জ্ঞানীর মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক পার্থক্য হলো মাত্র থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে উপস্থিত এক নিকেল মাপের আয়োডিন। কোনো চিকিৎসক যদি ঐ আয়োডিন আপনার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড থেকে সরিয়ে নেন তবে আপনিও একজন বোকা মানুষ। এই সামান্য আয়োডিনই সব বদলে দিতে পারে, তাই অপরকে স্বমতে আনতে হলে তাকেই বেশি কথা বলতে দিন, তাকেই বেশি গুরুত্ব দিন। আসলে চমৎকার সব উদাহারণে ভরা ডেল কার্নেগীর বইগুলো তাইতো বিশ্বে বেস্ট সেলার এর কৃতিত্ব পেয়েছে।

বার বার করে পড়া বই এর মধ্যে এক একবার একেক রকমের উপলব্ধি হওয়া বই পাওলো কোয়েলহোর ‘আলকেমিস্ট’ নামক উপন্যাসটি। তরুণ পড়ুয়া সিরিয়াস পাঠকদের পছন্দের শীর্ষে থাকা বইটি না পড়ে থাকলে অনেক কিছু মিস হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা হবে। উপন্যাসটির কিশোর নায়ক সান্তিয়াগো স্পেনের আন্দালুসিয়ায় বাস করে। সেই সান্তিয়াগোর লক্ষ্য পূরনের জীবন ভ্রমণের সাথে পাঠকেরও এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা অর্জনের ভ্রমণ এখানে চলমান থাকে। ভ্রমণের মধ্যদিয়ে লেখক পাওলো কোয়েলহো দেখিয়েছেন যে, সাফল্যের কোনো শর্টকার্ট রাস্তা নেই। সত্য সবসময় সত্যিই হয়, আর পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাটি।

এখানে লেখক সান্তিয়াগোকে ধৈর্য্যের শিক্ষা, পরিশ্রমের শিক্ষা, একাগ্রতার শিক্ষা, বেদুইন কন্যা ফাতিমার ভালোবাসার শক্তি, তার বিরহের শক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করতে করতে তার সাথে দেখা করায় রহস্যময় এক ব্যাক্তি আলকেমিস্টের সাথে, যিনি লোহাকে স্বর্ণে রূপান্তর করতে পারেন। কিশোর নায়ক সান্তিয়াগো লক্ষ্যের প্রতি দৃঢ়মনোবল প্রতিজ্ঞা এইসব আলকেমিস্টকে মুগ্ধ করে। তিনিই তাকে পিরামিডের কাছে নিয়ে যায়। অবশেষে নানা বাধা বিপত্তি এবং চড়াইউৎরাই পেরিয়ে গুপ্তধনের খোঁজ পাওয়া যায়। এটা নিছক একটা উপন্যাস নয় একটা জীবন দর্শনও বটে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এসব বই পড়ে নিজেদেরকে ঋদ্ধ করলে তাদের চঞ্চলতা কমে আসবে। ইংরেজী, বাংলা বা অনলাইন ভার্সন অনেকভাবে পাওয়া যায় এখন কত রকমের সুযোগ আছে বই পড়ার জন্য, শুধু ইচ্ছাটাই প্রয়োজন।

বই পড়ার উপকারিতার জন্য নয়, আজকের শিক্ষার্থীরা যারা এক অস্থির সময়ের মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে। যাদের নিজেদের সময় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে মোবাইলের স্ক্রীনের আসক্তিতে, তারা নিজেদের জীবনকে কিভাবে সঠিক নির্দেশনায় পরিচালিত করতে পারবে সে সব শিক্ষা অর্জনের জন্য এসব বই অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে বলেই পড়ে দেখার আশা প্রকাশ করছি। আজকের তালিকায় থাকা হ্যাল এলরড এর ‘দ্য মিরাকল মর্নিং’ বইটি তে সকালের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। আজকের সূর্যোদয় না দেখা প্রজন্মের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাসেজ আছে। দেহঘড়িটা সকালে কত বেশি পরিমানে সক্রিয় থাকে তা বুঝানো হয়েছে। বর্তমানের কিশোরেরা সহ তরুণ প্রজন্ম সকালের সূর্যোদয়, ভোরের মিষ্টি রোদরশ্মি, খুব সকালের পাখির কিচিরমিচির আওয়াজের কলকাকলি এসবের সাথে পরিচিত হতে পারে না, কারণ সকাল ১০টার আগে তারা ঘুম থেকে উঠতে পারে না। সারা রাত জেগে কাটানোর বদঅভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নানা রকম উপায় ও কৌশল, শৃঙ্খলা এবং সকালের গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে লেখা’ দ্য মিরাকল মর্ণিং’ বইটি সকলের জীবন তৈরীতে সহায়ক।

একটা বিষয় নূতনভাবে শিখা হলো সেটা হলো কীভাবে না বলতে হয়। বা এভাবে বলা যায় কখন অফ থাকতে হয়। মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে, বা কোনো আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে বা একঘেঁয়েমী কাজ কর্মের বিরক্তি থেকে স্বস্তি পেতে অর্থাৎ প্রতিদিনের ‘থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড়’ থেকে আনন্দময় অনুভূতিতে ফিরে আসার উপায় জানতে ‘থিবো মেরিসের’ ‘ডাপামিন ডিটক্স’ বইটি বেশ কার্যকর। বর্তমান প্রজন্মের সন্তানেরা যে মোবাইল নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকে বা যেকোনো আসক্তি বা কাজকে আঁকড়ে পড়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, সেই অবস্থা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি শিখে নিজের কাজ ও শখের মধ্যে নিমজ্জিত থাকা যায়, তা আয়ত্তে আনা যায়। আমাদের যুব সমাজ বিপথে যাওয়ার ব্রেইন ওয়াশের পরিবর্তে ব্রেইনকে কীভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবে তা জানতে পারবে। এসব বই অনেকে পড়েছে বলেই এসব বই অনেক আগে থেকেই বেস্ট সেলার এর খ্যাতি পেয়েছে। কিন্তু যাদের পড়া নেই তারা পড়ে নিজেদের আদর্শ শিক্ষার্থী হিসেবে তৈরি করা যাবে বলে মনে করছি। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো নিজেকে ইতিবাচকভাবে বিকশিত করা। ইতিবাচক শিক্ষা খুঁজে নেওয়াও শিক্ষিত সমাজেরই দায়িত্ব।

লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহনূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে : এ মৃত্যু কি অপ্রতিরোধ্য
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে